মুখ্যমন্ত্রীর উদে্যাগে ‘অপরাজিতা নারী ও শিশু বিল ২০২৪’ পাশ হয়েছিল রাজ্য বিধানসভায়। ধর্ষণের কঠোরতম সাজার বিধান ছিল বিলে। কিন্তু পাশে দঁাড়ায়নি কেন্দ্রীয় সরকার। এখনও অনুমোদন মেলেনি। দেরি না-করে ধর্ষককে কঠোরতম শাস্তির বিলে সম্মতি দিক দিল্লি। তারা চুপ করে থাকতে পারে না। লিখছেন কিংশুক প্রামাণিক।
অার জি কর মেডিকেল কলেজ এবং কসবা ল’ কলেজের পরিস্থিতি এক নয়। অার জি করে হতভাগ্য চিকিৎসককে ধর্ষণ করে হত্যা করার পর অাসামি ধরা পড়লেও– অসত্য তথ্য পরিকল্পিতভাবে ছড়িয়ে দিয়ে সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টি করেন কিছু জুনিয়র ডাক্তার। গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে লোকসভা ভোটে পরাজিত বিরোধী শিবির। ঠিক সেই সময় বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনকে সামনে রেখে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার ফেলার গভীর ষড়যন্ত্র হয়। যদিও তা সফল হয়নি।
কসবায় ‘মিথ্যা’ ন্যারেটিভের সুযোগ নেই। নির্যাতিতা জীবিত। তিনি নিজে অভিযোগ জানিয়েছেন পুলিশের কাছে। নাম বলে দিয়েছেন ধর্ষক এবং তার সহকারীদের। তৎক্ষণাৎ তাদের গ্রেফতার করেছে কলকাতা পুলিশ। গ্রেফতার হয়েছে সিকিউরিটি গার্ডও। বয়ান ও ঘটনা মিলে গিয়েছে হুবহু। সংবাদমাধ্যম জানার অাগেই অভিযুক্তরা জালে।
ফলে ঘটনা নিয়ে ট্রায়ালের সুযোগ পায়নি মিডিয়া। ধর্ষণ এক আদিম অভিশাপ। মানব সভ্যতা উন্নতির শিখরে পৌঁছে গেলেও সমাজ এই রোগ থেকে মুক্ত হয়নি। ধর্ষকের কোনও জাত-ধর্ম হয় না। এ এক প্রবৃত্তি। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে লালসার নেশায় মত্ত ধর্ষকের স্বাভাবিক জ্ঞান লোপ পায়। কার্যসিদ্ধির পর তারা বুঝতে পারে ভুল হয়ে গিয়েছে। অাবার সমাজে লুকিয়ে অাছে এক শ্রেণির ঠান্ডা মাথার শয়তান। যারা সু়যোগের অপেক্ষায় থাকে। অসহায়ের অার্তনাদ তাদের কানে প্রবেশ করে না।
অার জি করের সঞ্জয় অথবা কসবার মনোজিৎ একই জাতের অপরাধী। যদিও মনোজিৎ তার সাংগাঠনিক সহকর্মীর সঙ্গে সহবাস করতে চেয়েছিল, রাজি না হওয়ায় ধর্ষণ করেছে। তাকে অাঘাত করলেও সাহস পায়নি হত্যা করার। সঞ্জয় কিন্তু পাশবিক অত্যাচারের পর চিকিৎসককে খুন করে প্রমাণ লোপাটের চেষ্টা করে। এর মানে এই নয় মনোজিৎ মিশ্র ধোয়া তুলসীপাতা। তার আরও নানা কুকীর্তি সামনে অাসছে।
কসবা কাণ্ডের উল্লেখযোগ্য দিক হল, নির্যাতিতা ও অভিযুক্ত নিত্যদিন একসঙ্গে ছাত্র সংগঠনের কাজ করত। তারপরও কেন অত্যাচারের স্বীকার হল মেয়েটি তা নিয়েই তদন্ত করছে গোয়েন্দারা। অভিযুক্ত মনোজিতের অনেকের সঙ্গে ছবি রয়েছে। রাজনীতিতে এটা হতেই পারে। নেতাদের পাশে দঁাড়িয়ে ছবি তোলা একটা অভ্যাস। ফেসবুকে নিজেকে জাহির করা। মোবাইল-যুগে এটা শতগুণ বেড়েছে। এর মানে এই নয় সে নেতার অনুগামী বা তঁার লোক। ফলে মনোজিতের কোনও পরিচয়ই রক্ষাকবচ হয়নি। গ্রেফতার করা হয়েছে অভিযোগ পেয়েই।
