অনেক বছর পর বাবা-মেয়ে এক ছবিতে। খোলামনে সিনেমা, ইন্ডাস্ট্রি, জীবন নিয়ে কথা বললেন তাঁরা। অন্নপূর্ণা বসুর ‘স্বার্থপর’ নিয়ে আসছে গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক বার্তা। রঞ্জিত মল্লিক, কোয়েল মল্লিকের সঙ্গে আড্ডায় শম্পালী মৌলিক।
পুজো কেমন কাটল?
রঞ্জিত মল্লিক : ভালোই, তবে স্ট্রেন হয়। প্রচুর আত্মীয়স্বজন বাইরে থেকে আসে, সেই সঙ্গে পুজোর নিয়মকানুন। কিছুটা এগজস্টেড হয়ে গিয়েছিলাম।
কবীরের সঙ্গে দাদুর নাচ দেখলাম, ভাইরাল তো।
রঞ্জিত মল্লিক : (হাসি) চূড়ান্ত।
কোয়েল মল্লিক : ভাইরাল মানে, মারাত্মক। আমি ভাবতে পারিনি বাবা নাচতে শুরু করবেন। মল্লিক বাড়িতে গেলে বাবার বয়স পাঁচে চলে যায়। মনে করিয়ে দিতে হয় যে, বাবা এবার থামো।
রঞ্জিত : নাচার প্ল্যান একদম ছিল না। কিন্তু যেই ঢাকের আওয়াজ হয়, শরীরটা-মনটা কেমন করে! সারাজীবন জন্ম থেকে এটা দেখে এসেছি তো, ওই সময়টা নিজেকে সামলাতে পারি না।
পুজোর ছবি দেখা হয়েছে?
রঞ্জিত : ওই কটা দিন বাড়ি থেকে নড়তে পারি না আমরা।
কোয়েল : ওই পাঁচদিন ধরে ৩৬৫ দিনের গল্প হয়, আর সব আত্মীয়স্বজন আসে।
এবারে পুজো রিলিজের আগে প্রায় সকলেই পথে নেমে শহর ছাড়িয়ে প্রচার করলেন। এমন বিষয় মনে হয় আপনাদের সময় দেখেননি…
রঞ্জিত : কখনও দেখিনি। ভবিষ্যতে করবও না। আমাদের যুগে যেটা ছিল, খেয়াল করে কাজকর্ম করা, ফাঁকিবাজি নেই সেখানে। সৎভাবে কাজ করি, যাতে লোকের ভালো লাগে। আমাদের বিশ্বাস, লোকের ভালো লাগলে দেখবে। মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি মাউথ পাবলিসিটিতে।
কোয়েল : প্রচার এখনকার দিনে খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমি যখন থেকে কাজ শুরু করেছি, তখন থেকে আজকের প্রচারের ধরন অনেক পালটে গিয়েছে। বাবার কথার সঙ্গে আমি সহমত। শুধু এই ক্ষেত্রে নয়, পরেও হয়তো এমন প্রশ্ন থাকবে যেখানে আমি একমত হব। মনে করি, যদি সিনেমা ভালো হয়, লোকে দেখতে আসবে। আমিও মুখে মুখে প্রচারে বিশ্বাসী। প্রত্যেকটা ছবির নিজের ভাগ্য থাকে।
তিন-চারটে ছবিতে আপনারা বাবা-মেয়ে স্ক্রিন শেয়ার করেছেন। ২০০৩ সালে কোয়েল সিনেমায় এলেন ‘নাটের গুরু’ দিয়ে। রঞ্জিত মল্লিক ছিলেন। তারপর ‘চাঁদের বাড়ি’, ‘প্রেমের কাহিনি’-তেও আপনারা ছিলেন। এতবছর পরে বাবা-মেয়ে আবার পর্দায় ফিরছেন ‘স্বার্থপর’ দিয়ে।
রঞ্জিত : কোয়েল হয়তো বলেছিল, না আর বাবাকে নিতে হবে না (জোরে হাসি)।
কোয়েল : এত বছর পরে, ভাবিনি! মাঝখানে ‘সাত পাকে’ করেছিলাম বোধহয়। বাবার সঙ্গে কাজ করা দারুণ মজার। একসময় বাবা তো সব ফিল্মে থাকতেন। তারপর বাবা বলেছিলেন, যথেষ্ট হয়েছে আর নয়। পরে খুব খুচরো খুচরো কাজ করেছেন। এত লম্বা বিরতিতে আবার আমরা। এই ছবির পরিচালক চিকি মানে অন্নপূর্ণাকে (বসু) অনেকদিন ধরে চিনি। চিকি যখন গল্প এবং স্ক্রিপ্ট (সদীপ ভট্টাচার্য) নিয়ে এসেছিল, আমি উত্তেজিত ছিলাম। আরও দু’তিনটে গল্পও বলেছিল। কিন্তু এইটা সবচেয়ে ভালো লেগেছিল। কারণ এই গল্পটা ঘরে ঘরে। এই জিনিসগুলো চোখের সামনে, কিন্তু কেউ এটা নিয়ে কথা বলি না। একটা চরিত্র নিয়ে বলেছিল, এটা তখনও ডেভলপ করেনি। আমি বলেছিলাম ভালো করে ডেভলপ করো, একজনকে শোনাব। ওই চরিত্রটা হুবহু বাবা। যে সবটা স্যাক্রিফাইস করবে কিন্তু অন্যায় সহ্য করবে না। ছোট থেকে বাবাকে এমন দেখেছি। বাবার জীবনদর্শন হল, কম পাব কিন্তু অসৎ হব না। ‘জি কে লাহা’ বাবার চরিত্র, একজন আইনজীবী। তারপর বাবাকে গল্পটা শুনতে বলি। ভীষণ ভালো লেগেছে বলেই বাবা এতদিন পরে রাজি হলেন।
মেয়ের সঙ্গে ফের কাজ করার উত্তেজনা কতটা?
