সরকারি তথ্য অনুসারে, ৩০ জুন ২০২৫ পর্যন্ত ব্যাঙ্কগুলিতে দাবিহীন আমানতের পরিমাণ ৬৭,০০০ কোটি টাকারও বেশি। এই সমস্যার মূলে দায়ী আর্থিক অজ্ঞতা এবং শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটি। আর্থিক শিক্ষার অভাবই আমাদের হয় অপ্রয়োজনীয় সঞ্চয়ের দিকে ঠেলে দেয়, নয়তো বিপদের সময় ঋণের ফাঁদে ফেলে। লিখছেন সুজনকুমার দাস।
আপনার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে যত টাকা আছে, তা কি জীবদ্দশায় পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারবেন? না কি জীবনের শেষে দেখবেন, অনেক সঞ্চয়ই দাবিহীন অবস্থায় পড়ে রইল? ভারতের আর্থিক ব্যবস্থার এক গুরুত্বপূর্ণ অথচ অবহেলিত দিক হল– দাবিহীন আমানত। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি! সরকারি তথ্যানুসারে, ৩০ জুন ২০২৫ পর্যন্ত ব্যাঙ্কগুলিতে দাবিহীন আমানতের পরিমাণ ছিল ৬৭,০০০ কোটি টাকারও বেশি, এবং ‘কর্মচারী ভবিষ্যনিধি তহবিল’-এর (‘ইপিএফ’) অকার্যকর অ্যাকাউন্টগুলি ২০২৩-’২৪ সালে বেড়ে ৮,৫০৫ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। ভারতীয় বিমা নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়ন কর্তৃপক্ষর (‘আইআরডিএআই’) বার্ষিক প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২৩-’২৪ সালের শুরুতে জীবনবিমাকারীদের দাবিহীন আমানতের
পরিমাণ ছিল ২২,২৩৭ কোটি টাকা। এগুলি কেবল পরিসংখ্যান নয়, বরং এক গভীর সামাজিক ও মানসিক প্রবণতার প্রতিফলন। দীর্ঘ দিন ধরে সঞ্চিত এই অর্থের ‘প্রকৃত’ মালিকরা হয় মারা গিয়েছে, নয়তো তাদের উত্তরাধিকারীরা জানে না, কোথায় সেই অর্থ রয়েছে কিংবা কীভাবে তা দাবি করতে হয়। ফলে, একদিকে যেমন ব্যক্তিগত ক্ষতি হচ্ছে– অন্যদিকে দেশের অর্থনীতির ক্ষেত্রেও এটি একটি অস্বস্তিকর বাস্তবতা।
আমাদের সমাজে সঞ্চয়কে দীর্ঘ দিন ধরে নিরাপত্তার প্রতীক হিসাবে দেখা হয়। হঠাৎ বিপদ, বার্ধক্যজনিত খরচ, কিংবা সন্তানের ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা– এসব আশঙ্কা মানুষকে অর্থ জমাতে উদ্বুদ্ধ করে। কিন্তু প্রায়ই দেখা যায়, এই সঞ্চয়ের যথাযথ ব্যবহার হয় না। বহু মানুষ জীবনের আনন্দ উপভোগ না-করেই অতিরিক্ত সঞ্চয়ে মনোনিবেশ করে। এর নেপথ্যে কাজ করে এক ধরনের মানসিক ভয়– অর্থ একবার খরচ শুরু করলে ‘ফুরিয়ে’ যাবে। এই ‘ফুরিয়ে যাওয়ার’ ভয়ই শেষ পর্যন্ত বহু অর্থকে পরিণত করে দাবিহীন আমানতে।
সমস্যার মূলে রয়েছে আর্থিক শিক্ষার ঘাটতি। বর্তমানে, ভারতে সাধারণ সাক্ষরতার হার প্রায় ৮০ শতাংশ হলেও আর্থিক সাক্ষরতার হার মাত্র ২৪ শতাংশ। অর্থাৎ চারজন ভারতীয়র মধ্যে মাত্র একজন সঞ্চয়, বিনিয়োগ, ঋণ বা বাজেট সম্পর্কে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম। বাকি তিনজন প্রায় সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে অভ্যাস, ভয় বা অন্যের পরামর্শের উপর। এর ফলে কখনও অপ্রয়োজনীয় সঞ্চয়, কখনও ভুল বিনিয়োগ, আবার কখনও সেগুলোই দাবিহীন অর্থে পরিণত হয়। এই অভাব আমাদের সমাজকে কেবল ব্যক্তিগত নয়, সমষ্টিগতভাবে আর্থিক ক্ষতির মুখে ঠেলে দেয়।
