বিশ্বদীপ দে: ‘যেমন জল জমিয়া বরফ হয়, অন্ধকার জমিয়া তেমনি ভূত হয়। জল জমাইয়া বরফ করিবার কল আছে, অন্ধকার জমাইয়া ভূত করিবার কল কি সাহেবেরা করিতে পারেন না?’ রসিক বাঙালি মাত্রেই জানার কথা, ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের ‘লুল্লু’ নামের এক কাহিনিতে এমন অভিনব এক আইডিয়ার কথা লেখা হয়েছিল। তবে আলো মানেই ভালো আর অন্ধকার মানেই খারাপ, এমন বাইনারির সারল্য বোধহয় অর্থহীন। একই ভাবে ভূত মানেই খারাপ, একথা বলার আগেও একটু থমকে দাঁড়াতেই হবে। চোখের সামনে ফড়ফড় করে উড়তে শুরু করবে এমন সব বইয়ের পাতা কিংবা মনের পর্দায় ভেসে উঠবে এমন সব চলচ্চিত্র, যারা পরিষ্কার করে দেয়, ভূতেরাও বন্ধু হতে পারে। আর তারা যখন বন্ধু হয়, তখন বুঝি মানুষকেও টেক্কা দেয়।
‘গুগাবাবা’র ভূতের রাজা বোধহয় বন্ধু ভূতের তালিকায় শীর্ষেই থেকে যাবেন। মনে পড়ে? দুই গ্রাম থেকে বিতাড়িত ছোকরা, যারা বাঘ ও ভূতের যুগপৎ দৌরাত্ম্যে দিশাহারা, তাদের উদ্দেশে কেমন সস্নেহে তিনি বলে উঠেছিলেন, ‘গুপী-বাঘা, গুপী-বাঘা, ভয় নেই, ভয় নেই! কাছে আয়, কাছে আয়! তোরা বড় ভালো ছেলে কাছে আয়!’ আর তারপর পরম আশ্বাসে জানিয়ে দিয়েছিলেন, ‘আমি আছি, আমি আছি ভূতো রাজা- খুশি হলে বর দিই, খুশি হলে বর দিই, তিন বর, তিন বর, তিন বর!’ তারপর বলে দেয়, ‘গান হবে, ঢোল হবে, সুর হবে, তাল হবে, লয় হবে…’ ঠাকুর্দা উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর গল্প থেকেই সিনেমাটি করেছিলেন সত্যজিৎ। সেখানে কিন্তু ভূতের রাজা নেই। ভূতেরা সকলে মিলে বর দিয়েছিল। ছবির কারণে তিনি বহুবচন থেকে একবচনে নিয়ে এসে ভূতেদের নয় ভূতের রাজাকে বরদাতা করে দেন। তাতে এক নির্দিষ্ট বন্ধুত্বের গাথা রচনা করা সম্ভব হয়েছিল। ভাবুন, একবার। অঞ্জন দত্তের বিখ্যাত গানের প্রেমিক ভূতের রাজার দেখা পেলে কত আগেই চাকরিটা পেয়ে যেত। বেলাও স্বস্তি পেত আগেই।
উপেন্দ্রকিশোর অবশ্য এমন বন্ধু ভূতের কথা অন্য কাহিনিতেও লিখেছেন। ‘জোলা ও সাত ভূত’ গল্পে অবশ্য খুশি হয়ে বরদানের গল্প নেই। সেখানে এক জোলার গান ‘একটা খাব, দুটো খাব,/ সাত বেটাকেই চিবিয়ে খাব’ শুনে ভূতেরা ভয় পেয়ে বলতে থাকে, ‘ওরে সর্বনাশ হয়েছে! ঐ দেখ, কোথেকে এক বিট্কেল ব্যাটা এসেছে, আর বলছে আমাদের সাতজনকেই চিবিয়ে খাবে! এখন কী করি বল তো।’ যদিও জোলা আসলে সাতটি পিঠে খাওয়ার কথা বলেছিল। ‘সাতটা মিশমিশে কালো তালগাছপানা ভূত, তাদের কুলোর মত কান, মুলোর মত দাঁত, চুলোর মত চোখ’ তারা এরপর জোলাকে নানা ম্যাজিক উপহার দেয়। এবং সেই সব ম্যাজিক হাতছাড়া হতেই তা ফেরত পাওয়ার উপায়ও করে দেয় তারা।
