Advertisement
Advertisement

Breaking News

Mrigaya: The Hunt Film Review

মেনস্ট্রিম বাংলা ছবির নতুন রোডম্যাপ ‘মৃগয়া’, কেমন হল? পড়ুন রিভিউ

বলিউডি অবাস্তব সিক্স প্যাক নয়, ঋত্বিক-অনির্বাণরা বুঝিয়ে দিলেন বাঙালি পুলিশ বাজিমাত করতে পারে নিজস্ব আটপৌরে বুদ্ধিদীপ্ত ঘরানায়।

Ritwick, Anirban, Vikram starrer Mrigaya: The Hunt Film Review
Published by: Sandipta Bhanja
  • Posted:June 28, 2025 7:44 pm
  • Updated:June 28, 2025 9:55 pm  

বিদিশা চট্টোপাধ্যায়: ‘মৃগয়া’ মেনস্ট্রিম কমার্শিয়াল কপ থ্রিলারের নতুন টেমপ্লেট হতে চলেছে এবং বাংলা বিনোদনের মূলধারার মানচিত্র বদলে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। স্বল্প বাজেটে, বড় প্রোডাকশন হাউস এবং কেবল ‘স্টার’ পাওয়ার ছাড়াও যে এমন দুর্দান্ত এন্টারটেনার তৈরি হতে পারে তা প্রমাণ করে দিল এই ছবি। কারণ পরিচালক অভিরূপ ঘোষ তাঁর ‘মৃগয়া’র জন্য বাছাই করা শিকারীদের নিযুক্ত করেছেন। অভিনয়, চিত্রনাট্য (অভিরূপ ঘোষ, সৌমিত দেব, অরিত্র বন্দ্যোপাধ্যায়) সংলাপ (সৌমিত দেব), ক্যামেরা (শুভদীপ নস্কর), ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর (অম্লান চক্রবর্তী ও ববি), এডিটিং (সুমিত) এই ছবির সম্পদ এবং অনেকটা এগিয়ে দেয়। শুধু তাই নয়, একটা কমার্শিয়াল অ্যাকশন থ্রিলার ছবিতে মনোরঞ্জনের সমস্ত উপকরণের সঙ্গে রয়েছে সামাজিক বার্তাও। দেহ ব্যবসায়ীদের প্রসঙ্গর পাশাপাশি আছে কনসেন্টের কথা, যেটাকে ভদ্র সমাজ ‘অক্সিমোরন’ হিসেবেই ভাবেন।

