বিশ্বদীপ দে: অতীত ফিরে ফিরে আসে। আজকের দ্রুতগামী নেট ভুবনে তা আরও বড় সত্যি। ‘চেরি চেরি লেডি’ হোক ‘বড়লোকের বিটি লো’, কত গানই ইনস্টাগ্রাম রিলস হয়ে নতুন করে ফিরে এসেছে ‘ওল্ড ওয়াইন’ হয়। তেমনই এক গান ‘প্রেটি লিটল বেবি’। মার্কিন পপ তারকা কনি ফ্রান্সিসের কণ্ঠ ফের ভাইরাল হয়ে গিয়েছে। জায়গা করে নিয়েছে স্পটিফাইয়ের ডেইলি টপ চার্ট সংসে। আজ গায়িকার বয়স ৮৭। রেকর্ড বিকিয়েছে ২০ কোটি! গোটা বিশ্ব মোহিত হয়েছে তাঁর কণ্ঠস্বর। ‘হুজ সরি নাউ’ গানটি স্থান পেয়েছে ‘সংস অফ দ্য সেঞ্চুরি’র তালিকায়। কিন্তু কনি ফ্রান্সিসের জীবন কেবলই রূপকথার সোনালি আখ্যান নয়। মোটেলের ঘরে বছর উনিশের এক কিশোর তাঁকে ধর্ষণ করেছিল। সেই লাঞ্ছনার বিষে শিরার গভীরে চারিয়ে গিয়েছিল বিষণ্ণতা! ফিনিক্সের মতো ফিরে আসেন গায়িকা। সেই লড়াই, সেই জিতে ফেরা হার মানায় রূপকথার জৌলুসকেও।
পুরো নাম কনসেট্টা রোজা মারিয়া ফ্রানকনেরো। যদিও পরিচিত হয়েছিলেন কনি ফ্রান্সিস নামে। গত শতকের পাঁচের দশকের শেষদিক থেকে খ্যাতির তুঙ্গে পৌঁছতে থাকেন। ‘এভরিবডিস সামবডিস ফুল’ গানের জন্য ‘বিলবোর্ড হট ১০০’-এ (মার্কিন সেরা গানের তালিকা) পৌঁছনো প্রথম মহিলা কনি ১৯৬০ সালে কেবল আমেরিকা নয়, জার্মানি, জাপান, ব্রিটেন, ইটালি ও অস্ট্রেলিয়ায় সবচেয়ে সফল মহিলা শিল্পীর তকমা পান। তারপর কেবলই খ্যাতির শীর্ষে অবস্থানের এক অনর্গল রূপকথা।
কিন্তু এই আলোর উলটো দিকে রয়ে গিয়েছে ব্যক্তিগত জীবনের বিষণ্ণতার আখ্যান। চারটি বিয়ে করেছিলেন। কোনওটিই টেকেনি। কিন্তু এর চেয়েও বিষাদঘন অধ্যায় এক কিশোরের লালসার শিকার হওয়া। ১৯৭৪ সালের ৮ নভেম্বর। ‘ওয়েস্টবেরি মিউজিক ফেয়ার’-এ যোগ দিতে গিয়েছিলেন। নিউ ইয়র্কের জারিকোর এক মোটেলে রাত কাটানোই মনস্থ করেন। ভোরবেলা টের পেলেন ঘরে কেউ ঢুকে পড়েছে! ঘুমের ঘোর কাটার আগেই চোখের সামনে ঝিকিয়ে উঠল ছুরি। বছর উনিশের এক কিশোর তাঁকে ধর্ষণ করে লুটপাট চালিয়ে পালিয়ে গেল। যাওয়ার আগে তাঁকে চেয়ারে বসিয়ে হাত পিছমোড়া করে বেঁধে উলটে শরীরের উপরে অতিকায় ম্যাট্রেস চাপিয়ে দিয়ে যায়। সেই অন্ধকার ম্যাট্রেসের আড়ালে দমবন্ধ হয়ে মারাই যাচ্ছিলেন কনি। কিন্তু শেষপর্যন্ত লড়াই থেকে সরে থাকেননি তিনি। সময়ের হিসেবে প্রায় আধঘণ্টার চেষ্টায় কোনওমতে ম্যাট্রেস থেকে নিজেকে মুক্ত করে টেলিফোনের কাছে নিয়ে যেতে সফল হন। ওই ৩০ মিনিট যেন এক অনন্ত সময়। ফোন পেয়ে পাশের ঘর থেকে ছুটে আসেন তাঁর সেক্রেটারি।