এমনই আরেক গল্প ‘কুঁজো আর ভূত’। কানাই নামের এক ব্যক্তির পিঠে ছিল এক বিরাট কুঁজ। তার জীবনের দুঃখের শেষ ছিল না। কিন্তু স্রেফ ভূতেদের গান শুনিয়ে কপাল খুলে গিয়েছিল তারও। ভূতেরা দল বেঁধে গাইছিল, ‘লুন হ্যায়, তেল হ্যায়, ইম্লী হ্যায়, হিং হ্যায়!’ সে এই গানটাকেই আরও নতুন কথায় বেঁধেছিল, ‘লুন হ্যায়, তেল হ্যায়, ইম্লী হ্যায়, হিং হ্যায়।’ এমনকী এর সঙ্গে জুড়ে দিয়েছিল ‘লসুন হ্যায়, মরীচ হ্যায়, চ্যাং ব্যাং শুঁট্কি হ্যায়।’ উপেন্দ্রকিশোর লিখছেন, ভূতেরা এরপর কী করল। ‘তারা সেই নূতন কথাগুলো শুনে এতই খুশি হইল যে, তখনই ছুটে কানাইয়ের কাছে না এসে আর থাকতে পারল না। তারা এসে কানাইকে কোলে করে নাচতে নাচতে সেই বাড়ির ভিতরে নিয়ে গেল, আর আদরটা যে করল! মিঠাই যে তাকে কত খাওয়াল, তার অন্ত নেই।’ এখানেই শেষ নয়, তার কুঁজটাও আর থাকল না। যদিও এই গল্পের শেষে একটা বার্তাও আছে। মানিক নামের একটি ছেলে, যার পিঠের কুঁজ ‘কানাইয়ের কুঁজের চেয়েও ঢের বড়’, সেও গিয়েছিল ভূতেদের খুশি করতে। কিন্তু ‘গুরুচরণ ময়রার দোকানের কাঁচাগোল্লা হ্যায়’ গাওয়ার কারণে সে খামোখা ভূতেদের চটিয়ে ফেলেছিল! যা বুঝিয়ে দেয়, বন্ধু হলেও তো ব্যাটারা আসলে ভূত, তাই একটু সতর্ক হয়ে থাকতেই হয়। কাঁচাগোল্লার মতো উপাদেয় বস্তুর চেয়ে চ্যাং-ব্যাংই তাদের ঢের পছন্দ সেসব ভুললে চলবে না।
ত্রৈলোক্যনাথে ফেরা যাক। ‘লুল্লু’ এক অসাধারণ লেখা। এই সমাজকে নিংড়ে তার ভিতরের রস এমন করে এই লেখায় ঢেলে দিয়েছিলেন… সত্যিই অভূতপূর্ব। পরেও কি এমন লেখা আর হয়েছে? সেই গল্পে কিন্তু লুল্লু নামের দুষ্টু ভূতই কেবল নেই। এক রাগী ভূতই কিন্তু শেষপর্যন্ত আমির শেখকে জানিয়েছিল, তার স্ত্রীকে লুল্লু নিয়ে গিয়েছে। এমন বন্ধুবৎসল ভূত কিন্তু বাংলা সাহিত্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। এই পরিসরে আমরা আর কতটুকু আলোচনা করতে পারব? তবে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় ও লীলা মজুমদারকে বাদ দিলে লেখাটা কিছুতেই সম্পূর্ণ হতে পারবে না।