রঞ্জিত : গল্পটা আমার খুব পছন্দ হয়েছিল। খুবই রিয়ালিস্টিক। ভাইবোন নিয়ে বিষয়টা। আমরা জয়েন্ট ফ্যামিলি, ভাইবোনেদের মধ্যে সুন্দর সম্পর্ক আছে। অন্য পরিবারের মধ্যে যদি দেখি ভাইবোনের মধ্যে মনোমালিন্য হচ্ছে, আমার ভীষণ কষ্ট হয়। এই গল্পটায় দাদা-বোনের মধ্যে যে সম্পর্কের ব্যবধান তৈরি হয়ে যাচ্ছে, অভিমান চলে আসছে। এখানে আইনজীবীর পার্ট আমার। অপর্ণার (কোয়েল) লইয়ার। আমাদের পরিবারেও ভরা লইয়ার। অনেক দীর্ঘ সংলাপ আছে আমার, সব মনে রাখতে হত (হাসি)।
কোয়েল : বুঝতে পারছ তো, মেয়ের সঙ্গে পার্ট করার উত্তেজনা পরে। প্রথমে গল্প, চরিত্র।
ট্রেলারে স্বার্থপরতার বিষয়টা উঠে আসছে। সকলকেই হয়তো ব্যক্তিগত জীবনে কোনও না কোনও মোড়ে স্বার্থপর কথাটা শুনতে হয়েছে। কোয়েলের তেমন কোনও অভিজ্ঞতা?
কোয়েল : ভগবানের আশীর্বাদ, আমাকে কখনও কাউকে তেমন বলতে হয়নি বা শুনতেও হয়নি। চারপাশে বহুবার বহুজনকে দেখেছি, যারা শুধুমাত্র নিজের আনন্দ নিয়ে থাকে। শুধু নিজেদের কথা ভাবে। কিন্তু আমরা যেহেতু একান্নবর্তী পরিবারে মানুষ, ছোট বয়স থেকে সকলের মধ্যে আনন্দ-আহ্লাদ ছড়িয়ে দেওয়ার কথাই ভাবি। মানিয়ে নিতে শিখেছি, কখনও দাঁড়িপাল্লায় না মেপে, যে কে কতটা করল।
রঞ্জিত : শুধুই লাভ-ক্ষতি দেখলে হবে না। অ্যাডজাস্ট করতে হবে। পাঁচটা আঙুল তো সমান হবে না। কারও বেশি বা কম হবে। এই জন্য মনের প্রসারতা আর বুদ্ধি থাকা দরকার। চুলচেরা হিসাব করলে কিন্তু জীবনের অঙ্ক মিলবে না। মিলেমিশে থাকলে আনন্দে থাকা যায়।
কিন্তু আজকে ইন্ডাস্ট্রিতে মিলেমিশে থাকার পরিস্থিতি নড়ে গেছে। এই প্রসঙ্গে কী বলবেন?
রঞ্জিত : আমাদের সময়ে এসব কিছুই ছিল না। কোনওদিন ঝগড়া-মারামারি করতে হয়নি। খুব পাবলিসিটির দিকেও থাকতাম না। কাজের সময় কাজ করতাম। প্রোডাক্ট ভালো হলে দেখবে লোকে, বিশ্বাস ছিল।
বুঝলাম….
