Advertisement
Advertisement
Afghanistan

লাপাতা লেডিজ!

লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যের এহেন ছবি ঘিরে নিন্দার ঝড়!

Write up on the bilateral meeting between the Afghanistan and India, where female journalists initially denied access
Published by: Biswadip Dey
  • Posted:October 14, 2025 2:04 pm
  • Updated:October 14, 2025 2:04 pm   

আফগান বিদেশমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি ও ভারতের বিদেশমন্ত্রী এস. জয়শঙ্করের দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে প্রথমে মহিলা সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকার দেওয়া হয়নি। ১৬ জন পুরুষ সাংবাদিক ডাক পান। ভারতের বর্তমান বিদেশমন্ত্রী যদি নারী হতেন, তাহলে এ বৈঠক হত? প্রবল চাপে মহিলা সাংবাদিকদের সঙ্গে মুত্তাকি আবারও কথা বলায় আগ্রহ দেখান, ভালো। তবে লিঙ্গ-অসাম্যের এই দেশে অনেকেই এতক্ষণে হয়তো ভেবে নিয়েছে যে, বহু বিষয়ে চাইলেই মেয়েদের বাদ দেওয়া যায়! এটাই ভয়ের, চিন্তার, লজ্জার। লিখছেন প্রহেলী ধর চৌধুরী

Advertisement

রাষ্ট্রসংঘের ‘নিষেধাজ্ঞা’ থেকে সাময়িক অব্যাহতি, আর শর্তসাপেক্ষে বিদেশ ভ্রমণের অনুমতি পেয়ে, সম্প্রতি, সপ্তাহব্যাপী ভারতসফরে আসেন তালিবানশাসিত আফগানিস্তানের বিদেশমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি। এর আগে গিয়েছিলেন রাশিয়া– যা কিনা এখনও অবধি তালিবানশাসিত আফগানিস্তানকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়া বিশ্বের একমাত্র দেশ। ভারত অবশ্য আফগানিস্তানকে এখনও সেই ‘স্বীকৃতি’ দেয়নি, তবু পাকিস্তানের সঙ্গে শত্রুতায় আফগানিস্তান যে ভারতের সঙ্গে গঁাটছড়া বঁাধবে, এ-দেশে আসার আগেই ভারতকে ‘প্রিয় বন্ধু’ ঘোষণা করবে, নতুন কী!

মুত্তাকির সঙ্গে ভারতের এই বৈঠকের বিষয়সূচি কূটনৈতিক কারণেই আলোচনার আগে প্রকাশ করা হয়নি। ধরে নেওয়া হয়েছিল যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য, নিরাপত্তা আর উভয় রাষ্ট্রের মধ্যে সুসম্পর্ক স্থাপনের নানা দিশা-ই এই আলোচনার উপজীব্য। তবে একটা সমস্যা ছিলই। কূটনৈতিক প্রোটোকল অনুসারে– দু’টি দেশের আনুষ্ঠানিক দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের ক্ষেত্রে উভয় দেশের পতাকা প্রদর্শনের রীতি রয়েছে। কিন্তু ভারত যেহেতু এখনও তালিবানশাসিত আফগানিস্তানকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়নি, তাই বৈঠকের সময় তালিবানের সাদা পতাকা ‘শাহাদা’ প্রদর্শিত হবে কী করে? বিশেষ করে যেখানে নয়াদিল্লির আফগান এমব্যাসিতে এখনও প্রাক্তন ইসলামিক ‘রিপাবলিক অফ আফগানিস্তান’-এর ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকাই বিদ্যমান।