দেবাশিস দত্তর গল্প এই বাংলা ছবিকে দক্ষিণ কলকাতার ড্রয়িং রুম থেকে বের করে উত্তর কলকাতার রেড লাইট এরিয়ার ক্রাইম জোনে এনে ফেলেছে। আর সেইখানেই আবির্ভাব এই মারকাটারি চতুষ্কোণের! চার পুলিশ অফিসার- ঋত্বিক চক্রবর্তী (দেবাঞ্জন) , বিক্রম চট্টোপাধ্যায় (অনিমেষ), অনির্বাণ চক্রবর্তী (রুদ্র) এবং রিজওয়ান রাব্বানী শেখ (ইমরান)। ওহ, তাদের সঙ্গে পাল্লা দিতে বাংলা সিনেমার মানচিত্রে নতুন ‘গব্বর’। অবাঙালি এবং ভীষণভাবে মার্জিনালাইজড সম্প্রদায়ের ভিলেন ‘সর্দার’- দুর্ধর্ষ সৌরভ দাস। বাংলা সিনেমায় খলনায়কের নতুন সংজ্ঞা তৈরি করলেন অভিনেতা সৌরভ, একথা বললেও ভুল হবে না। তবু ‘মৃগয়া’ দেখার পর থেকে ভাবছি এত ভালো লাগলো কেন? পর্দায় যা দেখলাম, তার চেয়েও বেশি কিছু নিয়ে বাড়ি না ফিরলে তো এমনটা হয় না। এই ছবিতে বিচ্যুতি নেই, এমনটা তো নয়। সেসব তো আছেই, তবু সেসব আর মাথায় রাখতে ইচ্ছে করে না। চাবুকের মতো সংলাপ, দুর্দান্ত অ্যাকশন, থ্রিলার গল্প ছাপিয়ে মনে রয়ে যায় এই চারজন। এবার এই চার অফিসার আসলে কে বা কারা? এদের মনে থাকে কেন? অভিনয় এই ছবির শিরদাঁড়া সেটা মেনে নিয়েই বলছি, এই ভালোলাগা কি কেবল ব্রিলিয়ান্ট অভিনয় নাকি চরিত্রায়ণের কারণেও? আসলে দুটোই। ঋত্বিক চক্রবর্তী পর্দায় যেটা করেছেন, সেটা ম্যাজিক ছাড়া আর কিছু না। সেটা ডিসাইফার করা অত সহজ নয়। আর তিনি ঠিক কী করে ফেলেন, সেটা ধরতে পারা যায় না বলেই তাঁর সংলাপের পাঞ্চলাইনগুলো আলাদা করে ‘দেখ কেমন দিলাম’ গোছের ডায়লগ হয়ে থেকে যায় না- যা অন্য বাংলা ছবির কপভার্সে দেখে থাকি। ঋত্বিক সংবাদ প্রতিদিনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘মৃগয়া’ বললে যেমন মিঠুন চক্রবর্তীর কথা মনে পড়ে, তেমনই তাঁর কথাও মনে পড়তে পারে। এবং মনে পড়বেই। অন্যদিকে অনির্বাণ চক্রবর্তী কেন বাংলা ছবিতে অপরিহার্য হয়ে উঠেছেন, আবারও সেটা প্রমাণ করে দিলেন ইন্টারভ্যালের সময় এসেও। এই দুই অভিনেতা বুঝিয়ে দিলেন বলিউডি অবাস্তব সিক্স প্যাক নয়, বাঙালি পুলিশ বাজিমাত করতে পারে তাঁর নিজস্ব আটপৌরে বুদ্ধিদীপ্ত ঘরানায়। ভালো লাগে প্রিয়াঙ্কা সরকার ( ছায়া) এবং অনন্যা ভট্টাচার্যকে ( চামেলি) । অনন্যার চেয়েও স্বল্প সময়সীমার চরিত্রে প্রিয়াঙ্কা বুঝিয়ে দিলেন তিনি ছবি বাছাই করেন চরিত্রের গুরুত্ব বুঝে , ফুটেজ বুঝে নয় এবং সেটাই একজন দক্ষ এবং সেনসিটিভ অভিনেতার কাজ ।

