ভোটার তালিকার ‘বিশেষ নিবিড় সংশোধন’ নিয়ে দেশের নির্বাচন কমিশনকে ভর্ৎসনা করল সুপ্রিম কোর্ট। কী উদ্দেশ্যে কমিশন বিহার বিধানসভা নির্বাচনের মুখে মাত্র মাস তিনেক সময়ে ভোটার তালিকা পুরো ঝাড়াই-বাছাই করছে? লিখছেন সুতীর্থ চক্রবর্তী।
সুপ্রিম কোর্টে ভোটার তালিকার ‘বিশেষ নিবিড় সংশোধন’ নিয়ে দেশের নির্বাচন কমিশনকে যেভাবে ধাক্কা খেতে হল, তা নজিরবিহীন। গত এক দশকে নরেন্দ্র মোদির সরকারের আমলে দেশের সব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের নিরপেক্ষ ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এবার বাদ রইল না নির্বাচন কমিশনও। বিহার বিধানসভা নির্বাচনের মুখে কী উদ্দেশ্য নিয়ে কমিশন মাত্র মাস তিনেক সময়ে ভোটার তালিকা পুরো ঝাড়াই-বাছাইয়ের কাজে হাত দিল, সেই প্রশ্ন তুলে দিয়েছে শীর্ষ আদালত।
ঝট করে কাউকে কোনও প্রশ্ন তুলতে না-দিয়ে বিশেষ কোনও সম্প্রদায়ের ৪০-৫০ লক্ষ ভোটারের নাম তালিকা থেকে বাদ দিয়ে দেওয়াই কি কমিশনের মূল লক্ষ্য ছিল? এমন অভিযোগ বিজেপি-বিরোধী দলগুলিরই। ঘটনা পরম্পরা বিরোধীদের অভিযোগের পক্ষেই যুক্তির জোগান দিচ্ছে। সুপ্রিম কোর্টের মহামান্য বিচারপতিদের পর্যবেক্ষণে সেসব যুক্তি মান্যতা পেয়েছে।
বিহারের প্রায় ৮ কোটি ভোটারের তালিকা ‘নিবিড়ভাবে’ সংশোধনের কাজ শুরু হয়েছে মাত্র তিন সপ্তাহ আগে। সরকারি কাজের গতির নিরিখে এই সময়টা কিছুই নয়। অথচ, সুপ্রিম কোর্টে ধাক্কা খাওয়ার পরেই নির্বাচন কমিশন সূত্রের খবর বলে প্রচার করা হল যে, বুথ স্তরের আধিকারিক, মানে, বিএলও-রা নাকি ইতিমধ্যেই বিহারের ভোটার তালিকায় বহু বাংলাদেশি, নেপালি ও রোহিঙ্গার সন্ধান পেয়েছেন।
এক্ষেত্রেও বিরোধীদের সংগত প্রশ্ন, বিএলও-রা শুধু বাড়ি-বাড়ি ‘এনুমারেশন ফর্ম’ বিলি করেই কীভাবে বুঝে গেলেন কারা বাংলাদেশ, নেপাল বা মায়ানমারের নাগরিক? নথিপত্রের পর্যাপ্ত যাচাই ছাড়া সম্ভবই নয় কে বাংলাদেশি বা কে রোহিঙ্গা তা নির্ধারণ করা। পাসপোর্ট তৈরির সময় যে ‘পুলিশ ভেরিফিকেশন’ হয়, তাতেই তো বোঝা যায় যে, নাগরিকত্ব প্রমাণের নথিপত্র যাচাই কতটা সময়সাপেক্ষ ও জটিল।
