Advertisement
Advertisement
Ghost

শাঁকচুন্নি-মামদো নয়, বাঙালি সত্যিই ভয় পায় যে ভূতেদের

সারা বচ্ছর বাঙালির পিলে চমকে দিতে থাকে এই ভূতেরা।

Not traditional ghost, but socalled daily day ghosts that fear Bengalis

ছবি: সুযোগ বন্দ্যোপাধ্যায়।

Published by: Biswadip Dey
  • Posted:October 18, 2025 5:45 pm
  • Updated:October 18, 2025 5:45 pm   

বিশ্বদীপ দে: রবিবার ভূত চতুর্দশী। হপ্তাদুয়েকের মধ্যেই হ্যালোইন। বছরের এই সময়টা যে তেনাদের জন্য একেবারে ‘ডেডিকেটেড’, এতে সন্দেহ নেই। ভূতেরা এখন চারপাশে একেবারে কিলবিল করছে। শাঁকচুন্নি, মামদো, বেহ্মদত্যি, একানড়ে, গলাসি… তালিকা রীতিমতো দীর্ঘ। কিন্তু এই সব ‘প্রথাগত’ ভূতের বাইরেও এমন সব ভূত রয়েছে, যারা কেবল ভূত চতুর্দশী কিংবা হ্যালোইন নয়, সারা বচ্ছর বাঙালির পিলে চমকে দিতে থাকে। আসুন একবার নতুন করে পরিচয় করা যাক।

Advertisement

অম্বল ভূত- বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। আর সেই সঙ্গে বোধহয় তেরো হাজার বার অম্বলের আতঙ্কও! সব সময় একটা চোরা অম্বলের আশঙ্কা নিয়ে বেঁচে থাকে সিংহভাগ বাঙালি। এর পিছনে রয়েছে তার বিবিধ চর্ব্য, চোষ্য, লেহ্য, পেয়র প্রতি তীব্র আকর্ষণ। সত্যজিৎ রায় তাঁর ‘আগন্তুক’ ছবির মনমোহনকে বলিয়েছিলেন, ‘আহারের এমন বাহার এ শুধু বাঙালিরই সম্ভব!’ কেবল বাঙালি পদই তো নয়। চিনা হোক কিংবা মোগলাই, নানা ধরনের পদ পেলেই বাঙালি স্রেফ ঝাঁপিয়ে পড়তে চায়। ইদানীং অনেকেই ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং করছে। জিমেও যাচ্ছে। কিন্তু ‘সবাই তো সুখী হতে চায়, কেউ সুখী হয় কেউ হয় না’ গানটায় স্রেফ ‘সুখী’র পরিবর্তে ‘ছিপছিপে’ বা ‘নির্মেদ’ ব্যবহার করলেই ব্যাপারটা বোঝা যায়। এর পিছনেও ওই খাওয়ার প্রতি ