Advertisement
Advertisement
Devi Chowdhurani Film Review

‘দেবী চৌধুরানী’র ধ্রুবপদ ভবানী পাঠকই, বঙ্কিমের মেঘ সরিয়ে রক্তাক্ত রিয়েলিটি দেখালেন পরিচালক

কতটা জমল 'দেবী চৌধুরানী'? পড়ুন রিভিউ।

Prosenjit Chatterjee starrer Devi Chowdhurani Film Review
Published by: Sandipta Bhanja
  • Posted:September 27, 2025 2:13 pm
  • Updated:September 27, 2025 5:02 pm   

শুক্রবার মুক্তি পেল শুভ্রজিৎ মিত্র পরিচালিত দেবী চৌধুরানী। পুজোর পর্দায় বহু প্রতীক্ষিত এই পিরিয়ড ড্রামা দেখে বঙ্কিম-স্মরণে কলম ধরলেন রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

Advertisement

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় শ্রীচরণেষু,

শুভ্রজিৎ মিত্র পরিচালিত সিনেমায় আপনার ‘দেবী চৌধুরানী’ দেখার পর, প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় অভিনীত ‘ভবানী পাঠকে’ আচ্ছন্ন, উন্মত্ত এবং প্রণোদিত হয়ে আপনাকে এই পত্র। আমি জানি সিনেমা শব্দের অর্থ আপনি জানেন না। আপনাকে বোঝাতেও পারব না। শুধু এইটুকু জ্ঞাত হোন, সিনেমা এক মহামায়া যা আমাদের চোখের সামনে রঙিন ছবির চলন্তিকাতে দৃশ্যের পর দৃশ্যে একেবারে জ্বলজ্যান্ত করে তুলেছে আপনার আগ্নেয় উপন্যাস কিংবা নারীশক্তি ও জাগৃতির মহাকাব্য ‘দেবী চৌধুরানী’কে রক্তমাংসে, মনেপ্রাণে, মানবমানবী অস্তিত্বের প্রবল প্রবাহে। ২০২৫-এর বাংলাব্যাপী দুর্গাপুজোর মধ্যে এই ছবি সমস্ত বাঙালিকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে আপনার মতো এক আকাশস্পর্শী হিরন্ময় বাঙালি লেখকের শ্রীচরণে মাথা রাখতে। আর আমার মনে পড়ল ঠিক ১৪৩ বছর আগে, ১৮৮২-র সেই পরম মুহূর্ত যখন কটকের জাজপুরে, কোনও এক নিদ্রাহীন গভীর রাত্রে, চুয়াল্লিশ বছর বয়সে, মোমের আলোর মৃদু দীপনে, আপনি শুরু করলেন আপনার উপন্যাস ‘দেবী চৌধুরানী’। কী সৌভাগ্য বাঙালির, ক’ দিনের মধ্যে শ্রাদ্ধের অনুষ্ঠানে আপনাকে আসতে হল কলকাতার শোভাবাজারের রাজবাড়িতে! সেখানে ইংরেজ পাদ্রি হেস্টি আপনাকে খোঁচা দিলেন হিন্দু ধর্ম, কুসংস্কার এবং বাঙালির দুর্বলতা ও ভীরুতা নিয়ে। আর অমনি দপ করে জ্বলে উঠলো বঙ্কিম আপনার ভিসুভিয়াস বৈদগ্ধ, মেধা এবং আপনার অনুশীলন তত্ত্বের আগুন। এবং পাদ্রি হেস্টির সঙ্গে আপনার দুর্বার তর্কের নির্মাণ থেকে ঝরে পড়ল এক চিরায়ত ফসল– ‘দেবী চৌধুরানী’, যে নারী পুরোনো হওয়ার নয়, যে নারী আজও এই ২০২৫- এর দুর্গাপুজোর মধ্যে হয়ে উঠতে পেরেছে পুরুষশাসিত সমাজে নারীশক্তির পরম উদযাপন।

বঙ্কিম, ২০২৫-এও এই বিপুল শক্তি পুজোর মধ্যে আপনার ভবানী পাঠকই একমাত্র নায়ক। আপনার দেবী চৌধুরানী একমাত্র নায়িকা। এবং আপনার লেখার ক্লাসিক মাহাত্ম্য আজও পাচ্ছে বাঙালি মনের আরাত্রিক। বাঙালি হৃদয়ের শতকোটি প্রণাম। প্রসঙ্গত বলে রাখি, পরিচালক শুভ্রজিৎ আপনার গল্পকে বদলেছেন দূরন্ত দুঃসাহসী ছবির অন্তে। শেষের এই পরিবর্তন তোলা থাক দর্শকের আচমকা প্রাপ্তির জন্য। কিংবা ধাক্কা ও বিকর্ষণের জন্য। যাঁর যেমন প্রবণতা তিনি সেই ভাবে নেবেন ধ্রুপদী সাহিত্যের আধুনিক বিন্যাস। মনে রাখতে হবে, দেবী চৌধুরানী ও ভবানী পাঠক গালগল্প নয়, জ্যান্ত ইতিহাস। সেই ইতিহাসকে তাঁর সময়ের রোমান্টিকতায় কিছুটা মেঘলা করেছেন বঙ্কিম। শুভ্রজিৎ মেঘ সরিয়ে রক্তাক্ত রিয়েলিটি এমব্রেস করেছেন। আমার ভালো লেগেছে নারীশক্তির এই প্রবল প্রকাশ, এই প্রান্তিক প্রতিশোধ, প্রতিশ্রুতি নব অভিযানের। শুভ্রজিতের দেবী চৌধুরানী ফুরিয়ে যায় না। সময় বৃত্তের বাইরে এই নারীর বিপ্লবী বহতা পাল তোলে। আর প্রসেনজিতের ভবানীচরণ পাঠক? এক কথায়, প্রসেনজিতের জীবনে এটাই কি নয় তাঁর সব চেনা মাত্রা অতিক্রান্ত শাণিত শ্রেয়? আমার মতে ভবানী পাঠকই তাঁর অভিনয়ের ধ্রুবপদ! তাঁর বিজয় বৈজয়ন্তীর এভারেস্ট!

Devi-Chowdhurani

সাল ১৭৭২। মুঘল সাম্রাজ্য অবসিত। হেস্টিংস বাংলার লাট। এবং সমগ্র বাংলার শোচনীয় অবস্থা। নতুন ব্রিটিশ শাসন হালে পানি পাওয়ার নির্মম চেষ্টা চালাচ্ছে। এই অনিকেত সন্ধিস্থলে ভবাণীচরণ পাঠকের আবির্ভাব এক অস্ত্রধারী সাধক, নারী শক্তির আরাধক, শিরায় শিরায় ব্রিটিশ বিরোধী, নির্লোভ, উদার, সুপণ্ডিত হিন্দু অথচ আপাত ডাকাত, এতগুলি বিপ্রতীপ গুণের নাটকীয় সমন্বয়ে! বঙ্কিমের আনন্দমঠ যেমন বীরভূমের। সীতারাম যেমন সমুদ্রতীরের ভুষনার। দেবী চৌধুরানী এবং ভবানী পাঠক তেমন রঙ্গপুরের। শোভাবাজারের রাজবাড়িতে পাদ্রি হেস্টির সঙ্গে তর্কে বঙ্কিম বলেছিলেন, তিনি তাঁর আসন্ন উপন্যাসে ফিরিয়ে আনবেন দেবী চৌধুরানীকে এক বজরাবাসিনী বাঙালি জলদস্যু রূপে। আর সেই আসন্ন উপন্যাসের মেরুদণ্ড হবে এক নারীশক্তির সাধক, অসীম সাহসী, স্বাধীনতা সংগ্রামী হৃদয়বান আল্টিমেট হিন্দু ভবানী পাঠক। বঙ্কিম, আপনাকে করজোড়ে জানাই,বাংলা ভাষার খুব কম উপন্যাসই আপনার ‘দেবী চৌধুরানী’র আবেগময়তায়, ব্যাপ্তিতে, মেহেরবানে উত্তীর্ণ হতে পেরেছে। এবং এই পরম সত্য এবং চরম চ্যালেঞ্জ শুষে নিয়েছেন রক্তমাংসে সত্য হয়ে ওঠা ভবানী পাঠক প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। ভবানী পাঠককে তিনি গ্রহণ করেছেন তাঁর ধ্যানে। আত্মস্থ করেছেন তাঁর মননে। জারিয়েছেন তাঁর নিভৃত ম্যারিনেশনে। ঠিক যতটা শেক্সপিয়রের হামলেট লরেন্স অলিভিয়েরের, ম্যাকবেথ পিটার ও’ টুলের, ঠিক ততটাই ভবানী পাঠক প্রসেনজিতের।

প্রসেনজিতের পাশে শ্রাবন্তী চট্টোপাধ্যায় এতটা জান লড়িয়ে যে ‘প্রফুল্ল’ থেকে ‘দেবী চৌধুরানী’ হয়ে উঠতে পারবেন, ভাবতে পারিনি। বোঝা যায় তিনি নিংড়ে দিয়েছেন নিজেকে। অনন্য অভিনয় অর্জুন চক্রবর্তীর রঙ্গরাজের চরিত্রে। ‘নিশি’র চরিত্রে বিবৃতি চট্টোপাধ্যায় সারপ্রাইজ। চমৎকার মানিয়েছে দেবী চৌধুরানীর শ্বশুর জমিদার হরবল্লভবেশী সব্যসাচী চক্রবর্তীকে। দেবী চৌধুরানীর স্বামী ব্রজর চরিত্রে কিঞ্জল নন্দ নিচু চাবির অভিনয়ে থেকেও নেই। অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়ের ক্যামেরা ছবির বড় আকর্ষণ। এ ছবির সঙ্গীত পরিচালক বিক্রম ঘোষ ব্রিলিয়ান্ট। কিন্তু এই বছর বাঙালির দুর্গাপুজোয় প্রধান অতিথি, দেবী চৌধুরানীর সৌজন্যে, তুলনাহীন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, তাঁর আকাশছোঁয়া সিংহাসনে। সব পথ শেষ হবে বঙ্কিমে!

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