এই সমস্যার সমাধান করা হল প্রথা ভেঙে। বৈঠকে ভারত বা আফগানিস্তান– কোনও দেশের পতাকাই প্রদর্শিত হল না। এ অবশ্য নতুন ঘটনা নয়। এর আগে দুবাইতে মুত্তাকির সঙ্গে ভারতের বিদেশসচিব বিক্রম মিস্ত্রির মিটিংয়ের সময়ও একই পন্থা নেওয়া হয়েছিল। আসলে, সংসার হোক আর কূটনৈতিক রাজনীতি– ইচ্ছা থাকলে উপায় একটা ঠিকই হয়।
কিন্তু বৈঠকে অন্য আর-একটি সমস্যাও দেখা দেয়। আমির খান মুত্তাকি আর ভারতের বিদেশমন্ত্রী এস. জয়শঙ্করের দ্বিপাক্ষিক মিটিংয়ে মহিলা সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকারে বাধা দেওয়া হয়, কেবলমাত্র ১৬ জন পুরুষ সাংবাদিককেই বৈঠকে উপস্থিত থাকার জন্য বেছে নেওয়া হল। না বৈঠকে উপস্থিত পুরুষ সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে, না ভারতীয় বিদেশ মন্ত্রকের তরফে মহিলা সাংবাদিকদের অন্তর্ভুক্তির কথায় জোর দেওয়া হয়। ফলে, বৈঠকটি থেকে মহিলারা নারীজন্মের অপরাধে ব্রাত্য রইলেন। এপ্রসঙ্গে ভারতের বিদেশ মন্ত্রককে প্রশ্ন করায় তারা জবাব দিয়েছে যে, আফগান দূতাবাসের ধার্য করা এই বৈঠকে সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা বা তাদের সঙ্গে আলাপচারিতার বিষয়টি ঠিক কেমন হবে– সেই সম্পর্কে তাদের ধারণাই ছিল না। পুরো বিষয়টিই দেখেছে আফগান দূতাবাস। সুতরাং তাদের পক্ষে কিছু করা সম্ভব ছিল না।
কী কেলেঙ্কারি! আচ্ছা ভাবুন তো মুত্তাকি যদি এই মিটিংয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরোধিতায় কোনও মন্তব্য করতেন সংবাদমাধ্যমের সামনে, তাহলেও কি আমাদের দেশের বিদেশ মন্ত্রক চুপ করে থাকত? আরও একটা অন্য দিক দিয়ে ভাবুন। ভারতের আফগান দূতাবাসে আয়োজিত কোনও দ্বিপাক্ষিক মিটিংয়ে যদি পুরুষ সাংবাদিকদের পুরুষ-জন্মের অপরাধে ঢুকতে দেওয়া না হত, বা ধরুন, আফগানিস্তান ঘোষিত ‘ইসলামিক দেশ’ এই যুক্তিতে কোনও অমুসলিম ভারতীয় সাংবাদিককে যদি প্রবেশাধিকার না-দেওয়া হত, কিংবা ভারতের বিদেশমন্ত্রী এস. জয়শঙ্করের সংগীতপ্রীতি রয়েছে, আর ইসলামে সংগীত অননুমোদিত– এ যুক্তিতে যদি এস. জয়শঙ্করকেই বয়কট করা হত? যদি পুরুষ না-হয়ে এস. জয়শঙ্কর মহিলা বিদেশমন্ত্রী হতেন– সুষমা স্বরাজের মতো? তাহলে? তবে কী হত? সেক্ষত্রেও কি আফগান শর্ত অনুসারেই এই মিটিং করা হত? বিদেশ মন্ত্রক কি সেক্ষেত্রেও এই বলেই চুপ করে থাকত যে, ওরা আয়োজন করেছে, আমাদের কিছু করার নেই?

