শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়: বাঙালির মননে-ধারণে চিরন্তন উত্তম কুমার। ‘একমেবাদ্বিতীয়ম অ্যাটিটিউডে’ আজও তিনিই সেরা। পরিচালক-প্রযোজক হিসেবে যদি কোনওদিন ওঁর সান্নিধ্য পেতাম কিংবা কাস্ট করার সুযোগ পেতাম, তাহলে উত্তম কুমারকে নিয়ে ‘প্রাক্তন ২’ তৈরি করতাম। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে কাজ করেছি, কিন্তু উত্তম কুমারের সঙ্গে কাজ না করার আক্ষেপটা আমার সারাজীবন রয়ে যাবে। প্রথমত, মহানায়ক, একজন মহান অভিনেতার সঙ্গে কাজ করার সুযোগ হয়নি। একজন লেজেন্ডের সঙ্গে কাজ করতে পারিনি। আর দ্বিতীয়ত, কাজ করতে না পারার যেরকম আক্ষেপ রয়েছে, তেমনই এমন একজন মানুষকে কাছ থেকে না দেখতে পাওয়ার আক্ষেপ আরও বেশি। এমন একজন মানুষকে কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করতে পারলাম না! আজীবন সেই আক্ষেপ রয়ে যাবে আমার।
‘মানুষ’ শব্দটি ইচ্ছে করেই রাখলাম। আমি যেহেতু, উত্তমবাবুকে দেখিনি, তাই উনি কীরকম মানুষ ছিলেন বা কেমন নায়ক ছিলেন? তার সবটাই শোনা কথায় নিজের মতো করে নিজের মনের মণিকোঠায় ওঁর একটা মূর্তি তৈরি করে নিয়েছি। কখনও সেটা সুপ্রিয়াদেবীর কথাতে, আবার কখনও সেটা সৌমিত্রদার (চট্টোপাধ্যায়) স্মৃতিচারণায়, কখনও বা সাবিত্রীদির (চট্টোপাধ্যায়) গল্পে কিংবা ওঁর অন্যান্য সহ-অভিনেতা, অভিনেত্রীরা কাজের সুবাদে যাঁরা ওঁর সান্নিধ্য পেয়েছেন, তাঁদের কথায় সেই মূর্তি নিজস্ব আকারণ ধারণ করেছে। তাতে মনে হয়েছে, উত্তম কুমার সবসময়ে নিজেকে ভাঙতে চেয়েছেন। নিজেকে নিয়ে সবসময়ে এক্সপেরিমেন্ট চালিয়ে গিয়েছেন। ক্যামেরার সামনে উত্তম কুমারের উচ্চারণ, হাঁটাচলা… অভিনেতাদের সিনে-সিলেবাসের ব্যকরণ হয়ে রয়ে গিয়েছে। সৌমিত্রদার কাছ থেকে জানতে পেরেছিলাম, প্লেব্যাকের দৃশ্যে যাতে লিপ সিঙ্ক ঠিক হয়, তার জন্যে উনি নিরন্তর রেওয়াজ করতেন। সৌমিত্রদাকেও বলতেন সেই প্র্যাকটিসটা চালিয়ে যেতে। এই যে নিজেকে শিক্ষার্থীর কেদারায় বসিয়ে ‘আমার শেখার কোনও শেষ নেই’ কিংবা চরিত্রের প্রয়োজনে নিজেকে ভেঙেচুরে দর্শকদের কাছে নতুনভাবে তুলে ধরার যে খিদে, বোধকরি এটাই উত্তম কুমারকে সর্বোচ্চ আসনে পৌঁছে দিয়েছিল। এ তো গেল অভিনেতা উত্তমের কথা। মানুষ হিসেবেও কত বড়মাপের ছিলেন, সেটাও ইন্ডাস্ট্রির প্রবীণ অভিজ্ঞদের কাছেই শোনা। প্রয়োজনে কলাকুশলীদের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন। এমনও হয়েছে যে পরিচালক-প্রযোজকের হাতে হয়তো টাকা নেই, তাঁদের পাশেও দাঁড়িয়েছেন। যখন দরকার হয়েছে বন্যার্তদের জন্য যেমন ছুটেছেন, তেমনই দুস্থ টেকনিশিয়ানদের জন্যেও রাস্তায় নেমেছেন। এই বিষয়গুলিই তো প্রকৃত অর্থে একজনকে ইন্ডাস্ট্রির অভিভাবক করে তোলেন।
আর কোনো নায়ক কেন আজও মহানায়ক হতে পারেননি? এমন প্রশ্ন প্রায়শই শুনি। সৌমিত্রদা বলতেন- “জানো শিবু, উত্তমদাই মহানায়ক হয়েছেন, হয়ে থাকবেনও। ওঁর পরে আর কেউ হতে পারবে না।” তার একটাই কারণ, উত্তম কুমার বোধহয় বাংলার শেষ নায়ক, আজও যার সিনেমা টেলিভিশনের পর্দায়, ওটিটিতে দেখার জন্য দর্শকরা ভিড় করেন। যিনি আজও টিআরপি বাড়ানোর ম্যাটিনি আইডল। আজও যদি ওটিটিতে বা স্যাটেলাইটে কোনও সিনে লাইব্রেরি তৈরি করতে হয়, সেটা উত্তম কুমারের ছবি ছাড়া অসম্পূর্ণ। কারণ পর্দায় মহানায়কের ক্যারিশ্মা উপভোগ করার একটা ‘স্টেডি দর্শক’ সবসময়ে আপনি পাবেনই। আমার বিশ্বাস, সপ্তাহের কোনও না কোনও দিন, কোনও না কোনও সময়ে, এমনকী আজ, এই মুহূর্তেও এই বিশ্বের কোনও না কোনও বাঙালি বসে ওঁর সিনেমা দেখছেন। এই ভালোবাসা, এহেন উন্মাদনা উত্তম কুমার ছাড়া অসম্ভব।
