বিশ্বদীপ দে: দেখতে দেখতে আবারও এসে পড়েছে বাঙালি হিন্দুর শ্রেষ্ঠ উৎসব। দুর্গোৎসব। ষষ্ঠীর দিনে দেবীর বোধন। শাস্ত্রমতে, এই বোধনের মাধ্যমেই দক্ষিণায়নের নিদ্রিত দেবীর নিদ্রা ভঙ্গ করা হয়। যার পরই শুরু হয় দেবীর প্রকৃত আরাধনা। অর্থাৎ বোধনের গুরুত্ব অপরিসীম। যার অর্থ জাগরণ।
এক্ষেত্রে মাথায় রাখা দরকার, দেবীর এই সময় যে বোধন তা আসলে অকালবোধন। কৃত্তিবাস ওঝার অনুবাদে রামায়ণে পাচ্ছি ‘বিধি কন, বিধি আছে চণ্ডী-আরাধনে/ হইবে রাবণ বধ অকালবোধনে।।’ এই উপাখ্যান তো সকলেরই জানা। রাম-রাবণের যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরে যখন একে একে লঙ্কার বড় বড় বীররা ধরাশায়ী, তখন রাবণ মা দুর্গার স্তব করলেন। দুর্গা কালীরূপে রাবণকে অভয় দিলেন। মা কালীর কোলে আশ্রিত রাবণ যুদ্ধে অপরাজেয় হয়ে উঠতে লাগলেন। এই পরিস্থিতিতে দুর্গাকে তুষ্ট করতে অকালেই (বসন্তকালের বদলে শরৎকালে) তাঁর পুজো করতে মনস্থ করলেন রাম। এরপরই অকালবোধন। কেবল ষষ্ঠী নয়, অকালবোধন হয় নবমীতেও! কালিকাপুরাণ মতে, সেদিনই দেবীর মাধ্যমে রাবণবধ করেন রামচন্দ্র। যদিও কৃত্তিবাসের রচনায় সেই ঘটনার দিন বিজয়া দশমী।
রামায়ণ-মহাভারতের কথা বলতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘এত বড় বৃহৎ দুইটি গ্রন্থ, আমাদের সমস্ত ভারতবর্ষ-জোড়া দুইটি কাব্য, তাহাদের নিজের রচয়িতা কবিদের নাম হারাইয়া বসিয়া আছে— কবি আপন কাব্যের এতই অন্তরালে পড়িয়া গেছে।’ তবে মহাকবি বাল্মীকির মতোই কৃত্তিবাসও কিন্তু যুগের পর যুগ ধরে চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছেন। সংস্কৃত থেকে বাংলা ভাষায় তর্জমা করার সময় তাঁর ভাবনাকেও তিনি মিশিয়ে দিয়েছেন মহাকাব্যের অন্তরাত্মায়।
মহাকাব্য, বেদ ও পুরাণ বিশেষজ্ঞ নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী বলেছেন, ”মূল রামায়ণে কিন্তু অকালবোধনও নেই, রামচন্দ্র দেবীর পূজা করছেন এটাও নেই।” আসলে বসন্তকালের বদলে শরৎকালে দেবীর পুজোই আজকের দুর্গাপুজোর কাহিনি হয়ে উঠলেও তা বাল্মীকি রামায়ণে নেই। পরে সংযোজিত হয়েছে। আবার অকালবোধনে রাবণের পৌরোহিত্যের কাহিনিও একই ভাবে ঢুকে পড়েছে কোনও কোনও রামায়ণের কাহিনিতে। আসলে রামায়ণের নানা সংস্করণ ছড়িয়ে রয়েছে। এই বিভিন্ন সংস্করণগুলির কথা ভাবতে বসলে সত্যিই অবাক হতে হয়। চেনা কাহিনি বদলে বদলে গিয়েছে ভিন্ন ভাষা, ভিন্ন সংস্কৃতির আঁচে!
নৃসিংপ্রসাদ বলছেন, ”ষষ্ঠীতে যে বোধন হবে, সেই বোধন কিন্তু নতুন করে আবার নবমীতে তাকে জাগ্রত করতে হয়… কালিকাপুরাণে যেটা আছে, নবমীর বোধনের পরেই দেবী প্রবোধিত হলেন। এবং নিজের মায়ায় রামচন্দ্র এবং রাবণকে যুদ্ধে প্রবৃত্ত করলেন।” সেই সঙ্গেই তিনি মনে করিয়ে দিচ্ছেন, এই যে রাবণবধ এর নেপথ্যে কিন্তু দেবী দুর্গাই। তিনিই রামচন্দ্রের মাধ্যমে রাবণকে হত্যা করেন। এবং সেই দিনটা নবমী।
আর এখানেই আলাদা হয়ে যান কৃত্তিবাস ওঝা। তিনি কালিকাপুরাণকে এক্ষেত্রে অনুসরণ করেননি। নৃসিংহপ্রসাদের কথায়, ”বাঙালির যে দুর্গাপূজা পদ্ধতি তা এড়াতে পারেননি কৃত্তিবাস। এবং তাঁর রচনায় আমরা দেখছি, রামচন্দ্র চণ্ডীপাঠ শুরু করেছেন ষষ্ঠীতে। বেলগাছের তলায় গিয়েই তিনি দেবীর বোধন ও অধিবাস করলেন।” নবমীতে সেই বিখ্যাত ১০৮ নীলপদ্মের কাহিনি। কৃত্তিবাস লিখেছিলেন, ‘চক্ষু উপাড়িতে রাম বসিলা সাক্ষাতে।/ হেনকালে কাত্যায়নী ধরিলেন হাতে।।/ কী কর কী কর প্রভু জগৎ-গোঁসাই।/ পূর্ণ হৈল, চক্ষু উপাড়িয়া কার্য্য নাই।। / কাতরে শ্রীরাম কন দেবীরে তখন।/ অবিরত জলধারে ভাসিছে নয়ন।।’ এরপর রাবণকে বধ করতে রাম যাত্রা করলেন দশমীতে। ‘দশমীতে পূজা করি,/ বিসর্জ্জিয়া মহেশ্বরী, /সংগ্রামে চলিলা রঘুপতি।’ এভাবেই কৃত্তিবাস দশমী তিথিতে রামচন্দ্রের রাবণবধের কাহিনি রচনা করলেন। বদলে গেল কাহিনির সময়কালও।
তবে আমাদের এই লেখা বোধন নিয়ে। যার মাধ্যমে পূজার সূচনা। অথচ তা বাল্মীকির রচনায় ছিল না। কৃত্তিবাস আমাদের বড়ই আপন। তিনি বাঙালির চিরকালীন এই উৎসবকে শরতের অকালবোধনে মিশিয়ে দিয়ে গিয়েছেন। তাই অকালবোধন হয়ে উঠেছে আমাদের হৃদয়ের গাথা। প্রজন্মের পর প্রজন্ম এই কাহিনি শুনে শিহরিত হয়েছে। রাবণ বধের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে গিয়েছে অকালবোধন। আমাদের শ্রেষ্ঠ এক ধর্মীয় উৎসব এভাবেই মহাকাব্যকে নিজের মতো করে নির্মাণ করেছে। হয়তো মহাকাব্যের ভবিতব্যই তা। সারা বিশ্বজুড়েই রামায়ণের অসংখ্য সংস্করণই তার সাক্ষ্য বহন করে চলেছে আজও।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.