ঈশ্বরচন্দ্র প্রবর্তিত বিধবা বিবাহ সম্পর্কিত আইনের বয়স ২০০ বছর। সমাজ যে-সময়ে বিধবাদের অশুভ জ্ঞান করে জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করতে উদ্যত হয়, তখন সমান্তরালে, নীরবে ও নিঃসংকোচে আদিবাসী সমাজ নারীর দ্বিতীয় জীবনের অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়ে এসেছে– শতাব্দীর পর শতাব্দী। লিখছেন অভিমন্যু মাহাত।
‘ইতিহাস’ বলে আমরা যা জানি, তার বাইরেও আছে আর-এক ইতিহাস– যেটা লেখা হয়নি, কাগজে ওঠেনি, পাঠ্যবইয়ে স্থান পায়নি। আদিবাসীদের সেই ইতিহাস এখনও মুখে-মুখে, গাছের পাতায়, নদীর স্রোতে, আর মাটির ঘ্রাণে লুকনো। তাদের আমরা ‘সভ্য’ সমাজের বাইরে রাখি। ‘কালো চামড়ার মানুষ’ বলে দূরত্ব বজায় রাখি। কিন্তু তাদের জীবনদর্শন, সমাজব্যবস্থা ও প্রাকৃতিক আধার বহু দিক থেকেই আধুনিক সমাজের তুলনায় অনেক বেশি পরিণত, মানবিক এবং বাস্তবধর্মী। কিন্তু তথাকথিত ‘এগিয়ে যাওয়া’ সমাজের চোখে তারা থেকে গিয়েছে শুধুই ‘অন্য’ কেউ– উপেক্ষিত, বঞ্চিত এবং ব্রাত্যজন।
হারিয়ে যেতে বসা আদিবাসী ইতিহাসের খোঁজে কেউ কি নামে? উত্তর আসে– না। অথচ জনজাতির জীবন ও প্রকৃতি মিশে আছে এক অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে, যেখানে সমাজ গঠিত হয়েছে সহাবস্থানের নীতিতে, আর চিন্তা গড়ে উঠেছে এক গভীর অন্তর্দৃষ্টিতে। যা এখনও ইতিহাসে অলিখিত।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর– প্রাতঃস্মরণীয়। বিদ্যাসাগর সময়ের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে দাঁড়িয়েছিলেন নারীর অধিকার, মানবিকতা ও সমাজ সংস্কারের পক্ষে। বিশেষ করে বিধবা বিবাহ প্রথার আইনি স্বীকৃতির পিছনে তঁার লড়াই ও অবদান ইতিহাসের পাতায় উজ্জ্বল। ১৮৫৬ সালের ১৬ জুলাই, বিদ্যাসাগরের আপ্রাণ চেষ্টায় ব্রিটিশ ভারত সরকার এক যুগান্তকারী আইন পাশ করে– হিন্দু বিধবা বিবাহ আইন। সেই বছর ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় প্রথম বিধবা বিবাহ। পাত্রী– কালীমতি দেবী। বর্ধমান জেলার এক ছোট্ট গ্রাম পলাশডাঙার অধিবাসী। মাত্র চার বছর বয়সে প্রথম বিয়ে, ছ’বছরেই বিধবা। দ্বিতীয় বিয়ের সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১০। পাত্র ছিলেন গোবরডাঙার শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন। সমাজের রোষে তিনি হয়ে উঠেছিলেন ‘অপরাধী’। এমনকী, নিজের পৈতৃক বাড়িতে ঢোকার অধিকার থেকেও তাঁকে বঞ্চিত করা হয়।
এখনকার আলোয় দাঁড়িয়ে ফিরে দেখলে, একটি প্রশ্ন আমাদের বিদ্ধ করবেই– বিদ্যাসাগরের এই সমাজ সংস্কারের ভাবনা কীভাবে এসেছিল? কীভাবে তিনি বুঝলেন, নারীরও আবার নতুন করে শুরু করার অধিকার আছে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজলে আমরা পৌঁছে যাই এমন এক সমাজের কাছে, যার অস্তিত্ব আমরা অনেক সময়ই উপেক্ষা করি– আদিবাসী সমাজ। হ্যাঁ, যে-সমাজে পুঁথিগত শিক্ষা নয়, অভিজ্ঞতা আর মানবিকতা দিয়েই জীবন চলে। যেখানে বিধবার চোখে সমাজ দুঃখ খোঁজে না, খোঁজে সম্ভাবনা। যেখানে একজন নারী, স্বামীর মৃত্যুর পরও, নতুন করে জীবন গড়ার অধিকার রাখে– সমাজের সম্মতিতে, আশীর্বাদে। বিদ্যাসাগরের ভাবনার আড়ালে ছিল এমন এক সমাজের নিঃশব্দ প্রেরণা, যাদের আমরা ‘প্রান্তিক’ বলে অবহেলা করি।
সাঁওতালদের বিধবা বিবাহ (‘সাঙ্গা বাপলা’) রীতি আদি সময় থেকে প্রবহমান। এই বিবাহে আত্মীয়স্বজন-কুটুমদের সঙ্গে সাক্ষী থাকে একটি সতেজ ফুল। এই ফুল দিয়েই যাবতীয় মাঙ্গলিক পর্ব। কুড়মি ও মুন্ডাদেরও রয়েছে ‘সাঙ্গা’ বিয়ে রীতি। অর্থাৎ, এই সমাজে আইন প্রণয়ন করে বিধবা বিবাহ প্রচলন করতে হয়নি। বিধবা বিবাহ আইনের বয়স ২০০ বছর। কিন্তু আদিবাসী সমাজে আদিকাল থেকে প্রচলিত বিধবা বিবাহ প্রথা। হিন্দু সমাজ যেখানে বিধবাকে অশুভ জ্ঞান করে জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করত, সেখানে একান্ত নীরবে, নিঃসংকোচে আদিবাসী সমাজ নারীর দ্বিতীয় জীবনের অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়ে এসেছে শতাব্দীর পর শতাব্দী।
আদিবাসী সমাজে বিধবা বিবাহ কোনও সংস্কার, কোনও আন্দোলনে প্রচলিত হয়নি। এ এক সহজ সামাজিক প্রক্রিয়া, স্বাভাবিক মানবিক প্রবাহ। সেখানে নারীর জীবনের গতি থেমে যায় না শুধুমাত্র ‘বিধবা’ শব্দে এসে। বরং সেই সমাজ নিজেই এগিয়ে আসে তার পাশে, পুনর্বিবাহের আয়োজন করে, নতুন জীবনের পথ খুলে দেয়। জনজাতিরা মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় অভ্যস্ত।
আধুনিক সভ্যতার রূপ ও রীতিনীতির ভিড়ে যেখানে নারীর অধিকার, সম্মান ও সমানাধিকারের জন্য এখনও সংগ্রাম চলছে, সেখানে ভারতের কিছু আদিবাসী সমাজে আদিকাল থেকেই নারীরা শ্রদ্ধার আসনে। এই সমাজে নারী শুধুই মা, কন্যা বা স্ত্রী নয়– তারা পরিবার, সম্পত্তি ও সংস্কৃতির উত্তরাধিকারী। মাতৃতান্ত্রিক আদিবাসী গোষ্ঠীগুলির জীবনে নারীর অবস্থান শুধুই সামাজিক নয়, বরং সাংস্কৃতিক এবং আধ্যাত্মিক মর্যাদায় পরিপূর্ণ। আদিবাসী সমাজে নারী মাথা উঁচু করে বঁাচে, নিজের
নাম-পরিচয় নিয়ে, আর সমাজ গড়ে তোলে মমতার বন্ধনে। ঈশ্বরচন্দ্রের জন্মস্থান মেদিনীপুরের বীরসিংহ গ্রামের চারপাশেই ছিল আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকা। শৈশব-কৈশোরে কিংবা পরবর্তী জীবনে, তঁার যাতায়াত ছিল সেসব গ্রামে। কথিত, একটি আদিবাসী গ্রামে রাত কাটাতে গিয়ে তিনি দেখেছিলেন দুই নর-নারীর বিবাহ অনুষ্ঠান। বিদ্যাসাগর খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, পাত্রীর পূর্বে বিবাহ হয়েছিল। তার স্বামী অকালপ্রয়াত। অর্থাৎ, একটি বিধবা নারীর পুনর্বিবাহ অনুষ্ঠানে বিদ্যাসাগর সাক্ষী ছিলেন। তিনি নিজ-চোখে দেখেছেন– আদিবাসী নারী কীভাবে স্বামীর মৃত্যুর পরও নতুন করে জীবন শুরু করছে, কোনও তাচ্ছিল্য, কোনও সামাজিক বাধা ছাড়াই। সে-ই দেখা, সে-ই উপলব্ধি কি তাঁকে প্রভাবিত করেনি? এ প্রশ্নের জবাব হয়তো ঈশ্বরচন্দ্র কোনও দিন লেখেননি।