মানুষের ভিতরটা কেমন তা বাইরে থেকে বিচার করা যায় না। অপরাধপ্রবণতা সুপ্ত। দেখতে হবে অপরাধ করার পরও সে পার পেয়ে গেল কি না। সেটা সমাজের জন্য বিপজ্জনক। কসবা কাণ্ডে প্রশাসনের ভূমিকা খুবই সন্তোষজনক। অভিযোগ পাওয়ার পর কালক্ষেপ করা হয়নি। ‘জিরো টলারেন্স’-এর মতোই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। অভিযুক্তদের বঁাচাতে কোনও প্রভাবশালী মদত ছিল না। থাকলেও পাত্তা পায়নি।
অর্থাৎ অপরাধের কিনারা প্রায় হয়ে গিয়েছে। এখন তদন্তে বাকি কাজগুলি শেষের পর অাইনি প্রক্রিয়া শুরু হবে। পরিবার কলকাতা পুলিশের কাজে সন্তুষ্ট। সিবিঅাই তদন্তের নামে রাজনীতির ট্রায়ালে তারা রাজি হয়নি। পক্ষপাতদুষ্ট জাতীয় মহিলা কমিশনকেও পাত্তা দেয়নি। কলকাতা পুলিশের তদন্তের মাধ্যমে অভিযুক্তদের সর্বোচ্চ সাজা চেয়েছে। অাদালত সেটা বিবেচনা করবে।
এই পর্বের পর তদন্তপ্রক্রিয়া নিয়ে কিছু বলার থাকে না। তবে বিরোধীরা এটা বলতেই পারে কলেজের ভিতর ছাত্রীদের নিরাপত্তা কতটা। তারা পথেও নামতে পারে। কিন্তু একই সঙ্গে এই প্রশ্নেরও মুখোমুুখি হতে হবে তাদের, যখন তারা ক্ষমতায় ছিল, কী করেছে। বানতলায় ডা. অনিতা দেওয়ান থেকে, ফুলিয়ার মূক ও বধির তরুণী ফেলানি বসাক, শত-শত খুন ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৩৪ বছরে।
বিজেপিশাসিত রাজে্য ধর্ষণের ঘটনা অহরহ ঘটে। কিন্তু তার বিচার কোথায়? কুস্তিগির সাক্ষীর উপর যিনি নির্যাতন করলেন তঁাকে গ্রেফতার করা তো দূরের কথা, উল্টে প্রোমোশন দেওয়া হয়েছে তঁাকে! বিচায় পায়নি হাথরাস, উন্নাও। মণিপুরে বিবস্ত্র করে দুই মহিলাকে ঘুরিয়েছিল যারা, তাদের বিচার হয়নি। অামাদের রাজে্য যে মহারাজ ধর্ষণে অভিযুক্ত, তঁাকে দেওয়া হয়েছে ‘পদ্মশ্রী’! এই লেখা যখন লিখছি টেলিভিশনে দেখছি– মধ্যপ্রদেশে হাসপাতালের মধে্য এক নার্সকে কুপিয়ে মারছে অাততায়ী।
বাংলার পরিস্থিতি মোটেই মধ্যপ্রদেশ, মণিপুরের মতো নয়। অার জি করেও পুলিশ ধর্ষককে দ্রুত গ্রেপ্তার করেছিল। যেহেতু হতভাগ্য ডাক্তার তরুণীটি পাশবিক অত্যাচারের পর মারা যান, সেই জন্য রাজনীতির খেলা শুরু হয়। গণধর্ষণ, দেড়শো গ্রাম বীর্য অাবিষ্কারের ভুয়া তথ্য সামনে অানা হয়। মিথ্যার উপর দঁাড়িয়ে যে তিন-চারজন জুনিয়র ডাক্তার অান্দোলনের মুখ হয়েছিলেন, তঁাদের পরিণতি কী হয়েছে সবাই দেখেছে। তঁারা ডাকলে অার মশা-মাছিও সাড়া দেয় না। অাপাতত তঁারা অার জি কর থেকে বহু দূরে।
তঁাদের জন্যই বিকৃতকাম যুবক সঞ্জয় নিজেকে ‘নির্দোষ’ দাবি করেছিল। সিবিঅাইয়ের হাতে তদন্ত যাওয়ার পর তারা চাপের মুখে হাসপাতালের প্রাক্তন অধ্যক্ষ, টালা থানার ওসিকে গ্রেফতার করে। কিন্তু ধর্ষণের সঙ্গে তঁাদের যুক্ত থাকার কোনও তথ্য খুজে পায়নি। অার্থিক অনিয়মের তথ্য ছাড়া কিছু না-পাওয়া যাওয়ায় অচিরেই তঁারা ছাড়া পান। কলকাতা পুলিশের সাফল্যকে স্বীকৃতি দিয়ে সিবিঅাইও জানিয়ে দেয়, দোষী একমাত্র সঞ্জয়ই।