শীর্ষেন্দুর ‘গোঁসাইবাগানের ভূত’ মনে পড়ে? বুরুন নামের এক সদ্য কিশোর অঙ্কে তেরো পেয়েছিল। তাতে তার মন এতই খারাপ হয়ে যায়, ভূত-টূত সামনে দেখেও তোয়াক্কা করে না! বাধ্যত নিধিরাম নামের এক ভূত তাকে রীতিমতো তোষামোদ করতে শুরু করে। সে ‘ঘরদোর সাফ করে পড়ার টেবিল গুছিয়ে’ দেয়। তার অঙ্ক কষে দেয়, ট্রান্সলেশন করে দেয়। আবার ক্রিকেট হোক অ্যাথলেটিক- অদৃশ্য অবস্থায় খেলার মাঠেও বুরুনকে সে সাহায্য করতে থাকে। এটা কি স্রেফ তোষামোদ? শুরুটা তেমন ভাবে হলেও আসলে এর পিছনে ছিল নিধিরামের অকৃত্রিম স্নেহ। সে বলেও ফেলে, ‘দেখ বুরুন, তুমি বাচ্চা ছেলে বলে নিতান্ত মায়ায় পড়ে তোমার কাজকর্ম করে দিই। খাতিরও দেখাই।’ এমন ঝকঝকে বন্ধুত্বের কাহিনি তিনি আরও লিখেছেন।
আবার লীলা মজুমদারের গল্পেও ‘উপকারী’ সব ভূতের ছড়াছড়ি! ‘আকাশ পিদ্দিম’ গল্পে দেখা মেলে ‘থুত্থুড়ে এক বুড়ি’র। যার ‘মাথা থেকে পা অবধি সাদা কাপড়ে ঢাকা।’ গুপে, বঙ্কু, তোতাদের সেই বৃদ্ধা বলে, ”বাঁজে কঁথা রেঁখে, কীঁ বঁর চাঁস বঁল। নে, নে তাঁড়াতাঁড়ি কঁর, আঁমার ঢেঁর কাঁজ।” সেই বৃদ্ধা তাদের আলাদিনের প্রদীপ দেয় বটে। কিন্তু ভিতর থেকে জিন থুড়ি বেঁটে বামুন বেরিয়ে এসে যখন দেখে সাকুল্যে ‘চারটে বড় স্টিলের পেনসিল-কাটা, দুটো ভালো ডটপেন আর বারোটা রিফিল’ চাইছে খুদেরা, সে সেসব দিয়েও রেগেমেগে প্রদীপটা নিয়েই প্রস্থান করে। তবে রেগে গেলেও এরা যে আদতে মানুষের উপকারই করতে চায়া তা লীলা মজুমদার বারবার মনে করিয়ে দেন।
তবে কেবল দিশি ভূতেদের কথা বললেই কি চলবে? ‘ক্যাসপার’-এর মতো মিষ্টি ভূতদেরও যে ভোলা যায় না। ১৯৯৫ সালের এই সিনেমার মূল চরিত্র ক্যাসপার ম্যাকফ্যাডেন নামে এক ১২ বছর বয়সি বালক। নিউমোনিয়ায় মারা গিয়েও যে ছেড়ে যেতে পারে না ভূতুড়ে প্রাসাদ। সব সময়ই অন্যদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চায় ক্যাসপার। এই পৃথিবীতে মানুষের প্রতি মানুষের আচরণের বহু কর্কশ উদাহরণ চোখ-কান খোলা রাখলেই জানা যাবে। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে এমন উপকারী ভূতেরা যেন আশ্বাস দেয়, ভূত মানেই দাঁতখিঁচুনি, বিতিকিচ্ছিরি সব জাম্পকাট এমনটা মোটেও নয়। এই সারিবদ্ধ গা শিউরে ওঠা আতঙ্কময় ঘটনার পৃথিবীতে আমরাও আছি।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.