সন্দীপ্তা ভঞ্জ: ‘যতক্ষণ টাকাপয়সা, সম্পদ রয়েছে, ততক্ষণই ব্যক্তির কদর’- সমাজে এহেন ধ্যানধারণা খুব একটা অপরিচিত নয়। কারণ তথাকথিত বাস্তববাদীদের কাছে আর্থিক সঙ্গতিকেই সাফল্যের মাপকাঠি হিসেবে ধরা হয়। সেভাবেই পারিপার্শ্বিক পরিসরে নির্ধারিত হয় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ‘ইমেজ’, সামাজিক মর্যাদা। ‘কালীধর লাপাতা’ ছবিতে অভিষেক বচ্চনের চরিত্রের মধ্য দিয়ে সমাজের সম্মুখে তেমনই একটি আয়না ধরার চেষ্টা করেছেন পরিচালক মধুমিতা সুন্দরারামন। কোনওরকম বার্তা নয়, প্রতিবাদের ‘ঠুনকো লম্বা-চওড়া বাতেলাবাজি হ্যাজ’ নয়, অথচ গল্প বলার ছলেই সমাজের মুখোশ খুলে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন পরিচালক।
আজকের ব্যস্তজীবনে মানুষের জীবনদর্শন কিংবা চিন্তাধারার জটিল সুতোয় এই কালীধর নামক টানটার প্রয়োজন ছিল। যে কালীধর আমাদের চারপাশের এহেন অনেক সহজ-সরল মানুষের প্রতিনিধি। প্রচলিত ধ্যানধারণা কিংবা সমাজের তথাকথিত ‘গ্ল্যামারাস’ সম্ভ্রমের যাঁতাকলে পড়ে যে নিজের সারল্য় লুকিয়ে ‘অতিস্মার্ট’ হওয়ার চেষ্টা করে। তবে কালীধর কিন্তু তাঁদের থেকে ব্যতিক্রম। সে নিজের মনকে, পারিবারিক কিংবা পারিপার্শ্বিক যড়যন্ত্রের আঁচড়ে ময়লা করতে দেয়নি। স্মৃতিশক্তি লোপ পেলেও নিজের ভাই কিংবা ভাতৃবধূর সম্পত্তি হারানোর ষড়যন্ত্রকে কিন্তু বুঝতে ভুল করেননি। আর নিজের মানুষের বিশ্বাসঘাতকতা বাইরের জগতের ‘ঠুনকো বন্ধুত্বে’র বিশ্বাসভাঙার থেকে মনে আরও সজোরে চড় কষায়, সেটা কালীধর চরিত্রের পরতে পরতে বুঝিয়ে দিলেন অভিষেক বচ্চন। বুঝিয়ে দিলেন, গ্যাঁটে কড়ি না থাকা কিংবা অসহায় দুর্বল ব্যক্তির সুযোগ নিতে নিজের লোকেরাও পিছপা হয় না। তখন তাঁর কাছে ঘরের তুলনায় বহির্জগৎ বন্ধু হয়ে ওঠে। ‘লাপাতা’ হওয়া কালীধরের জীবনেও তেমনই এক ত্রাতা এসে হাজির হয়। বয়সে ছোট। তাতে কী? এখানেই আরেকটা প্রচলিত ধারণা ভাঙলেন পরিচালক। মস্তিষ্কবিভ্রাট হওয়া এক মানুষকে কীভাবে জীবনের মূলস্রোতে ফেরানো যায়, সেটা খুদে বাল্লুকে দিয়ে দেখিয়ে দিলেন মধুমিতা। হোক না ২০১৯ সালে মুক্তি পাওয়া তামিল ছবি কেডি-র (কারুপ্পু দুরাই) হিন্দি রিমেক, ট্রিটমেন্টে কিন্তু যতটা সম্ভব খামতি না রাখারই চেষ্টা করেছেন পরিচালক। বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে দর্শকদের মনে উঁকি দিতে কিংবা মনস্তত্ত্ব নিয়ে নাড়াচাড়া করার সাহস দেখালেন এক অসমবয়সি বন্ধুত্বের গল্পের মোড়কে। গল্পজুড়ে মন ভার করা মুহূর্তের যেমন ভিড়, তেমনই একরাশ ঠান্ডা বাতাসের আমেজ দিলেন শিশুসারল্যে পরিপূর্ণ দুই বন্ধুর মজার কিছু মুহূর্ত দেখিয়ে।