এখানে দেবাঞ্জন, রুদ্র এরা ‘ফ্যামিলি ম্যান’ আর পুলিশি ইউনিফর্মের ভেতর দিয়ে বারবার সেই ভিতরের কুইন্টিসেনশিয়াল বাঙালিয়ানা, হারিয়ে যাওয়া বাঙালির বুদ্ধিদীপ্ত রসবোধ, মূল্যবোধ দেখতে পাওয়া যায় , যা নতুন জেনারেশনের অনিমেষ (বিক্রম ) কিংবা ইমরানকে (রিজওয়ান) অ্যালিয়েনেট করে না বা প্রতিপক্ষ করে তোলে না। যেটা আর বাস্তব পৃথিবীতে খুব একটা দেখতে পাই না, কারণ এখানে অ্যাটিটিউড দেখালেই ইগো ক্ল্যাশ। আর ঠিক এই কারণেই আমার কাছে ‘মৃগয়া’ আরও বিশেষ হয়ে উঠল। এই চার জন, চার জেনারেশনের। রুদ্র ঈশ্বরবিশ্বাসী, খানিকটা প্রাচীনপন্থী— যেগুলো আমাদের কাছে আধুনিকতা বা স্মার্টনেসের তথাকথিত পরিচয় নয়। দেবাঞ্জন তাঁর পরের জেনারেশন— সে ধূর্ত, তাঁর রসবোধ এবং তাঁর সারকাজম বুঝতে গেলে একটু পড়াশোনা আর ‘মটকা’য় বুদ্ধি থাকা প্রয়োজন (যেমন ঋত্বিক চক্রবর্তীর সোশাল মিডিয়া পোস্ট বুঝতেও লাগবে), কিন্তু প্রয়োজনে সে জলের মতো, সাচ্চা টিমম্যান। অনায়াসেই ভালোকে আপন করে নিয়ে নিজের ছায়ায় সযত্নে লালন করতে পারে। বাঙালির হারিয়ে যাওয়া জেনারেশনের এই কোয়ালিটি বড় দুর্লভ। অনিমেশ যেন মিলেনিয়াল— সে প্রতিবাদী, সে সোজসাপটা, ভনিতাহীন। তাঁর মধ্যে দেবাঞ্জনের মতো ম্যানিপুলেশন কম এবং দেবাঞ্জনের ধূর্তামি বা রুদ্রর ঈশ্বর বিশ্বাসকে সে সিনিকের চোখ দিয়েই দেখে। বিক্রম এই চরিত্রে দুর্দান্ত। অন্যদিকে রিজওয়ান এই প্রজন্মের। সে কথা কম, আর কাজে বেশি বিশ্বাসী। সে অ্যাগ্রেসিভ, আইডিয়ালিজমের ধার ধারে না কিন্তু সিনিয়রদের প্রতি তাঁর আস্থা অটুট বাইরে প্রকাশ না করলেও। তাই যতই রুদ্রর কথার মারপ্যাঁচ তাঁর পছন্দ না হোক, রুদ্রকে তাঁর স্লো মনে হোক, সে আসলে রুদ্রদেরই টিমে। চারজনের বিশ্বাস, মূল্যবোধ, ইন্টেলেক্ট ও কাজের পদ্ধতি ভিন্ন।

আমাদের কর্মক্ষেত্রে, আশেপাশে এই বৈপরীত্য হামেশাই দেখি। কিন্তু এখন এই সময়ে, এই সমাজে চল হল বিপরীত মত, বিশ্বাস এবং মূল্যবোধের মানুষকে ক্যানসেল করে দেওয়া, ট্রোল করা, অ্যাবিউজ করা এমনকি তার প্রতি হিংসার উদ্রেক করা। যেটাকে আমরা ইংরেজিতে Empathy বলি বা Camaraderie বলি সেটা মিসিং এবং ‘মৃগয়া’য় এই মিসিং লিঙ্ক ধরিয়ে দিয়েছেন গল্পকার, চিত্রনাট্যকার এবং সংলাপ লেখক। আর সেটাকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছেন ঋত্বিক, অনির্বাণ, বিক্রম, রিজওয়ানরা! এই মিশনে কে কাকে সাহায্য করেছেন, কে এগিয়ে, কোন ডিপার্টমেন্ট পিছিয়ে সেসব মাঝে মাঝেই পিছনে চলে যায়। স্মার্টনেস দেখাতে গেলে আসলে সত্যি সত্যি শার্টের কলার তুলতে হয় না বা মাসল ফোলাতেও হয় না! স্মার্টনেস আসলে মাসল পাওয়ার, সিক্স প্যাক, ফাঁপা পাঞ্চলাইন, Pun করা বা অন্যকে ছোট করে জ্ঞান ফলানোতে নয়। স্মার্টনেস আসে সহমর্মিতায়, অন্তর্ভুক্তিতে, দলে বিপরীত মতের ক্লাসমেটকেও খেলতে নেওয়ায়। সেসব নস্যাৎ করে এই পাবলিক ডিমান্ডেই তৈরি হওয়া ‘সিংহম’দের সঙ্গে পাল্লা দিতে অভিরূপ ঘোষের ‘মৃগয়া’ দেখতে দেখতে দর্শকাসনে বসে আমার হঠাৎ শাড়ির কলারটা তুলতে ইচ্ছে করল। ইচ্ছে করল সিটি দিতে। ‘মৃগয়া’য় যান, এই ছবি অবশ্যই দেখুন। পয়সা উসুল হবেই। এবং ওটিটি প্ল্যাটফর্ম নয় এই ছবির ‘চিয়ারলিডার’ হতে হবে সিনেমা হলে বসেই।

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement