ফাইল ছবি
মোহন ভাগবত বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বকে ৭৫ বছরে ‘অবসর’ নিতে পরামর্শ দিতে বলেছেন। এই মন্তব্যে কুঁচকে ওঠা ভুরুর সংখ্যা নেহাত কম নয়। নরেন্দ্র মোদি ৭৫ বছরে পা রাখতে চলেছেন। তাহলে কি তাঁকেও সরে যেতে হবে মোহন-পরামর্শ মেনে? শীর্ষ নেতৃত্বের দায়িত্ব ন্যস্ত কার কাঁধে? লিখছেন রাজদীপ সরদেশাই।
কংগ্রেসের যা কিছু অভ্যন্তরীণ লড়াই তা হয় হাটের মাঝে, জনসাধারণের মনোযোগ ও অবগতির বৃত্তে। বিজেপিতে বিষয়টি একেবারে তেমন না। তাদের যা কিছু দলগত বিরোধ, সবই ঘটে বন্ধ দরজার ওপারে। একজন বরিষ্ঠ কংগ্রেস নেতা দুঃখ করে বলছিলেন। ভেবে দেখলে, কথাটি কিছুমাত্র ভুল নয়। কেরলে শশী থারুরের সঙ্গে কংগ্রেস শীর্ষনেতৃত্বের আদায়-কঁাচকলায় সম্পর্কের কথা ভাবলে, বা কর্নাটকে সিদ্ধারামাইয়া বনাম শিবকুমারের তু-তু ম্যায়-ম্যায় চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়– এই দু’টি দলের সদস্যদের আচরণ কতখানি ভিন্ন মেরুর। কংগ্রেসের গৃহযুদ্ধ যেন আড়ালের তোয়াক্কা করে না। সবই হচ্ছে খুল্লমখুল্লা। অথচ বিজেপিতে, দলগত বিরোধের অঁাচড়টুকু অবধি বাইরে থেকে দেখতে পাবেন না। তার মানে কি সেখানে মতানৈক্য নেই, শিবিরের বিপরীতে পালটা শিবির নেই? যথেষ্ট রয়েছে। কিন্তু উত্তরপ্রদেশে যোগী আদিত্যনাথ বনাম অমিত শাহ, বা ভারতীয় জনতা পার্টি বনাম রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের দ্বন্দ্ব কখনও খবরের শিরোনাম হয়নি। আকচাআকচি যা হওয়ার সব মাইকের আওতার বাইরে।
যা শোনা উচিত নয়, এমন কিছু আপনার তাই কানেই পৌঁছবে না। নৈঃশব্দ্যের পুরু চাদরে ঘেরা থাকবে অসংগতি ও অসন্তোষের রেখাবলি। মোহন ভাগবত বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বকে ৭৫ বছরে ‘অবসর’ নিতে পরামর্শ দিতে বলেছেন। এই মন্তব্যে কুঁচকে ওঠা ভুরুর সংখ্যা নেহাত কম নয়। নরেন্দ্র মোদি ৭৫ বছরে পা রাখতে চলেছেন। তাহলে কি তঁাকেও সরে যেতে হবে মোহন-পরামর্শ মেনে? মজার কথা, সেপ্টেম্বরে মোহন ভাগবতও পা রাখবেন ৭৫ বছরের জংশনে। বিরোধীরা ইতোমধ্যে মোহন ভাগবতের মন্তব্য লুফে নিয়ে বলতে শুরু করেছে– সংঘ পরিবার আসলে বিজেপির অভ্যন্তরীণ কাঠামো বিদীর্ণ করে নতুন নেতা তুলে আনতে আগ্রহী!