তাছাড়া, বিহারে ভোটার তালিকার নিবিড় সংশোধনের কাজ শুরু হওয়ার পর বাস্তবে কতটা কী হয়েছে, তা নিয়ে সম্প্রতি বিশিষ্ট ভোট-বিশেষজ্ঞ যোগেন্দ্র যাদব একটি সমীক্ষার রিপোর্ট প্রকাশ্যে এনেছেন। ওই সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, ভোটার তালিকা সংশোধন-সংক্রান্ত নির্বাচন কমিশনের তথে্যর সঙ্গে বাস্তব অবস্থার বিস্তর ফারাক।
ভোটারদের নাম ও ছবি অাগে থেকে ছাপানো ‘এনুমারেশন ফর্ম’ যত পরিবারে পৌঁছেছে বলে কমিশন দাবি করছে, অাসলে তার ৫০ শতাংশও পায়নি। বহু ক্ষেত্রে অভিযোগ পাওয়া গিয়েছে– ফর্ম বন্ধ বাড়ির সামনে ফেলে দিয়ে যাওয়া হয়েছে। নথি-সহ ফর্ম বিএলও-দের কাছে জমা পড়ার সংখ্যা খুবই কম। বিভিন্ন জেলায় সমীক্ষার পর যোগেন্দ্র যাদবরা দেখেছেন কমিশন নাগরিকত্ব প্রমাণের যে ১১টি নথি চেয়েছে, তার একটিও অন্তত ৩৭ শতাংশ ভোটারের কাছে নেই। এদের এখন একমাত্র ভরসা অাবাসিক শংসাপত্র বা ডোমিসাইল সার্টিফিকেট জোগাড় করা। যা বিডিও, এসডিও-র মতো অাধিকারিকরা দিয়ে থাকেন। ডোমিসাইল সার্টিফিকেটের জন্য বিহারের সব সরকারি দফতরে লম্বা লাইন।
এই পরিস্থিতি যাচাই করেই যোগেন্দ্ররা অাশঙ্কা করছিলেন যে, প্রায় ৩ কোটি নাম তালিকা থেকে বাদ যেতে পারে। সুপ্রিম কোর্ট সে-কারণে কিছুটা ধমকের সুরেই কমিশনকে বলেছে, নাগরিকত্ব যাচাইয়ের বিষয়টি এত কম সময়ে হওয়া সম্ভব নয়, অার তাছাড়া নাগরিকত্ব বিচারের কাজটি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের। অাধার, রেশন ও ভোটার কার্ড নথি হিসাবে গ্রহণ করা যায় কি না, তা কমিশনকে বিবেচনা করে দেখতে বলেছে সুপ্রিম কোর্ট। বিহারের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, কমিশনের তালিকাভুক্ত পরিচয়পত্রগুলি না থাকলেও ভোটারদের প্রায় ৯০ শতাংশের কাছে অাধার, রেশন বা ভোটার কার্ডের মতো পরিচয়পত্রগুলি রয়েছে। যে-সরকারি পরিচয়পত্রগুলি অধিকাংশ মানুষের কাছে রয়েছে, সেগুলিকে বাদ দিয়ে তাহলে জন্মের শংসাপত্র, মাধ্যমিকের অ্যাডমিট কার্ড, জমির দলিল, জাতি শংসাপত্রর মতো দুর্লভ পরিচয়পত্রগুলি কেন চাওয়া হল?
