সন্দীপ্তা ভঞ্জ: সম্প্রতি সংবাদ প্রতিদিন-এর সাক্ষাৎকারে মমতা শঙ্কর ঋতুস্রাব সংক্রান্ত কিছু মন্তব্য করেছিলেন। বর্ষীয়াণ অভিনেত্রী তথা নৃত্যশিল্পী প্রশ্ন ছুড়েছিলেন, “স্যানিটারি ন্যাপকিনের বিজ্ঞাপনে লাল রং ঢেলে বোঝানোর কোনও প্রয়োজন আছে ঋতুস্রাব কী বা কেমন?” তাঁর সংযোজন, বাবা কিংবা ছেলের সঙ্গে এই বিষয়ে তিনি আলোচনা করতে পারবেন না! মমতা শঙ্করের এহেন মন্তব্য ভাইরাল হতেই সংবাদ প্রতিদিন-এর সাক্ষাৎকারের ওই সংশ্লিষ্ট অংশ নিয়ে নেটপাড়ায় তুমুল হইচই। প্রশ্ন ওঠে, মমতা শঙ্কর কি নারী অগ্রগতির পরিপন্থী? এমন আবহেই সংবাদ প্রতিদিন-এর তরফে যোগাযোগ করা হয় শোভন মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। যিনি ‘বাংলার প্যাডম্যান’ বলেই পরিচিত।
পুরুষতন্ত্রের নিয়মনীতির শিকল ভেঙে এক তরুণ বছর খানেক আগে ভাইফোঁটা উপলক্ষে বোনেদের স্যানিটারি ন্যাপকিন উপহার দেওয়া শুরু করেছিলেন। বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, ঋতুস্রাবের ছুঁৎমার্গ আসলে সমাজকে কতটা পিছিয়ে নিয়ে যায়। খোদ পর্দার ‘প্যাডম্যান’ অক্ষয় কুমার যাঁকে ফোন করে শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন আসল ‘হিরোগিরি’র জন্য। আজকের সেই যুবক কিন্তু এখনও বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে ছুটে যাচ্ছেন প্রান্তিক মানুষদের শুধু এটুকু বোঝানোর জন্য যে, ঋতুস্রাব বা রজঃস্বলার মানে ‘শরীর খারাপ’ নয়। বরং ফি মাসে মাসিক না হওয়াই আদতে ‘শরীর খারাপে’র লক্ষ্মণ। নারীদেহের এই মাসিকচক্রের জন্যই তো গোটা সৃষ্টি। তাই সেই শারীরবৃত্তিয় প্রক্রিয়াকে ‘শরীর খারাপ’ বলে লঘু করা উচিত নয়। পিরিয়ডস বা ঋতুস্রাবকালীন সচেতনতার প্রচারমূলক এই জার্নিতে শোভনের সঙ্গে শামিল হয়েছেন উত্তর-দক্ষিণ মিলিয়ে গ্রামবাংলার বহু মা-মেয়ে-বধূরা। সেই প্রেক্ষিতেই শোভন বলছেন, “মমতা শঙ্করের মতো একজন সম্মানীয় শিল্পী যদি এহেন মন্তব্য করেন, তাহলে ওই প্রান্তিক অঞ্চলের নারীদের লড়াইটা পিছিয়ে যায়।” কীভাবে? সেই কারণ ব্যাখ্যা করে বাংলার প্যাডম্যান বোঝালেন, “আজ সবার ঘরে প্যাড না থাকলেও হাতে মোবাইল রয়েছে। ম্যাডামের ওই মন্তব্যটা ফলে শহরতলী ছাড়িয়ে প্রত্যন্ত গ্রামেও ভাইরাল। অনেক বউমা কিংবা বাড়ির মেয়েরা যাঁরা ঋতুস্রাব নিয়ে