‘মোদির পরে তাহলে কে?’ প্রশ্নটি শুনতে লাগে অনেকটা– ‘নেহরুর পরে তাহলে কে?’ এরকম।
যতই চর্চা হোক, বাস্তবের অভিজ্ঞতাসঞ্জাত উপলব্ধি বলে, নরেন্দ্র মোদি আপাতত কোথাও যাচ্ছেন না, প্রধানমন্ত্রিত্ব ছেড়ে দেওয়ার ত্বরায় ভুগছেনও না। ক্ষমতায় থেকে যাওয়ার যাবতীয় স্পৃহা এখনও সমূলে রয়েছে তঁার অন্তরে। একটি ছোট গল্প বলি। যুবা বয়সে মোদি আহমেদাবাদে তঁার কাকার ক্যান্টিনে কাজ করতেন। ভাটনগর থেকে রাষ্ট্রীয় পরিবহণের বাস ধরতেন, আর বাস থেকে নামার সময় সঙ্গের ঝোলা বা ব্যাগ বা ওরকম যা থাকত, সেসব বাসের সিটেই রেখে আসতেন, এটি আসলে আসন সংরক্ষণের পন্থা, কেননা কাজের পরে
ও-ই বাসে করেই আহমেদাবাদ থেকে তিনি ফিরবেন যে বাড়িতে! এ গল্প কেন বললাম? বললাম, এ-কথা প্রতিষ্ঠা করতে যে, মোদি যদি একবার চেয়ার দখল করে নেন, তাহলে কারও পক্ষে তঁাকে কুর্সিচু্যত করা সম্ভব নয়। গল্পটির প্রামাণিকতা প্রশ্নাতীত হয়তো নয়, কেননা গুজরাতের একজন কংগ্রেস নেতার থেকে এটি সংগ্রহ করা। তবে, মোদির মতো ‘লার্দার দ্যান লাইফ’ চরিত্রের এটি একটি বৈশিষ্ট্য যে, এঁরা নিজের নিয়তির উপর সর্বময় কর্তৃত্ব স্থাপন করতে চান। পিছনের সিটে বসতেই চান না, অবসর নেওয়া তো দূরস্থান।
সংঘ পরিবারের কর্তাব্যক্তিরা সাধারণত খুবই মেপে কথা বলেন, মন্তব্য করার আগে দশবার ভাবেন। তবে কেন মোহন ভাগবত ৭৫ বছরের সময়সীমার কথা উল্লেখ করলেন? বস্তুত, বিজেপির মধ্যে প্রজন্মকেন্দ্রিক পরিবর্তন আনতে সংঘ পরিবার অনেক দিন ধরেই আগ্রহী। বিজেপি ও সংঘের মতমালিন্যের কথা পুরুষ্টুভাবে সামনে আসে ’২৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের সময়। ‘দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’-কে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে বিজেপির সভাপতি জে. পি. নাড্ডা বলেন, বিজেপি এখন শক্তসমর্থ ও স্বাবলম্বী হয়েছে। এক সময় সংঘ পরিবারের সান্নিধ্যে প্রবৃদ্ধি অর্জন করলেও– এখন বিজেপি এককভাবে পারে নিজেরটা নিজে বুঝে নিতে। সেই মন্তব্য ঘিরে বলা বাহুল্য সংঘ পরিবারের অভ্যন্তরে বিরাট শোরগোল পড়েছিল। সম্ভবত তা আদতে ছিল আরএসএসের অন্দরে একটি বৃহত্তর অস্বস্তির প্রতিফলন যা একটি বিশেষ রাজনৈতিক বাস্তুতন্ত্রকে ঘিরে আবর্তিত– তা হল, মোদিকে ‘ঈশ্বরতুল্য’ মনে করা।