উত্তর হল, না। সম্ভবত সেক্ষেত্রে এ বৈঠক বাতিল হয়ে যেত।সমাজমাধ্যমে অবশ্য কেউ-কেউ ভারতীয় বিদেশ মন্ত্রকের সপক্ষে যুক্তি দিয়েছেন। বলেছেন যে, কোনও দেশের অভ্যন্তরে অন্য দেশের দূতাবাস থাকলে, তার অন্দরে সেই দূতাবাসের দেশের নিয়মই খাটে। কথাটি সত্য, কিন্তু এতটাও সাদা-কালো বাস্তব নয়। বিষয়টি ধরিয়ে দিয়েছে ‘এডিটরস গিল্ড অফ ইন্ডিয়া’ এবং ‘ভারতীয় মহিলা প্রেস কর্পোরেশন’ (‘আইডব্লিউপিসি’)। বলেছে যে, ভিয়েনা সম্মেলনের শর্ত অনুযায়ী, কূটনৈতিক প্রাঙ্গণ (যেমন কোনও দেশের মাটিতে অন্য দেশের এমব্যাসিতে) নানা বিশেষাধিকার– যেমন, পূর্বানুমতি ছাড়া কূটনৈতিক প্রাঙ্গণে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা, আয়োজক দেশের থেকে কূটনৈতিক প্রাঙ্গণের সুরক্ষা ও সে-দেশের স্থানীয় আইনিব্যবস্থা থেকে অব্যাহতি, এমনকী আপন দেশের সঙ্গে গোপন ও নিরাপদ যোগাযোগ অক্ষুণ্ণ রাখার অধিকার ইত্যাদি পেলেও– তা আয়োজক দেশের মানুষদের লিঙ্গপ্রান্তিকতার মাধ্যমে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্ষমতা দেয় না। পাশাপাশি, তারা আরও বলেছে যে, বিদেশনীতি যতই গুরুত্বপূর্ণ হোক না কেন, কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন যতই প্রয়োজনীয় হোক না কেন, মহিলাদের ‘নাগরিক অধিকার’ লঙ্ঘনের বিনিময়ে তা পূরণ করার অর্থ হল–

অন্য দেশটির সংবিধানকে চ্যালেঞ্জ করা। ভারতীয় সংবিধানের ‘অনুচ্ছেদ ১৪’ অর্থাৎ আইনের দৃষ্টিতে প্রত্যেক নাগরিকের সমানাধিকার, এবং ‘অনুচ্ছেদ ১৫’ অর্থাৎ লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য নিষিদ্ধকরণের যে বিধান– তাও কি চ্যালেঞ্জ করা হয়নি? যা কোনও অবস্থাতেই করা যায় না।
এবার যদি সম্পূর্ণ অন্য আঙ্গিক থেকে বিষয়টি দেখি, যদি ধরেই নিতে হয় যে, বৈদেশিক কূটনীতির তাগিদে আফগানিস্তানের বিদেশমন্ত্রীর সঙ্গে সেই মুহূর্তে ভারতকে এই বৈঠকটি করতেই হত, কোনও অবস্থাতেই তা বাতিল করা যেত না, তাহলেও কিন্তু কেন্দ্রের ব্যর্থতাই চোখে পড়ে। অার তা এই কারণে যে, সম্পূর্ণ বিষয়টিকে কেন্ত্রীয় বিদেশ মন্ত্রক বাজারে ‘খবর’ হতে দিল! এই মিটিংয়ের অ্যাজেন্ডার মতোই, দেশের আর-পঁাচটি ‘ক্লাসিফায়েড’ খবরের মতোই, এটিকে তারা অভ্যন্তরীণ বিষয় করে না-রেখে, বাজারি খবর হতে দিয়ে, দেশের কাছে নিদারুণ ভুল উদাহরণ স্থাপন করল।