যে-পরিচয়পত্র বহু মানুষ দেখাতে পারবে না, সেগুলি নথি হিসাবে চেয়ে ভোটার তালিকা সংশোধন করা থেকেই স্পষ্ট হচ্ছে নির্বাচন কমিশনের উদ্দেশ্য। সুপ্রিম কোর্টের সামনে কমিশনকে জানাতে হবে কেন তারা অাধার, রেশন ও ভোটার কার্ডকে বৈধ পরিচয়পত্র করতে রাজি নয়। ২৮ জুলাই সুপ্রিম কোর্টে এই মামলার পরবর্তী শুনানি। পরবর্তী শুনানির অাগেই অবশ্য দেশের বাকি অংশে কমিশন ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধন শুরুর প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছে। এই কারণে বিহারের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের দিনেই বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দে্যাপাধ্যায় প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছিলেন, কমিশনের অাসল লক্ষ্য বাংলা।
নিবিড় সংশোধনের নামে বিধানসভা ভোটের অাগে বাংলার ভোটার তালিকা থেকে ৪০-৫০ লক্ষ নাম ছেঁটে ফেলতে চাইছে বিজেপি। এতেই বাংলায় কেল্লা ফতে হবে বলে হয়তো বিজেপি মনে করছে। বিজেপির রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা নিয়ে অভিযোগ তুলে নির্বাচন কমিশনকে সরাসরি অাক্রমণ করে মাঠে নেমে পড়েছে তৃণমূল-সহ অন্যান্য বিরোধী দল। এই ধরনের অভিযোগের মুখোমুখি দঁাড়িয়ে পড়া যে নির্বাচন কমিশনের মতো একটি সংস্থার কাছে অভিপ্রেত নয়, তা বলা বাহুল্য। কেন্দ্রের শাসক দলের অঙ্গুলিহেলনে অতীতেও নির্বাচন কমিশনকে নড়াচড়া করতে দেখা গিয়েছে। নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে অতীতেও কেন্দ্রের শাসক দলের বিরোধী অবস্থানে থাকা দলগুলিকে মুখ খুলতে দেখা গিয়েছে। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের ভর্ৎসনার মুখেও কমিশনের পড়ে যাওয়া বেনজিরই। মামলায় এক বিচারপতি মন্তব্য করেন, যেসব পরিচয়পত্র বিহারের একজন সাধারণ ভোটারকে দেখাতে বলা হয়েছে, তা তিনিই জোগাড় করতে পারবেন না।
কেন্দ্রীয় সরকারের ‘পিরিওডিক লেবার ফোর্স সার্ভে’-র একটি রিপোর্ট বলছে, দেশে পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ১৫ কোটি। এদের মধে্য একটা বড় অংশ কাজের জন্য এক রাজ্য থেকে অন্য রাজে্য যায়। অনেকে রাজে্যর মধে্যই পরিযায়ী। তারা এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে যায়। ১৯৫০ সালের যে জনপ্রতিনিধিত্ব অাইনের ভিত্তিতে ভোটার তালিকা তৈরি হয়, তার ১৯ নম্বর ধারায় বলা রয়েছে, ভারতীয় নাগরিকদের কোনও বিধানসভা কেন্দ্রে ভোটার তালিকায় নাম তুলতে গেলে সেখানকার সাধারণ বাসিন্দা হতে হবে। ওই অাইনেরই ২০ নম্বর ধারায় সাধারণ বাসিন্দার সংজ্ঞা দেওয়া রয়েছে। এই সংজ্ঞায় পরিযায়ীরা তাদের স্থায়ী ঠিকানার সাধারণ বাসিন্দা নয়।
ভোটার তালিকার যে কোনও নিবিড় সংশোধনে তাদের নাম বাদ পড়তেই পারে। যেভাবে অাইনে কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী, সেনা বা কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মীদের বা অনাবাসী ভারতীয়দের তাদের দেশের ঠিকানায় ভোটার তালিকায় নাম রাখতে দেওয়া হয়, সেই অাইনি রক্ষাকবচ পরিযায়ী শ্রমিকদেরও পাওয়া উচিত। সংশোধনে বহু নাম বাদ দেওয়ার পরিকল্পনা করা হলেও পরিযায়ীদের জন্য অাইনের এই রক্ষাকবচ তৈরির ভাবনা সরকার বা কমিশনের দেখা যাচ্ছে না। যেনতেন উপায়ে ভোটার তালিকা থেকে জনসমষ্টির নির্দিষ্ট একটি অংশকে ছঁাটাই করে ভোটে জেতার চেষ্টা কখনও সমর্থনযোগ্য হতে পারে না।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.