গত সেপ্টেম্বরে, ভাগবত মনের ক্ষোভ খানিক উগরে দিয়ে বলেন, “কাজের মাধ্যমে, প্রত্যেকেই পূজনীয় বা শ্রদ্ধার জায়গা অর্জন করতে পারে। কিন্তু কোনও এক ব্যক্তি সেই স্তরে পৌঁছেছে কি না তা নির্ধারণ করবে অন্যরা। কেউ নিজে স্বেচ্ছাচার করে জাহির করতে পারে না– ‘আমি ঈশ্বর’।” এই মন্তবে্য প্রধানমন্ত্রীর এককালে নিজেকে স্বঘোষিত ‘অ-জৈবিক ঈশ্বর’ রূপে উপস্থাপন করার উল্লেখটির প্রতি খোঁচা স্পষ্ট।
আরএসএসের অন্দরমহলে কয়েকটি সমষ্টির মধে্য প্রবল দ্বিমত ও অসন্তোষ থাকা সত্ত্বেও– দল হিসাবে তারা জানে– রাজনৈতিক ও আদর্শগত আধিপত্য ধরে রাখার ক্ষেত্রে মোদি-ই আপাতত সেরা বাজি। ‘সিএসডিএস’-এর ২০২৪ সালের নির্বাচন-পরবর্তী সমীক্ষা অনুসারে, নরেন্দ্র মোদির জনপ্রিয়তা এখনও বিজেপির সার্বিক জনপ্রিয়তার চেয়ে অনেক উপরে। বিজেপির প্রতি চারজন ভোটারের মধ্যে একজনের মত– তিনি কেবল প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বের কারণেই বিজেপিকে ভোট দিয়েছেন। ‘মোদি ফ্যাক্টর’ সরিয়ে ফেললে, রাজনৈতিকভাবে, বিজেপির দুর্বলতা দিনের আলোর মতোই পরিষ্কার। বলা বাহুল্য, তিনি শুধুমাত্র ‘ব্র্যান্ড হিন্দুত্ব’-র রাজনৈতিক প্রতীক নন, সর্বাধিনায়ক ও দলের মুখ্য তারকা।
এক অর্থে, আমরা এমন এক ‘মোদিমোহ’-য় রয়েছি যেখানে ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠরা ব্যক্তিপুজোয় ডুবে। অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণ থেকে শুরু করে জম্মু-কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা প্রত্যাহার, এমনকী বিজেপিশাসিত নানা রাজ্যে অভিন্ন নাগরিক বিধি প্রণয়নের প্রচেষ্টা– অস্বীকার করার উপায় নেই– মোদি সরকারই আরএসএসের মূল অ্যাজেন্ডার বাস্তবায়ন নিশ্চিত করেছে। বলা যেতে পারে, বিজেপির রাজনৈতিক আধিপত্যই আরএস-কে দীর্ঘ দিনের লালিত মনোবাঞ্ছা সাকার করার সুযোগ করে দিয়েছে– বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে সাংস্কৃতিক মঞ্চ– এমনকী, সংবাদমাধ্যমেও আরএসএস যে প্রচারের আলো দেখল মোদির হাত ধরে– তা অভূতপূর্ব।
ওদিকে, সংঘ পরিবারের মধ্যে ক্ষমতার গতিশীলতায় স্পষ্ট পরিবর্তন এসেছে। ১০০ বছরের অস্তিত্বের বেশির ভাগ সময়কাল যাবৎ আরএসএস ধামা ধরে এসেছে গেরুয়া-ভ্রাতৃত্বের অবিসংবাদিত আদর্শে। মোদি-জমানায় সেই নিয়মে কিছু বদল এসেছে। তবে বিজেপি এখনও তৃণমূল স্তরে তাদের কর্মী-সদস্য বাছাই করার সময় আরএসএসের দ্বারস্থ হয়, কিন্তু ‘প্রাইমাস ইন্টার প্যারেস’ মোহন ভাগবত নন– শীর্ষে রাজ করছেন একজনই– একদা আরএসএস প্রচারক থেকে রাজনীতিবিদ তথা বর্তমান প্রধামন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
