Advertisement
Advertisement

বাঙালির ভুলে যাওয়া দীপ্তিময়ীকে ফিরিয়ে দিল ঋতুপর্ণার ‘বেলা’, পড়ুন রিভিউ

শেষ দৃশ্যে চোখে জল আসবেই, যে দৃশ্যে ঋতু পেরিয়ে যাচ্ছে আলোর দরজা।

Rituparna Sengupta starrer Bela Film review
Published by: Sandipta Bhanja
  • Posted:August 29, 2025 2:33 pm
  • Updated:August 29, 2025 2:33 pm   

রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়: অল ইন্ডিয়া রেডিও, মহিলামহল, বেলা দে, এক সময়ের বাঙালির মনেপ্রাণে জড়িয়ে গিয়েছিল এই তিনটি নাম। বিশেষ করে বাঙালি মেয়ে, সাধারণ বাঙালি মেয়ের আটপৌরে যাপন এবং পুরুষ শাসিত, সংস্কার আচ্ছন্ন সমাজে তার নিঃসঙ্গ লড়াই, তার এই জাগৃতি ও নিজেকে খুঁজে পাওয়ার যাত্রা, তার অহং এবং আত্মসম্মানকে পাপোশ থেকে তুলে নিজের পায়ে দাঁড় করানোর সাহস ও শক্তি, এই সব কিছুর সঙ্গে একদিন ওতপ্রোত হয়ে গিয়েছিল বেলা দে-র নাম। এই সময়টা অনেক বাঙালির কাছেই এখন ধূসর পান্ডুলিপি। তখন সবে রবীন্দ্রনাথ মারা গেলেন। সবে ভারত স্বাধীন হল। রবীন্দ্রনাথের অবসান এবং স্বাধীন ভারতের প্রথম মধ্যরাত এবং জওহরলাল নেহরুর সেই ধ্রুপদী ভাষণ, সব আছে অনিলাভ চট্টোপাধ্যায় পরিচালিত ‘বেলা’ ছবিতে। সেই দূরের সময়ের কিছু মানুষ, তাদের মনকেমন এবং নস্টালজিয়া নিয়ে আজও থেকে গেছে আমাদের মধ্যে। সেই অতীত সঞ্চারী অবশিষ্টদের আমি একজন। আমার কানে লেগে আছে এখনও ইন্দিরাদির (মধুজা বন্দ্যোপাধ্যায়) ছোট্ট সোনা বন্ধুরা, আদর আর ভালবাসা নাও, নীলিমা সান্যালের (বাসবদত্তা চট্টোপাধ্যায়) উজ্জ্বল উচ্চারণে সংবাদ পাঠ এবং বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের (দেবপ্রতিম দাশগুপ্ত) কত না অনুষ্ঠান!

Advertisement

আমাদের বাল্যকাল, কৈশোর, যৌবনের কেন্দ্রে ছিল আকাশবাণী কলকাতা। আর সেই সময়ে বেলা দে হয়ে উঠতে পেরেছিলেন বাঙালি মেয়েদের রোল মডেল, তাদের মানস সঙ্গিনী, তাদের উপদেষ্টা, তাদের প্রেরণা। আমার ভালো লাগত বেলার কণ্ঠস্বরে সততা, প্রত্যয়, জীবনযুদ্ধের আঁচ।ভালো লাগত বেলা যেভাবে বাঙালি মেয়েদের সব সামাজিক এবং অর্থনৈতিক বাধা অতিক্রম করে এগিয়ে যাওয়ার পথ দেখাতেন। এবং প্রশ্ন জাগত মনে, কোথা থেকে এই মরা দেশে বেলা পান লড়াকু শক্তি, আত্মবিশ্বাস, সব পরাজয়কে হারিয়ে দেওয়ার শিরদাঁড়া। স্বীকার করছি, জানতাম না বেলার জীবনের গল্প, জানতাম না তার জীবনই সেই আগ্নেয়গিরি যার মধ্যে লুকিয়ে জ্বলন্ত লাভাস্রোত! পরিচালক অনিলাভ একটা বড় কাজ করেছেন। বাঙালির ভুলে যাওয়া এক একদা দীপ্তিময়ীকে ফিরিয়ে এনেছেন তাঁর প্রথম ফিচার ফিল্মে। এই ছবি আজকের বাঙালি মেয়ে দেখলে বুঝবেন আমাদের সমাজে এক সময় বাঙালি মেয়েকে কী করুণ লড়াই করতে হয়েছে। এবং বাড়ি থেকে বিতাড়িত হতে হয়েছে চাকরি করার অপরাধে। বেলা তখন স্কুলে পড়েন। স্কুলের অনুষ্ঠানে বেলার গান শুনে মুগ্ধ হলেন এক রায়বাহাদুর। এবং ছেলে হীরেন দের সঙ্গে বিয়ে দিলেন বেলার। হীরেন (ভাস্বর চট্টোপাধ্যায়) বিলেতে চলে গেলেন বিয়ের পরেই ডাক্তারি পড়তে। এবং ধীরে ধীরে স্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করলেন। বেলা কলকাতায় লেখাপড়া শিখে ঠিক করলেন লন্ডন যাবেন স্বামীর মুখোমুখি হতে। জানতে, কেন তাঁর স্বামী তাঁর সঙ্গে সমস্ত যোগাযোগ ছিন্ন করেছেন। তাঁর এক দাদাকে (পদ্মনাভ দাশগুপ্ত) সঙ্গে নিয়ে বেলা উঠলেন লন্ডনের জাহাজে। লন্ডনে স্বামীর মুখোমুখি হলেন বেলা। স্বামীর ব্যবহার রূঢ় এবং বেলার এই ভাবে লন্ডনে এসে পড়ায় অত্যন্ত বিরক্ত। এবং ধীরে ধীরে বেলাকে দাঁড়াতে হল এক নির্মম সত্যের সামনে। তোলা থাক সেই রহস্য। বেলা বুঝলেন তাঁকে যেভাবে হোক নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। স্বামীর কাছে তিনি হার স্বীকার করবেন না। শেষ হাসিটা তিনিই হাসবেন। বেলা লন্ডন ছাড়লেন না। এক সহৃদয় মেমসাহেবের সাহায্যে এবং পরামর্শে তিনি ভর্তি হলেন লন্ডনের হোম সায়েন্সের ক্লাসে। তখন এদেশে হোম সায়েন্সের কোনও চর্চা হত না। বেলা লন্ডনে রান্না, বোনা, আঁকা এবং নানারকম হাতের কাজ শিখে তৈরি হলেন জীবনযুদ্ধের জন্যে এবং দেশে ফিরলেন।