তাঁর কোনও রচনায় আদিবাসীদের এই অনুপ্রেরণার কথা স্পষ্টভাবে নেই। কিন্তু ইতিহাসের পাতায় কিছু কথা লেখা না থাকলেও, সময়ের অভিজ্ঞতায় তার ছাপ থেকে যায়– অদৃশ্য, অথচ অমোচনীয়। সমাজের মূলস্রোত যেখানে নারীর জীবনে একবার ‘বিধবা’ তকমা লাগলে তাকে মৃত্যুর মতো একঘরে করে দিত, সেখানেই পাশে দেখা যায় এক প্রান্তিক সমাজকে, যারা নারীকে মানুষের চোখে দেখেছে। এই দ্বন্দ্বের মাঝেই বিদ্যাসাগরের চিন্তা গড়ে উঠেছিল। হয়তো সেখান থেকেই সাহস সঞ্চার করেছিলেন তিনি– একটা সমাজের বিরুদ্ধে দঁাড়ানোর।
জীবনের শেষ অধ্যায়েও বিদ্যাসাগর ফের ফিরে গিয়েছিলেন আদিবাসী সমাজের কাছেই। কলকাতার ব্যস্ততা ও ক্লান্তিকর সমাজজীবন ছেড়ে ১৮৭৩ সালে তিনি চলে যান বর্তমান ঝাড়খণ্ডের কর্মাটাঁড়ে।
সেখানে কিনেছিলেন একটি বাড়ি– নাম দিয়েছিলেন ‘নন্দনকানন’। গড়ে তুলেছিলেন স্কুল, হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসালয়, সমাজসেবা কেন্দ্র। আদিবাসী মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন অবিচল ভরসা হয়ে। তারা তঁাকে আপন করে নিয়েছিল। কর্মাটঁাড়ের স্টেশনের নাম এখন ‘বিদ্যাসাগর’, শুধু সরকারিভাবে নয়, মানুষের হৃদয়েও স্থায়ী হয়ে গিয়েছেন তিনি। এখনও সেই অঞ্চলের আদিবাসীরা তঁাকে মনে রাখে– বইয়ের পাতায় নয়, স্মৃতির উষ্ণতায়। বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহ আইন পাশের কৃতিত্ব এখনও গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করে। কিন্তু ইতিহাসের এই আলোয় দাঁড়িয়ে দেখা জরুরি যে, সেই সংস্কারের বীজ বোনা ছিল আরও আগে, আরও গভীরে– আদিবাসী সমাজের প্রথায়, যা ছিল সাদা পাতার মতো সরল, অথচ আশ্চর্যরকম মানবিক।
সমাজ যখন বিধবার জীবনের দরজা বন্ধ করে দিচ্ছিল একে একে, তখন আদিবাসী সমাজ নির্লিপ্তভাবে সেই দুয়ার খুলে রাখছিল– সম্মানের সঙ্গে, ভালবাসার সঙ্গে। কোনও রাজনীতির ব্যাখ্যা নয়, কোনও ধর্মীয় ফতোয়ার তোয়াক্কা নয়, একটি নারীর জীবনকে আবার গড়ে তোলার স্বাভাবিক স্বীকৃতি ছিল তাদের সমাজে।
বর্তমানে দাঁড়িয়ে, সমাজ যখন আবার নারীর অধিকার, স্বাধীনতা ও সম্মান নিয়ে প্রশ্নের মুখে, তখন আদিবাসী সমাজের এই প্রচলিত শিক্ষা আমাদের নতুন করে ভাবায়। কাগজে লেখা আইন নয়, মাটির গভীরে লুকনো মানবিকতা– সেই ছিল প্রকৃত সংস্কার। ঈশ্বরচন্দ্রের সংস্কার ছিল সময়ের বিরুদ্ধে এক লড়াই। আর আদিবাসী সমাজ? তারা অনেক আগেই, নিঃশব্দে, স্বাভাবিকভাবেই সেই লড়াই জিতে বসেছিল।
(মতামত নিজস্ব)
লেখক সাংবাদিক
[email protected]
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.