উত্তম কুমার ফিরলে ওঁকে আর সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে একটা ছবি নিশ্চয়ই ভাবতাম। কিংবা উত্তম-অপর্ণা জুটিও হতে পারত সেক্ষেত্রে। ওঁরা একসঙ্গে কাজও করেছেন। তবে উত্তম-সাবিত্রী জুটি হলে মজাটা অন্যধরণের হত। আর সেইসঙ্গে আজকের প্রেক্ষাপটে ‘ভ্রান্তিবিলাস’ গোছের একটা চিত্রনাট্য পাওয়া গেলে হলফ করে বলতে পারি, দর্শকরা সাংঘাতিক আনন্দ পেতেন। আদতে পর্দায় উত্তম মানেই ‘ম্যাটিনি ম্যাজিক’। উত্তম কুমারের ছবিতে কোনওদিন কোনও ঘনিষ্ঠ দৃশ্যের প্রয়োজন হয়নি। ওঁর আবেদন, ওঁর তাকানো, ওঁর হাসি, ওঁর হাঁটাচলা, ‘ইউ কাট’ হেয়ারস্টাইল এবং ওই ক্যারিশ্মা, ওই আবেদনের কাছে যে কোনও ঘনিষ্ঠ দৃশ্যই ম্লান হয়ে যায়। ‘হারানো সুর’ ছবিতে ‘তুমি যে আমার গান’টির দৃশ্যে উত্তম-সুচিত্রা জুটির যে ম্যাজিক, আমার মনে সেটা চিরন্তনভাবে রোম্যান্টিক। যার কাছে হার মানায় সিনেপর্দার সব ঘনিষ্ঠ দৃশ্যও।
এবার ‘মহানায়ক’ এই শব্দটায় আসি। উত্তম কুমার অভিনীত কোনও সিনেমায় কিংবা তাঁর ছবির পোস্টারে দেখবেন না যে, উত্তম কুমার তাঁর জীবদ্দশায় নিজের নামের আগে ‘মহানায়ক’ শব্দটা কোনওদিন বসিয়েছেন। জনতা, সাধারণ মানুষ তাঁকে নিজের থেকেই ‘মহানায়ক’ বলেছেন। সেটাই তো বড় পাওনা। যেমন অরণ্যদেব, তার নামে যেমন প্রাচীন প্রবাদ, তেমনই মহানায়ক একটা প্রবাদ। সেই মিথ তৈরি হয় বছরের পর বছর একটা সময় ধরে। উত্তম কুমার একটা মিথ। ওঁর সিনেমা চললে একজন অসুস্থ মানুষও সুস্থ হন। ‘দেয়া নেয়া’তে ওঁর সেই ভুবনভোলানো হাসি দেখলে আজও মুমূর্ষু কোনও রোগীর মুখে হাসি ফোটে। উত্তম কুমার আমার কাছে অব্যর্থ ওষুধ। সেই জন্যই তিনি মহানায়ক। আর ঠিক এই কারণেই আজ পর্যন্ত তাঁকে রিপ্লেস করা যায়নি। ‘মহানায়ক’ শব্দটা যতটা না খ্যাতির, তার থেকেও অনেক বেশি কাছের, অনেক বেশি আত্মার। ঠিক যেমনভাবে আমরা ‘কবিগুরু’ বলে থাকি।
‘অভিনেতা শিবপ্রসাদে’র কি মহানায়কের কোনও চরিত্রে অভিনয় করার সাধ হয়? আমার কাছে এই প্রশ্ন এলে, একটা ঘটনার উল্লেখ করতেই হয়। একজন স্বনামধন্য পরিচালক একবার আমাকে বলেছিলেন, উত্তম কুমার অভিনীত কোনও একটি সিনেমার রিমেক তিনি করতে চান। এবং যে উপন্যাসটির রিমেক করতে চান, সেই ঔপন্যাসিকের সঙ্গে বসে তাঁর মিটিংও করিয়ে দিয়েছিলাম, যাতে স্বত্ত্ব পেতে তাঁর সুবিধে হয়, কিন্তু আমি প্রথমেই তাঁকে বলেছিলাম যে ছবিটি আমি করব না। এবং পরে কলকাতা শহরের খুব নামী একটি প্রযোজনা সংস্থা সেই সিনেমা তৈরি করে। সেই সংস্থার কর্ণধার আমার সঙ্গে বসতে চেয়েছিলেন, কথা বলেছিলেন, যদি উইন্ডোজ যৌথভাবে এই ছবিটির প্রযোজনা করে। কিন্তু আমি তাঁদের জানিয়েছিলাম, আমি কোনওদিন উত্তম কুমার অভিনীত কোনও সিনেমা প্রযোজনা কেন, সেটা নিয়ে ভাবতেও রাজি নই। কারণ উত্তম কুমার অভিনীত কোনও চরিত্রে আর কাউকে ভাবা যায় না, এবং সেই দুঃসাহসও আমার নেই।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.