একমুখ দাড়ি, বিধ্বস্ত চেহারা, আলুথালু বেশ, ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত এক মধ্যবয়সি যুবক ‘কালীধর’-এর ভূমিকায় অভিষেক বচ্চন। পরিবারের কাছে ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত কালীধর এক বোঝা। কিংবা তাঁর রোগকে ‘বড়লোকদের রোগ’ বলে তকমা সাঁটা হয়। তাঁর চিকিৎসার টাকা জোগানোর জন্য কোনও ‘গৌরী সেন’ এগিয়ে আসে না। সাংসারিক রাজনীতির দাবার চালে যে ব্যক্তির অস্তিত্ব সম্পত্তির জন্য শুধুমাত্রই এক ‘বোরে’ ছাড়া আর কিছুই নয়! একে স্মৃতিভ্রষ্ট হয়ে যাওয়া যুবক। উপরন্তু চালচুলোহীন। সম্পত্তি হাতিয়ে নিতে কোনও সমস্যা হওয়ার কথাই নয়। তবে স্মৃতিশক্তি লোপ পেলেও তাঁর মননজগতের অস্তিত্ব রয়েছে। আবেগ রয়েছে। তাই পারিবারিক ষড়যন্ত্র বুঝে ‘লাপাতা’ হওয়া ‘কালীধরে’র কেটে পড়ার সঙ্গে দর্শকদের আত্মস্থ হতে সময় লাগে না। কারণ বিষয়-আশয়, সম্পত্তির তুল্যমূল্যে এহেন ভোগান্তি, নিজের মৃত্যুকামনা করা মানুষের সংখ্যা চারপাশে কম নয়। ‘কালীধর লাপাতা’ দেখার পর দর্শক হিসেবে আবারও আক্ষেপ হল, বক্স অফিসে তুখড় ব্যবসা দিতে অপারগ ‘অভিনেতা’ অভিষেক বচ্চনকে বলিউড খুব একটা এক্সপ্লোর করছে না। দিনের শেষে এই সিনেমার গল্পের মতোই ব্যবসা, টাকাপয়সার হিসেব-নিকেশের জালে জর্জরিত এক অভিনেতা হয়েই রয়ে গেলেন তিনি! আর কিশোর বাল্লুর মতো যদি একটা বন্ধুর হাত এসমাজের সব কালীধরদের কাঁধে থাকত, তাহলে সমাজের চিত্রটা এতটা হিংস্র, রূঢ়, কঠোর হত না। কারণ না পাওয়া থেকেও অপরাধপ্রবণ মানসিকতা তৈরি হয়। তবে কালীধরের ‘কিছু না পাওয়া’র জীবনে বাল্লু ঈশ্বরের দূতের মতো অবতরণ করে। বয়সে বড় বন্ধুর শখপূরণ করতে কোনও কসরত বাকি রাখে না সে। শিশুসুলভ সারল্যে সে যখন বিরিয়ানি খাওয়ার কিংবা বাইক চালানোর আবদার রাখে, সেই শখও পূরণ করে খুদে বন্ধু বাল্লু। দুটো স্বজনহারা মানুষ কীভাবে একে-অপরের শক্ত, শান্তির আশ্রয় হয়ে ওঠে, মধুমিতা খুব দক্ষহাতে সেগল্প দেখিয়েছেন ছবিতে। ছবির সবথেকে বড় ইউএসপি, চরিত্রগুলোর মধ্যে কোনওরকম অতিরঞ্জন নেই। আর সেটাই এই গল্পকে আরও বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছে। তবে শেষপাতে একটাই আক্ষেপ, প্রায় সুস্থ হওয়া কালীধর বাল্লুর জন্য ঘুরে দাঁড়ানোর পর কেমন ‘গুরুদক্ষিণা’ দিল? সেটার খুব একটা বিশ্লেষণ দেখা গেল না! তবে কারও জীবনের ‘বাল্লু’ হয়ে ওঠার পাঠ প্রয়োজন হলে জি ফাইফে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘কালীধর লাপাতা’ দেখে নিতে পারেন। এই সমাজে প্রত্যেকের জীবনে একটা বাল্লুর দরকার। যে ভূমিকায় অভিনয় করে চমকে দিল খুদেশিল্পী দৈভিক বাঘেলা।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.