রঞ্জিত : প্রচারের ব্যাপারে একটা গল্প বলি। আমি তখন ইন্দ্রপুরী স্টুডিওতে অন্য একটা ছবির শুটিং করছিলাম। আর উত্তমকুমার সম্ভবত ‘শ্রীকান্তের উইল’ করছেন। এক সময় উত্তমকুমার প্রযোজককে ক্যাজুয়ালি জিজ্ঞেস করলেন, “রানা সাহেব, ‘মৌচাক’ রিলিজ করছে, বড় ব্যানার নেই কেন?” তাঁর উত্তর ছিল, ‘এত ব্যানারই যদি লাগাব, তাহলে উত্তমকুমারকে নেব কেন!’ সেই আত্মবিশ্বাস দরকার। (হাসি)
বাংলা ইন্ডাস্ট্রির ঝগড়া সোশ্যাল মিডিয়া পর্যন্ত পৌঁছে গেছে…
কোয়েল : পুজোর কটা দিন সমাজমাধ্যমে কিছু দেখিনি। শুধু কিছু পোস্ট করেছি। কিন্তু ইন্ডাস্ট্রির অংশ হিসাবে জানি, কী কী হচ্ছিল। আমার পরিবারের মধ্যে ঝামেলা হলে যেমন চাইব না পাশের বাড়িতে বলতে, যেটা নিয়ে বিনোদনের জায়গা তৈরি হবে। এই ইন্ডাস্ট্রি আমাদের আরেক পরিবার, কুড়ি বছরের বেশি এখানে কাজ করছি। সবার সঙ্গে আমার অ্যাটাচমেন্ট আছে, তাদের সঙ্গে ঝামেলা নিজেদের মধ্যেই বলতে পারি, দর্শকের সামনে নয়। বিনোদন হিসাবে এটাকে তুলে ধরতে চাই না।
‘স্বার্থপর’ ছবিতে আপনি আর কৌশিক সেন দাদা-বোনের ভূমিকায়। যেখানে মেয়েটিকে বাড়ির অধিকার ছেড়ে সই করে দেওয়ার কথা উঠছে। এখনও মেয়েদের এমন অবস্থা আমরা দেখি।
কোয়েল : এটাই সবচেয়ে দুঃখের। প্রপার্টি অ্যাক্ট কিন্তু বলে, বাবার সম্পত্তিতে ছেলেমেয়ের সমান অধিকার। অনেকে জানে না। জানালেও কিছু ক্ষেত্রে কার্যকর হচ্ছে না। এইখানে ছবিটা আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফিল্ম হয়ে থাকবে। রানেও তাই বলেছে। ছবির ব্যবসা আলাদা, কিন্তু ছবিটা দু’জনকে ভাবালেও ভালো লাগবে। মেয়েদের আত্মসম্মানের অধিকারটুকু রক্ষা করতে হবে।
কৌশিক সেনের মতো দক্ষ অভিনেতার মুখোমুখি আপনি।
কোয়েল : আমি আর ছোড়দিদি ছোট থেকে কৌশিক সেনের কত যে থিয়েটার দেখেছি, তার হিসাব নেই! ম্যাক্সিমাম সিরিয়াস দৃশ্য ওঁর সঙ্গেই আমার ছবিতে। যেমন চ্যালেঞ্জ ছিল, তেমন উপভোগ করেছি। কোর্টরুম ড্রামার চেয়েও দাদা-বোনের অভিমান প্রাধান্য পেয়েছে এই ছবিতে।
লোকে এখন থ্রিলার দেখতে খুব আগ্রহী। কতটা আত্মবিশ্বাসী ছবিটা নিয়ে?
কোয়েল : আমি চাই দর্শক আসুক। সোশ্যাল ইস্যুটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। লোকজন কিন্তু রিলেট করতে পারবে। আমার পরিবারে এমন না দেখলেও, মতামতের জায়গা মেয়েদের এখনও সীমিত। মেয়েদের এখনও চুপ করিয়ে রাখার প্রবণতা। অনেক মানুষকে ভাবাবে ‘স্বার্থপর’। শিগগির আসছে ছবিটা।
বলা হয়, একজন শিল্পীকে বড় হতে গেলে কিছুটা স্বার্থপর হতেই হয়।
রঞ্জিত : কেন? স্বার্থপর কেন?
নিজের কাজের জন্য সময় নিয়ে নিতে হয় সংসার থেকে, জগৎ থেকে।
রঞ্জিত : সেটা সব পেশার মানুষকেই করতে হয়। এইটুকু অ্যাডজাস্টমেন্ট সকলকে করতে হয়। কাজ করতেই তো যাচ্ছি, তোমাদেরই জন্য (হাসি)। এটাকে স্বার্থপরতা বলা যায় না।
কোয়েল : আমি বাবার সঙ্গে একমত। সন্তানদের জন্য গ্যাপ নিয়েছিলাম, আবার কাজে ফিরেছি। আর বাবা সবসময় ফ্যামিলি পার্সন, বাবা যেমন ব্যালেন্স করতেন, আমি সেটা দেখেই শেখেছি। পরিবার প্রায়োরিটি, একইসঙ্গে ক্যামেরার সামনে একশো শতাংশ দিই দর্শকের জন্য। যেন তাঁদের সময় এবং টাকা বিফলে না যায়।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.