এই সমস্যার সমাধানে ‘রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া’ ২০২৩ সালে চালু করেছে ‘UDGAM’ (‘Unclaimed Deposits Gateway to Access Information’) পোর্টাল। এর মাধ্যমে নাম, জন্মতারিখ ও ব্যাঙ্কের নাম প্রবেশ করালেই জানা যায় কোনও দাবিহীন আমানত রয়েছে কি না। চালুর মাত্র ৫ মাসে প্রায় ২০ লক্ষ দাবিহীন আমানত শনাক্ত হয়। এ থেকে বোঝা যায়, সচেতনতা বাড়লে সমস্যার সমাধান অসম্ভব নয়। ‘UDGAM’-এর মাধ্যমে অর্থ ফেরত পাওয়ার প্রক্রিয়াও তুলনামূলক সহজ। আমানতকারী জীবিত থাকলে কেবল পরিচয়পত্র ও অ্যাকাউন্ট তথ্য দিলেই অর্থ ফেরত পাওয়া যায়। প্রয়াত আমানতকারীর ক্ষেত্রে ‘নমিনি’ বা ‘বৈধ’ উত্তরাধিকারী প্রয়োজনীয় নথি দেখিয়ে দাবি করতে পারেন। এমনকী, অর্থ যদি আরবিআইয়ের ‘Depositor Education and Awareness Fund’-এ চলে গিয়েও থাকে, তাহলেও নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় তা ফেরত পাওয়া সম্ভব।
কিন্তু শুধু প্রযুক্তিগত সমাধান-ই যথেষ্ট নয়। সমস্যার মূলে রয়েছে অদক্ষ অর্থব্যবস্থা ও সচেতনতার অভাব। বিশেষজ্ঞদের মতে, অতিরিক্ত সঞ্চয়ের চেয়ে বেশি জরুরি হল, পরিকল্পিত ও বিচক্ষণ বিনিয়োগ। আয়ের একটি অংশ সঞ্চয় রেখে, বাকিটা যদি বিভিন্ন বিনিয়োগ মাধ্যমে ব্যবহার করা হয়, তবে ছোট অঙ্ক থেকেও বড় লক্ষ্য পূরণ সম্ভব। সন্তানের পড়াশোনা, স্বাস্থ্য খরচ বা অবসর– সবক্ষেত্রেই এই পরিকল্পিত বিনিয়োগ কার্যকর হতে পারে।
বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত দেশে ইতিমধ্যেই আর্থিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ২১টি রাজ্যে স্কুল স্তর থেকেই আর্থিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক। অস্ট্রেলিয়ার পাঠ্যক্রমেও এটি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ফলে, নাগরিকরা ছোটবেলা থেকেই অর্থব্যবস্থার মৌলিক দিক সম্পর্কে অবহিত হয়ে যায়। অথচ, ভারতে যেখানে আর্থিক সাক্ষরতার হার মাত্র ২৪ শতাংশ, সেখানে এখনও এই বিষয়ে কার্যকর কোনও উদ্যোগ নেই। শিক্ষার অভাবই আমাদের হয় অপ্রয়োজনীয় সঞ্চয়ের দিকে ঠেলে দেয়, নয়তো বিপদের সময় ঋণের ফঁাদে ফেলে।
কোভিড মহামারী দেখিয়ে দিয়েছে, সঠিক আর্থিক পরিকল্পনা ছাড়া বিপর্যয় মোকাবিলা কতটা কঠিন। অসংখ্য মানুষ চাকরি হারিয়ে ঋণের জালে জড়িয়েছে, আবার বহু পরিবার প্রধান উপার্জনকারীকে হারিয়ে আর্থিক সংকটে পড়েছে। যদি মৌলিক আর্থিক শিক্ষা আগেই দেওয়া হত, তবে অন্তত কিছুটা ক্ষতি রোধ করা যেত। অর্থাৎ আর্থিক সচেতনতা শুধু ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য নয়, বরং জাতীয় অর্থনীতির স্থিতিশীলতার জন্যও অপরিহার্য।
সবশেষে বলা যায়, দাবিহীন আমানতের সমস্যার মূলে কেবল মিতব্যয়িতা নয়, বরং রয়েছে আর্থিক অজ্ঞতা এবং শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটি। আরবিআইয়ের UDGAM পোর্টাল সমস্যার সমাধানে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ হলেও এটি সমস্যার মূলে আঘাত হানতে পারবে না। প্রয়োজন স্কুলস্তর থেকেই আর্থিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা এবং নাগরিকদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি। নতুন শিক্ষানীতিতে ইন্ডিয়ান নলেজ সিস্টেম নিয়ে মাতামাতি হচ্ছে ভাল কথা। কিন্তু আর্থিক সাক্ষরতার দিকটি নিয়ে একটু ভাবলে বোধহয় বাস্তব জীবনে বেশি কাজে লাগত।
প্রশ্নটি তাই নতুন করে ভাবার– টাকা কি কেবল ব্যাঙ্কে জমিয়ে রাখার জন্য, না, জীবনের মান উন্নত করার জন্য? আমানতের অঙ্ক যতই বড় হোক না কেন, আসল সম্পদ হল জীবনের অভিজ্ঞতা, নিরাপত্তা ও সঠিক সিদ্ধান্ত। সঞ্চয় তখনই অর্থবহ, যখন তা জীবনের আনন্দ ও ভবিষ্যতের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। তাই জীবনের শেষ পর্যন্ত, অর্থ জমে থাকুক ব্যাঙ্কে নয়– থাকুক জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের সঠিক ব্যবহারে।
(মতামত নিজস্ব)
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.