মোটেলটির বিরুদ্ধে মামলা করেন কনি। আর্থিক সাহায্য পান ২৫ লক্ষ ডলারের। কিন্তু চরম লাঞ্ছনার বিষাক্ত ছোবলের সমান্তরালে অর্থের কোনও অস্তিত্বই নেই। খোঁজ মেলেনি সেই ধর্ষকের। এদিকে কনির চোখের সামনে নেমে আসা অন্ধকার ক্রমেই ঘন হতে থাকে। ভুগতে শুরু করেন অবসেসিভ কমপালসিভ ডিসঅর্ডারে। দিনে পঞ্চাশটা করে ডারভন পিল খেতে হত। নিউ জার্সির বাড়ি থেকে বেরতে পারতেন না। ঘরের ভিতরেই যেন ‘লুকিয়ে’ থাকছিলেন। দেখতে দেখতে চারটে বছর কেটে গিয়েছে। মাঝের সময়ে কোনও কনসার্ট করেননি তিনি। ১৯৭৮-এ ফের স্টুডিওয় ফেরা। ‘হু’স হ্যাপি নাউ’ অ্যালবামের কাজ শুরু করেন। কিন্তু এরপরই গলার অস্ত্রোপচার করতে গিয়ে হারিয়ে ফেললেন কণ্ঠস্বরই! যে কণ্ঠের জাদুতে মুগ্ধ গোটা বিশ্ব, সেই কণ্ঠই হারিয়ে গেল! ১৯৮১ সাল পর্যন্ত মূকই থাকতে হয়েছিল গায়িকাকে। এদিকে সেই বছরই মাফিয়াদের গুলিতে মারা গেলেন ভাই জর্জ। দিদি ও ভাই ছিল পরস্পরের ছায়াসঙ্গী। এই মৃত্যুই যেন নতুন করে কনিকে জীবনের মূলস্রোতে ফেরাল। পরিবারের দায়িত্ব নিয়ে নিজস্ব বিষণ্ণতাকে একপাশে সরিয়ে রেখে ফের ঝাঁপিয়ে পড়লেন ফিনিক্স হয়ে। কিন্তু জীবনটা তো সিনেমা নয়। তাই ফেরাটা অত মসৃণ হল না। কণ্ঠস্বর ফিরে পেলেন। স্টুডিওতেও ফিরলেন। কিন্তু অচিরেই আক্রান্ত হলেন ডিপ্রেশনের অসুখে! নানা ওষুধ খেয়ে যেন পরিণত হলেন এক জোম্বিতে! শেষপর্যন্ত চেষ্টা করলেন আত্মহত্যা করারও। ভর্তি হতে হল মানসিক হাসপাতালে। কিন্তু এত কিছুর পরও হার মানেননি তিনি।
১৯৮৪ সালে লিখলেন আত্মজীবনী ‘হু’স সরি নাউ’। সেই বই বেস্ট সেলার হল। ১৯৮৯ সালে ফের শুরু হল রেকর্ডিং। শুরু হল অনুষ্ঠান করা। আগের সময়টা আর ফেরেনি। তবু কনি তাঁর গানের ভুবনকে ফিরে পেলেন। যে গান তাঁকে আশ্রয় দিত। লালন পালন করত। সেই গানের কাছে ফিরে যেতে পারলেন তিনি।
২০১৮ সালে অবশেষে অবসর নেন কনি। নব্বই ছুঁই ছুঁই বয়সে জীবন কাটে হুইল চেয়ারে। আর এই বয়সে এসেও দেখতে পেলেন, তাঁর কবেকার কণ্ঠস্বর ভাইরাল হয়ে গিয়েছে। ‘প্রেটি লিটল বেবি’ ফিরে এসেছে এই নতুন সময়ে। ডিজিটাল বিশ্বে। কনি এখনও আমাদের মধ্যে রয়েছেন। যেমন রয়েছে তাঁর গান। আর তেমনই রয়েছে তাঁর ফিরে আসার রূপকথা।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.