অার জি কর অান্দোলন সমাজে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। বহু মানুষ সহকর্মীদের জন্য জুনিয়র ডাক্তারদের অান্দোলনকে সমর্থন করেছিলেন। রাতদখল কর্মসূচিতে ছিল স্বতঃস্ফূর্ততা। কিন্তু মিথ্যার উপর দঁাড়ানো কোনও অান্দোলন সফল হতে পারে না। হয়ওনি। কিন্তু কে এই মনোজিৎ মিশ্র? এত বঁাদরামি করার সুযোগ সে পেল কী করে? এত দুঃসাহস হয় কী করে? কতটা জানে তৃণমূলের ইতিহাস, কোন সন্ধিক্ষণে দলের জন্ম? কতটা জানে সর্বোচ্চ নেত্রীর ত্যাগস্বীকার? বা তঁাকে কত মূল্য তাকে দিতে হয়েছে সারা জীবন? কিছুই জানে না। ক্ষমতার স্রোতে এসে নিজেকে কেউকেটা ভেবে ফেলেছিল। নিজের লালসা মেটাতে দলের বদনাম করল।
এই বেনোজলেরা জানেই না, মমতা বন্দে্যাপাধ্যায় হয়তো মরেই যেতেন হাজরা মোড় অথবা গার্ডেনরিচে অথবা কোনও গোপন ষড়যন্ত্রে। মমতা যখন নতুন দল করেন তখন তঁার সামনে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ।
কংগ্রেস, সিপিএম, বিজেপি। তিন দলেরই সর্বভারতীয় পরিচয়। তাদের বিরুদ্ধে গত ২৬ বছর ধরে লড়াই করে এই জায়গায় এসেছেন মমতা। এত বড় দল, এত নেতা, এত স্তরের সভাপতি, এত মন্ত্রী, এক সাংসদ, এত বিধায়ক, এত চেয়ারম্যান সব মমতার জন্য। তঁার নাম, তঁার কাজ, তঁার মুখ দেখেই বাংলার মানুষ তৃণমূ্ল প্রার্থীদের ভোট দেয়। ১৪ বছরের সরকার। বিপুল সামাজিক কাজ। তাতেই ভোটে পরপর অভাবনীয় জয়। সকাল থেকে রাত মুখ্যমন্ত্রী পরিশ্রমী। মানবিক, দরদি মন। মমতা সতি্য সত্যি অপ্রতিদ্বন্দ্বী। সেই সাফল্যের ইমারতে অঁাচড় দেবে এই কুলাঙ্গার মনোজিৎরা! এত সাহস! ক্ষমতার সরণি বেয়ে এরা এসেছে। অাবার চলে যাবে। সময় এসেছে এদের চিহ্নিত করে তাড়িয়ে দেওয়ার।
অতএব একটা সঞ্জয়, একটা মনোজিৎকে দিয়ে মমতার জমানাকে বিচার করা যাবে না। দেখতে হবে সরকার অপরাধের বিরুদ্ধে কতটা সক্রিয়। তথ্য বলছে, গত ১৪ বছরে যতগুলি ধর্ষণের ঘটনা রাজে্য ঘটেছে প্রায় সব কটার কিনারা করেছে পুলিশ। দ্রুত বিচার শেষ করে সাজা দিতে পেরেছে। ফঁাসির অাদেশ হয়েছে। অপারাধী পার পায়নি। এই প্রক্রিয়া অারও দ্রুততর করতেই মুখ্যমন্ত্রীর উদে্যাগে ‘অপরাজিতা নারী ও শিশু বিল ২০২৪’ পাস হয়েছিল রাজ্য বিধানসভায়। ধর্ষণের কঠোরতম সাজার বিধান ছিল বিলে। কিন্তু পাশে দঁাড়ায়নি কেন্দ্রীয় সরকার। এখনও অনুমোদন মেলেনি। বিল ফেলে রাখা হয়েছে। এই এক সমস্যা। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় রাজে্যর অধিকারে বারবার হস্তক্ষেপ। রাজনৈতিক কারণে ভাল উদে্যাগও মাঠে মারা যায়। কসবা কাণ্ডের পর অাবার দাবি উঠবে। জোরালো দাবি। দেরি না-করে ধর্ষককে কঠোরতম শাস্তির বিলে সম্মতি দিক দিল্লি। তারা চুপ করে থাকতে পারে না।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.