ছুঁৎমার্গের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন, এবার থেকে হয়তো তাঁদের গুরুজনরা শাসন করবেন এই বলে যে, মমতা শঙ্করের মতো একজন বড় মাপের শিল্পী যদি এহেন ছুঁৎমার্গ মানতে পারেন, তাহলে তুমি কোন ছাড়! আমার চিন্তা সেসব নারীদের জন্যই যাঁরা সমাজের বুকের উপর থাকা কুসংস্কার, ট্যাবুর জগদ্দল পাথরটাকে সরানোর চেষ্টা করছেন। মমতা শঙ্করের এই মন্তব্য ভাইরাল হওয়ার ফলে আজকের পর থেকে ওঁরাও প্রতিবাদ করতে গেলে প্রশ্নের সম্মুখীন হবেন।”
ঠিক কী বলেছিলেন মমতা শঙ্কর, যার জন্যে নেটভুবনে গেল গেল রব? সংবাদ প্রতিদিন-এর সাক্ষাৎকারে বর্ষীয়াণ নৃত্যশিল্পী, অভিনেত্রীর মন্তব্য ছিল, “স্যানিটারি ন্যাপকিনের বিজ্ঞাপনে লাল রং ঢেলে বোঝাতে হবে কেন? সমাজ দিনে দিনে এগোচ্ছে না পিছোচ্ছে? মানুষ কি দিনে দিনে এতটা বোকা হচ্ছে যে চামচে করে গিলিয়ে দিতে হবে? আমার লজ্জা করে। আমি এখনও ততটা আধুনিক হতে পারিনি যে আমার ছেলেকে দিয়ে ‘ওরকম কিছু একটা’ কেনাব। বা বাবাকে দিয়ে কেনাব।” প্রবীণ শিল্পীর এহেন মন্তব্যের প্রেক্ষিতে শোভন মুখোপাধ্যায় মনে করলেন সেই দিনগুলি, যখন তাঁর মা তাঁকে নারীদেহের ঋতুচক্র নিয়ে পাঠ দিতেন। বাংলার প্যাডম্যান বলছেন, “আমাদের সমাজ মেয়েদের কী শেখাব, আর ছেলেদের কী শেখাব?- তার এক বৃহৎ তালিকা বানিয়ে রেখেছে। যেমন ছেলেদেরকে শেখানো হয় না মেয়েদের ঋতুঃস্রাব কেন হয়? সেই সময় কী কী সমস্যার মধ্যে তারা থাকতে পারে? আবার এটাও শেখানো হয় না একজন ছেলের বয়ঃসন্ধিকালে কী কী শারীরিক পরির্বতন অনির্বার্য, বিপরীতে মেয়েদের শারীরিক পরিবর্তন কিংবা বয়ঃসন্ধিকালীন পরির্বতনের পাঠ দিলেও সেবিষয়ে সমাজ এখনও খোলাখুলি আলোচনা করার মতো ‘সাবালক’ হয়ে ওঠেনি। এই বাধানিষেধই একটা সময় পরর্বতীতে সাংসারিক জীবনের কোথাও বাধাসৃষ্টি করে। যে কারণে বেশিরভাগ মেয়েই বলে থাকেন- ‘ছেলেরা কি আর মেয়েদের কষ্ট বুঝবে?’ এই প্রচলিত সামাজিক ধ্যানধারণাগুলি লিঙ্গভেদের একটা দৃষ্টান্ত। এইগুলোই ভাঙতে হবে, কুসংস্কারমুক্ত সমাজ গঠন করতে হবে। আমার আন্দোলন এই জড়তার বিরুদ্ধেই। আজ উনি মমতা শঙ্কর বলে ওঁকে নিয়ে সকলে আলোচনা করছেন, কিন্তু এরকম হাজারও মানুষ আছেন, যাঁরা এহেন ধ্যানধারণার বশবর্তী। আমার লড়াই আগেও ছিল আগামীতেও জারি থাকবে।”
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.