বিদিশা চট্টোপাধ্যায়: প্রমিতা ভৌমিকের ডেবিউ ছবি ‘অহনা’। এই ছবি একেবারে আমাদের জীবনের গল্প বলে। আমাদের ভিতর ঘরের কথা বলে। নারী এবং পুরুষের সম্পর্কে অনুভূতি আদান প্রদানের জায়গায় কীভাবে ব্যারিকেড তৈরি হয় সেই কথা বলে। আর এই ব্যারিকেড ধীরে ধীরে এমন দূরত্ব তৈরি করে যেখানে বিচ্ছেদ ছাড়া আর অন্য পথ থাকে না। অহনা (সুদীপ্তা চক্রবর্তী), তার প্রফেসর হাজব্যান্ড রুদ্রনীল (জয় সেনগুপ্ত) এবং শ্বশুরকে (সৌম্য সেনগুপ্ত) নিয়ে মূলত ছবির গল্প। রুদ্রনীল ইনফার্টাইল তাই তাদের স্বাভাবিক নিয়মে সন্তান ধারণে একটা সমস্যা রয়েছে। যত দিন যায় রুদ্রনীল হীনমন্যতায় ভুগতে থাকে এবং ক্রমাগত সেই চেপে রাখা অনুভূতির প্যাসিভ অ্যাগ্রেসিভ প্রকাশ ঘটে চলে যা অহনাকে ক্ষতবিক্ষত করতে থাকে। অহনার লেখালেখি, সাহিত্যে পুরস্কার পাওয়া এই সব কিছুকেই রুদ্রনীল যতটা সম্ভব খাটো করে দেখতে চায়, দেখাতে চায়। রুদ্রর মুখে কোনও স্বাভাবিক হাসি নেই, সে কখনওই অহনার মতো সহজ হয়ে মিশতে পারে না, ভালোবাসতে পারে না, নিজেকে চালনা করতে পারে না।
অহনা নিজের শ্বশুর, বোন এবং ছোটবেলার বন্ধু আদিত্যর (নবাগত প্রিয়ব্রত সেন সরকার) সঙ্গে সৎভাবে, সহজ একটা কথোপথন চালাতে পারে, কিন্তু রুদ্র কারও সঙ্গেই সহজ নয়। ছবিটা দেখতে দেখতে মনে হয় পুরুষের ইনফার্টিলিটি তো একটা অজুহাত মাত্র, প্রমিতা ভৌমিকের ছবির শিকড় আসলে অনেক গভীরে যার তল পাওয়া অত সহজ নয়। ছবিটা অহনার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখা, আসলে সেটা যেন পরিচালক নিজেই, এমনটাই বারবার মনে হয়। ‘অহনা’ নারীপ্রধান ছবি কিন্তু এই ছবি আরও এক কারণে বাকি নারীপ্রধান ছবির থেকে আলাদা হয় কারণ পরিচালক টক্সিক পুরুষ চরিত্রটিকে ভিলেন প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেন না। আসলে বিষয়টা এমন সাদাকালো নয় যে। এখানে অহনা এবং রুদ্রনীল (জয় সেনগুপ্তর দুর্দান্ত অভিনয়) দুজনেই পিতৃতন্ত্রের শিকার। আপাতদৃষ্টিতে রুদ্রনীলকে ভিলেন মনে হলেও, আমরা বুঝতে পারি সে ক্রমশ নিজের মধ্যে একটা লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। সে জানে তার মুখনিঃসৃত প্রতিটা শব্দ অ্যাবিউসিভ, কিন্তু সে অন্য পথে হাঁটতে অপারগ। কে যেন তাকে দিয়ে সব বলিয়ে দেয়, পড়ুন পিতৃতন্ত্র। সুবুদ্ধি তাকে বলে থেরাপিস্টের কাছে যাওয়া উচিত, সে একবার যায়ও কিন্তু তার পরেই সে বেঁকে বসে। নাহ্, নিজেকে সংশোধন করতে সে অপারগ, এর চেয়ে ছাত্রছাত্রীদের পরীক্ষার খাতা দেখা কিংবা নারীকল্যাণ নিয়ে লেকচার দেওয়া অনেক সহজ।
বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে এই সমস্যা যেন অতিমারীর মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন পুরুষসঙ্গী হলে কী করবে নারী? সে কি আরও ধৈর্য ধরবে, যাতে নিজের পুরুষসঙ্গীর মনের শুশ্রূষা করা যায়, না কি নিজের মনের যত্ন নেবে? পরিচালক মনে করিয়ে দেন, নারী তার পুরুষ সঙ্গীর সংশোধনাগার নয়। তাই অহনা নিজেকেই বেছে নেয়। এবং আমাদের আশপাশের অহনারাও তাই করছে। যে কারণে চল্লিশোর্ধ্ব মহিলাদের ডিভোর্সের হার অনেক বেশি। আমাদের পিতৃতান্ত্রিক সমাজে শেখানো বুলি ভুলে মেয়েদের নিজের চাওয়া পাওয়া বুঝতেই অনেকটা সময় লেগে যায়, নিজেকে চিনতে অনেকটা সময় লেগে যায়, নিজের ভিতরের আলো কোন পথনির্দেশ করছে সেটা জানতেই অনেকটা সময় লেগে যায়। আর বেশিরভাগ পুরুষ নিজের মনের তল পর্যন্ত কিংবা নিজের মুখোমুখি দাঁড়ানোর সাহস সারা জীবনেও সঞ্চয় করতে পারেন না। তাই অহনা দোষারোপ না করেই সরে আসে, নতুন পথ ধরে হাঁটাবে বলে। প্রমিতা ভৌমিকের ছবি এই সত্যিটা খুব যত্ন করে, খুব সহজ ভাষায় তুলে ধরে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.