কীরকম? উদাহরণ দিয়ে বলি। একবার একটি আলোচনাসভায় পর্নোগ্রাফির প্রসঙ্গ উঠলে বিখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী, কবি ও লেখক কমলা ভাসিন বলেন, পর্নোগ্রাফি তো বিপজ্জনকই, তবে ভারতের মতো অজ্ঞতাপূর্ণ, অশিক্ষা আর অসচেতনতায় ভরা দেশের পক্ষে তা দ্বিগুণ বিপজ্জনক। এর ‘কারণ’ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি পরে যা বলেন তার সারমর্ম এই যে, অশিক্ষা আর অজ্ঞতা মানুষের স্বাভাবিক বোধশক্তি ও চেতনা নির্মাণের পথে বাধা সৃষ্টি করে। অজ্ঞ মানুষ ‘সৃষ্টি’ করে না, ‘অনুকরণ’ করে। পর্নোগ্রাফির যৌনতাকে, অজ্ঞতা, স্বাভাবিক যৌনতার প্রকাশ বলে ধরে নেয়। যৌন অত্যাচারের সঙ্গে প্রেমজ যৌনতার ফারাক তার চেতনায় উদ্ভূত হয় না। ভারতের মতো পিছিয়ে থাকা দেশে তাই পর্নোগ্রাফি আরও বিশেষ করে ‘নিষিদ্ধ’ হওয়া উচিত। কারণ, যে কোনও বৃহৎ পদক্ষেপ বা উদাহরণ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকা দেশগুলিকে অনেক বেশি সচেতন হতে হবে।

আমির খান মুত্তাকি ও এস. জয়শঙ্করের দ্বিপাক্ষিক কূটনৈতিক আলোচনা থেকে মহিলা সাংবাদিকদের ব্রাত্য করা প্রসঙ্গেও একই কথা মনে হয়। এই ঘটনাকে ‘খবর’ হতে দেওয়ার মাধ্যমে যে চরম নেতিবাচক লিঙ্গপাক্ষিকতার উদাহরণ স্থাপিত হল, তা কি ভারতের মতো দেশে– লিঙ্গ-অসাম্যের নিরিখে যার স্থান ১৪৮টি দেশের মধ্যে ১৩১তম, রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে যে-দেশের মহিলাদের অবস্থান পিছচ্ছে বছর-বছর, যে-দেশে প্রতি ১৫ মিনিটে একজন মহিলা ধর্ষিতা হন, প্রতি সাড়ে ৪ মিনিটে একজন মহিলা গার্হস্থ্য হিংসার শিকার হন, প্রতিদিন পণের বলি হন অন্তত ১০ জন মহিলা– সেই দেশের পক্ষে অপূরণীয় ক্ষতি নয়? এ ঘটনার ‘মর্মার্থ’, সাধারণ মানুষের কাছে, এমনও বার্তা নিয়ে যেতে পারে যে, বহির্বিশ্বের এমন অনেক ‘বিষয়’ আছে, যেখানে অংশ গ্রহণ করা থেকে চাইলেই মহিলাদের ব্রাত্য করে রাখা যায়!

তবে আশার কথা, প্রবল সমালোচনার মুখে পড়ে মুত্তাকি আবার সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে বৈঠকের ডাক দেন, যেখানে পুরুষদের সঙ্গে মহিলা সাংবাদিকরাও স্বাগত। আসলে, সমবেত প্রতিরোধের মুখে পড়ে অন্যায়কেই জব্দ হতে হয়, আর ওই যে প্রথমেই বললাম না, ইচ্ছা থাকলে উপায় একটা হয়ই! এ বৈঠক শেষে আমির খান মুত্তাকি ফিরে যাবেন আপন দেশে। প্রবল প্রতিরোধের মুখে নারী অবদমনের যে-চিত্র তিনি এ-দেশে অঁাকতে পারলেন না, তা হয়তো সোৎসাহে পুনরায় চিত্রার্পিত করবেন নিজ দেশে। এ-ই তো ‘আল্‌ফা’ ম্যানের নিয়তি। ‘হেজেমোনিক ম্যাসকুলিনিটি’-র ফঁাদে সে কেবলই তলোয়ার আন্দোলিত করে, আস্ফালন করে আপন নিরাপদ বিচরণভূমিতে; ততক্ষণ পর্যন্ত– যতক্ষণ না তার থেকেও বড় কোনও ‘আল্‌ফা’ এসে তার শিরশ্ছেদ করছে।

(মতামত নিজস্ব)

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