একটা সময় ছিল, যখন আরএসএস নেতৃত্ব বারবার জোট সরকার নেতৃত্বাধীন বৃদ্ধ প্রধানমন্ত্রীর উপর আক্রমণ শানাত– বাজপেয়ী আমলের সেই উল্লেখযোগ্য ট্রেন্ডেরও ইতি ঘটেছে। মনে করে দেখুন, তৎকালীন আরএসএস সংঘচালক কে. এস. সুদর্শন কীভাবে প্রকাশ্যে বাজপেয়ীর সিদ্ধান্ত অবজ্ঞা করেছিলেন, এমনকী তঁাকে পদত্যাগ করতেও বলেছিলেন। তঁার এই সমালোচনার জেরেই বাজপেয়ী তঁার বিখ্যাত ‘না টায়ার্ড, না রিটায়ার্ড’ মন্তব্যটি করেন।
ভাগবত নিজেও বিলক্ষণ জানেন সরাসরি মোদিকে চ্যালেঞ্জ করার ক্ষমতা তঁার নেই। তিনি বড়জোর লক্ষ্মণরেখা টানতে পারেন, মোদি-শাহ জুটির স্বৈরাচারী নেতৃত্বে। ‘অবসর নিন’ লিখে বেলুন তিনি হাওয়ায় ভাসাতেই পারেন, দাবার প্রথম দান হিসাবে, কিন্তু ‘চেকমেট’ করার মুরোদ তঁার নেই।
এই মোদি-শাহ জুটিই ২০১৫ সালে ‘মার্গদর্শক মণ্ডল’ চালু করেছিল, যার মূল লক্ষ্য, ৭৫ বছরেরও ঊর্ধে যে সমস্ত প্রবীণ নেতা রয়েছেন, তঁাদের দল থেকে সরে যেতে না-বলে একটি বিশেষ ‘প্রতীকী মণ্ডলী’ তৈরি করা। কেন ‘প্রতীকী’? কারণ তঁারা কেউ-ই দলের কোনও সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপ করতে পারবেন না। সেই তালিকায় রয়েছেন বর্ষীয়ান লালকৃষ্ণ আদবানি, মুরলীমনোহর যোশির মতো বিজেপি নেতা। আরএসএস বুঝে গিয়েছে, ৭৫ ছঁুয়ে ফেললেও মোদির উপর ‘মার্গদর্শক’-এর ‘সাপও মরল লাঠিও ভাঙল না’ চাল খাটানো যাবে না। তবুও তারা মনেপ্রাণে চায় মোদি-পরবর্তী জমানায় বিজেপির তরুণ নেতৃত্বের পথ যাতে মসৃণ, নিশ্চিত ও আয়াসহীন হয়। তাই বিজেপি ‘কৌন বনেগা বিজেপি সভাপতি’ বলে যতই উদাত্ত কণ্ঠ ছাড়ুক না কেন, আখেরে ক্ষমতার বাতাস কোন পালে হাওয়া দিচ্ছে– তা আর জানতে কারও বাকি নেই।
পুনশ্চ মজার ব্যাপার হল, ভাগবত যে-সপ্তাহে অবসর গ্রহণের পরামর্শ দিচ্ছিলেন, সেই সপ্তাহেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ আহমেদাবাদে একদল মহিলা কৃষককে বলেন, ‘আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি অবসরের পরের জীবনটুকু, বেদ-উপনিষদ ও প্রাকৃতিক কৃষিকাজ নিয়েই থাকব..’। এমন একজন ক্ষমতালোভী, দূরদর্শী রাজনীতিক অবসরের পর কৃষিকাজে মনোনিবেশ করবেন? একটু কেমন বাড়াবাড়ি ঠেকছে না! গুজরাতের একনম্বর জুটি যখন নিরন্তর কাঠখড় পুড়িয়ে গান্ধীনগর থেকে দিল্লি অবধি নিরঙ্কুশ ক্ষমতায় সমৃদ্ধ হয়েছেন– এত সহজে হাল ছেড়ে দেওয়ার মানুষ তঁারা নন। মোদি-শাহ রাজনীতির জগতে বয়স কেবল সংখ্যামাত্র।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.