শম্পালী মৌলিক: বাইশ বছর পরে দেখা হচ্ছে দুটো মানুষের। শহর থেকে অনেক দূরে পাহাড় ঘেরা পরিবেশে। আনন্দী (ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত) আর অর্জুনকে (ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত) দেখে মনে হয় যেন তারা কখনও পরস্পরের থেকে দূরে যায়নি। তাই বলে সময় কি ছাপ রাখেনি তাদের জীবনে? একটু একটু করে পাতা ওল্টায় ইন্দ্রাশিস আচার্যর ছবি ‘গুডবাই মাউন্টেন’। ‘বিলু রাক্ষস’, ‘পিউপা’, ‘পার্সেল’, ‘নীহারিকা’র পর এটি তাঁর পঞ্চম ছবি। আগের ছবিগুলোর মতোই এই ছবির মেজাজও নিভৃতচারী।
পাহাড়, জঙ্গলের নীরবতায় মানুষের মনের অনুরণন ধরতে চেয়েছেন পরিচালক। নিশ্চিতভাবেই ভালোবাসার ছবি। প্রকৃতির বিশাল ক্যানভাসে কবিতার মতো সিনেমা বুনেছেন পরিচালক। একটা থেমে যাওয়া সম্পর্ক, অসম্পূর্ণ বৃত্ত পুনরায় আঁকা হয়। সংলাপের মাঝে কবিতার লাইন বুনে দিয়েছেন পরিচালক, যা ছবির আবহ নির্মাণ করে। জীবনানন্দ দাশের অব্যর্থ সে কবিতার লাইন ‘জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি কুড়ি বছরের পার/তখন আবার যদি দেখা হয় তোমার আমার!’– ইন্দ্রনীল সেনগুপ্তর কণ্ঠে শুনতে চমৎকার লাগে। কেরলের এক প্রান্তে পাহাড়ের কোলে একটা বাংলোয় থেকে গিয়েছে অর্জুন। দীর্ঘ বিরতির পর তার ডাকে দেখা করতে এসেছে আনন্দী। তাদের একসময় সম্পর্ক ছিল কিন্তু পরিণতি পায়নি। ছোট ছোট শিরোনামের মাধ্যমে গল্পটা এগিয়ে দিয়েছেন পরিচালক। কাহিনি-চিত্রনাট্য তাঁরই লেখা। ‘সত্যি কি ফিরে আসা?’ দিয়ে কাহিনি শুরু। যেন যেখানে শেষ হয়েছিল, সেইখান থেকেই শুরু হয় আবারও। মনে হয় অর্জুন শুধু আনন্দীর অপেক্ষাতেই ছিল। এই যুগে এমনও হয়? হয়তো হয়, নাহলে আর প্রেম কীসের! তারা ধীরে ধীরে পরস্পরের জীবনের ছন্দটা ধরতে পারছিল। কিন্তু সবটাই মসৃণ ভাবে ঘটে কী? আসলে ওই ‘কিছুই যায় না ফেলা…’, তারাও জানে। অর্জুন পাহাড়ি অঞ্চলটা ঘুরে ঘুরে দেখায় বান্ধবীকে, উঠে আসে পুরনো দিনের অনেক গল্প। এর মাঝেই বোঝা যায় অর্জুনের শরীর ঠিক নেই। কিন্তু সে কিছুতেই চায় না আনন্দী টের পাক। এক সময় অর্জুনের হোমস্টেতে আসে একদল কমবয়সি ছেলেমেয়ে। তাদের সঙ্গেও মিশে যায় তারা। বাইশ দিনের জন্য থাকতে এসেছিল আনন্দী। অর্জুন চেয়েছিল সেটা যেন বাইশ বছর থাকার সমান হয়। শর্ত ছিল কোনও প্রশ্ন ছাড়া বাইশ দিন কাটাবে তারা।
দুটো মানুষ পরস্পরকে এতগুলো বছর ধরে অন্তরে ধারণ করেছে, অথচ কেউ কাউকে বলেনি। উঠে আসে অতীতের ছাড়াছাড়ির বৃত্তান্ত। তবু তারা কাছে আসে। এমন সময় কলকাতা থেকে পাহাড়ে এসে আনন্দীর সঙ্গে যোগ দেয় তার বর রথীজিৎ। সে টের পায় এই বন্ধু ‘বিশেষ’। বর মুখে আনন্দীকে ‘সোলো ট্র্যাভেলার’ হওয়ার জন্য বাহবা দেয়। কিন্তু স্ত্রীর মনের অতলের খোঁজ সে পায় না। তাদের ছেলের প্রসঙ্গে স্ত্রীকে বলে, ‘প্রেম করছে বাবাই, দেখলেই বোঝা যায়।’ ইঙ্গিতটা চমৎকার! এক ছাদের তলায় রথী, অর্জুন, আনন্দী– রাতের এসরাজ সুর তোলে। পাওয়া না পাওয়ার ব্যথা নিয়ে ছবি নীরব প্রতিশোধের দিকে যায়। ঠান্ডা কিন্তু নিশ্চিত। ছবিটা দেখতে দেখতে মনে হয়, এত বছর পর দু’জনের দেখা হলো অথচ অভিমানে তোলপাড় করা মুহূর্ত তৈরি হবে না? পাহাড় এবং গুডবাই শব্দটা বিশেষ তাৎপর্য বহন করে ছবিতে। বাকিটা বড়পর্দায় দেখাই ভালো।
ওয়েনাড-এর প্রেক্ষাপটের জন্যই ছবিটা প্রেক্ষাগৃহে দেখার। শান্তনু দের সিনেমাটোগ্রাফি চোখের আরাম। ইন্দ্রনীল চমৎকার অভিনয় করেছেন প্রেমিকের চরিত্রে। ঋতুপর্ণা আনন্দীর ভূমিকায় স্নিগ্ধ, আদ্যন্ত স্বাভাবিক আর নিচু তারে বাঁধা। অনির্বাণ ভট্টাচার্য (সাংবাদিক, অভিনেতা) স্বামীর চরিত্রের অবিশ্বাস, ক্রূরতা, অসহায়তা দারুণ ধরেছেন। চিকিৎসকের চরিত্রে অনন্যা সেনগুপ্ত যথাযথ। এত কম চরিত্র নিয়ে দর্শকের মনযোগ ধরে রাখা শক্ত। সেক্ষেত্রে চিত্রনাট্য চড়াই-উতরাই দাবি করে। রণজয় ভট্টাচার্যর সুরে গানগুলো শ্রুতিমধুর। পরিচালক ইন্দ্রাশিস এই ছবির জন্য একটি গানও লিখেছেন (কালা মধু), ভালো লাগে। ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোরের ক্ষেত্রে বলা যায় একটি বিখ্যাত বিদেশি ছবির মিউজিকের সঙ্গে কিছুটা সাদৃশ্য সিনেপ্রেমীদের মনে আসতে পারে। শেষভাগে অর্জুনের একটি দীর্ঘ সলিলকি মন ছুঁয়ে যায়। যার মূল নির্যাস যে, জীবনটা আমি তোমার সঙ্গে পেতে চেয়েছিলাম তা পাইনি। তাই এই কটা দিন…। তবে এই ক’টা দিনের জন্য তোমার ক্ষতি হয়ে যাক তাও চাইনি। স্তব্ধ হয়ে দেখতে হয়। আজ মুক্তি ছবির। নিশ অডিয়েন্সের হলেও, প্রেমের ছবি, মনে রাখার ছবি।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.