এবার আসি বেলার ভূমিকায় ঋতুপর্ণার অভিনয় প্রসঙ্গে। কী ধীর স্থির ঋজু বলিষ্ঠ এবং চাপা আঁচের অভিনয় কী বলব! ঠিক আমি যেমন দেখেছি বেলা দে কে! বেলার ভেতরে যে আগুনটা ছিল, সেটা ফুটে উঠত তাঁর ব্যক্তিত্বে। এবং তাঁর ব্যক্তিত্বই ছিল তাঁর গ্ল্যামার। এই ব্যাপারটা ঋতু আস্তে আস্তে অভিনয়ে অবলীলায় ফুটিয়ে তুলেছে । এই ছবির কাছে সব থেকে বড় প্রাপ্তি ঋতুপর্ণার বেলা। সেই বেলাভূমিতে যে কত রকমের ঢেউ, কত রকম আবেগের খেলা, দেখার মতো। প্রতিটি দৃশ্যে ঋতু বুঝিয়ে দিয়েছে তার কোনও বিকল্প নেই। শেষ দৃশ্যে চোখে জল আসবেই, যে দৃশ্যে ঋতু পেরিয়ে যাচ্ছে আলোর দরজা। আরও একটি দৃশ্য মনের রাখার মতো মুহূর্ত: এই দৃশ্যে বেলার দেখা হচ্ছে কলকাতায় তার স্বামীর সঙ্গে। এই দৃশ্যে ঋতু কয়েকটি মাত্র কথা বলছে। জাস্ট অসাধারণ! বেলার মা-বাবার চরিত্রে ভদ্রা বসু এবং বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী। ভদ্রাকে অনেকদিন পরে দেখলাম। বেশ লাগল। মিষ্টি অভিনয়। বিশ্বজিৎ আমার প্রিয় অভিনেতা। সবসময় ভাবনা থাকে তাঁর হাবেভাবে। এবং মাপে কখনও ভুল হয় না। বেলার আরও এক দাদার চরিত্রে দেবদূত ঘোষ ভালো-খারাপের মিশেলটা চমৎকার এনেছেন। ইন্দিরা দেবীর চরিত্রে মধুজার ঝলক আর একটু পেলে ভালো হত। আর বুলবুল সরকারকে গার্স্টিন প্লেসের রেডিও অফিসের সিঁড়িতে বুলবুল নামে শুধু এক চিলতে পেলাম। শিবনাথ শাস্ত্রীর নাতনির মেয়ে গর্জিয়াস বুলবুল সরকারের ‘কলিং অল চিলড্রেন’ অনুষ্ঠানে তাঁকে দেখে আমার দশ বছর বয়সের অবাক মুগ্ধতা আজও মনে চুইংগামের মতো লেগে আছে। বেলার বন্ধু নির্মল ভট্টাচার্যর ভূমিকায় সৌরভ চক্রবর্তীর সংবেদী অভিনয় মন ছুঁল। দুটি কোরিক চরিত্রে জগন্নাথ বসু এবং মীর নিজেদের নামেই উপস্থিত নির্ভুল বাস্তবের টাচ দিতে। শেষে তিনটি খুব জরুরি কথা। অনিলাভ যে তাঁর প্রথম ফিচার ফিল্মের জন্যে বেছে নিলেন মহিলা মহলের বেলাকে, তাঁকে অভিনন্দন। মানসী সিনহাকে অভিনন্দন রেডিও অফিসে ভূত দেখে তাঁর ভয় পাওয়ার দৃশ্যের জন্যে। আর, ঋতুকে অভিনন্দন ঋতু ঋতু বলে!

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