সুযোগ বন্দ্যোপাধ্যায়: অঙ্ক কি কঠিন? জীবনের অঙ্কগুলো শক্ত কিন্তু ভালোবাসার জোর থাকলে, আরও বেঁধে বেঁধে থাকলে কিন্তু তার সমাধান অসম্ভব নয়। এই সোজাসাপটা সহজ কথাটা গল্পের মাধ্যমে বলেছেন পরিচালক সৌরভ পালোধী। ‘অঙ্ক কি কঠিন’ আসলে সেইসব মানুষের গল্প যাদের জীবনে পাওয়ার তুলনায় না পাওয়াটাই সিংহভাগ জুড়ে থাকে। আর থাকে দাঁতে দাঁত চেপে বাঁচার লড়াই।
এই ছবির মূল চরিত্র তিন খুদে, যাদের স্বপ্ন একটা হাসপাতাল খোলা। তাও আবার কোথায়? আব্বুলিশ বাড়িতে। আববুলিশ বাড়িটা কী? আব্বুলিশ বাড়ি হল মাঝপথে আটকে যাওয়া একটা বহুতল যা আইনি জটিলতার কারণে পুরসভার অনুমোদন পায়নি। কাঠামোটুকু হয়েছে কিন্তু দরজা জানালা নেই। তিন খুদের একজনের স্বপ্ন ডাক্তার হওয়া একজন ইঞ্জিনিয়ার এবং আরেকজনের ইচ্ছে নার্স হওয়ার- ঋদ্ধিমান তপময় আর গীতশ্রী, তিনজনের অভিনয় অত্যন্ত সাবলীল এবং প্রাণবন্ত যা ছবির শেষ পর্যন্ত দর্শককে মাতিয়ে রাখে। ওদের এই হাসপাতাল তৈরির আবর্তে গল্পের অন্যান্য চরিত্রগুলো ঘুরে ফিরে আসতে থাকে। অতিমারির পর বন্ধ হয়ে যাওয়া স্কুল, সিন্ডিকেট, রাজমিস্ত্রির জোগাড়ে, লোকের বাড়ি কাজ করতে যাওয়া পরিচারিকা কিংবা পেটের দায় শরীর বিক্রি করা এক মহিলা, হিন্দু-মুসলিমের বেপরোয়া প্রেম- এমন আরও অনেক কিছুর আবর্তে ঘুরতে ঘুরতে এই ছবির পথ চলা। শঙ্কর দেবনাথ, সঞ্জিতা, পার্নো মিত্র, ঊষসী, দীপান্বিতা প্রমুখের অভিনয় এই ছবির সম্পদ।
সামাজিক মাধ্যম থেকে শুরু করে জীবনের সর্বত্র যখন আমরা পারস্পরিক ঘৃণার চাষাবাদ করে এটাকে প্রায় স্বাভাবিক করে তুলেছি তখনই ছবি একটু টাটকা বাতাসের মতো ভালোবাসার কথা বলে। কথা বলে নিজস্ব এক সহজ ভঙ্গিমায়, মজার ছলে। এমন এক সময়ে সিনেমাটা দেখলাম, যখন পাশকুঁড়ার কৃষ্ণেন্দুর আত্মহত্যা চোখে আঙুল দিয়ে সমাজের মানবিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিল। আর মন খারাপের এই আবহেই তিন শিশুর ‘অঙ্ক কি কঠিন’ যেন মলমের প্রলেপ দিয়ে দিল। জীবনের নানা জটিল বিষয়কে ছুঁয়ে গেলেও এই ছবি কিন্তু ছোটদের ছবি। সপরিবারে দেখার মতো ছবি। তিনজন ছোট বাচ্চার ছেলেমানুষি কিভাবে সত্যিকারের বিপদে সমাধান হয়ে দাঁড়ায় সেটাই দর্শককে শেষ পর্যন্ত বসিয়ে রাখে, এটা পরিচালকের কৃতিত্ব। এই ছবির দৃশ্যকল্প কিছু কিছু জায়গায় বড় মন ছুঁয়ে যায়। অভাবের মধ্যেও যখন পরিচারিকা ৫০০ টাকা ফেরত দিয়ে দেয় দাম্ভিক ‘ওপরওয়ালা’কে কিংবা শরীর বিক্রি করে এসে ছেলের জন্য নাম লেখা কৌটোয় টাকা জমানো- এমন অনেক ছোট ছোট টুকরো টুকরো জীবনের ছবি ধরা থাকে এ ছবির ক্যানভাসে।
‘অঙ্ক কি কঠিন’ ছবির সংলাপ মজাদার, দু-এক জায়গায় সামান্য বাড়তি মনে হলেও দর্শককে মাতিয়ে রাখে সিনেমার গান এবং আবহসঙ্গীতের দায়িত্বে ছিলেন দেবদীপ মুখোপাধ্যায়। গানগুলো কিন্তু বেশ মজাদার। ‘চাপ নিয়ে লাভ নেই’ গানটি মনে রাখার মতো। তবে আবহসঙ্গীত অতটা ভালো লাগেনি, পরিচালক যেসব অসামান্য দৃশ্যকল্প বুনেছেন তার পরিপ্রেক্ষিতে আবহসঙ্গীত নিয়ে আরও ভালো কাজ করা যেত। তবে সব মিলিয়ে এই ছবি এক মন ভালো করা ছবি, যা মরা সময় মানুষকে ভালোবাসতে বলে, বেঁচে থাকার প্রেরণা জোগায়। এই ছবির জন্য সাধুবাদ প্রাপ্য প্রযোজক রাণা সরকারের। এমন সিনেমা তৈরির বিষয়ে সাহস ও আগ্রহ দেখানোর জন্য।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.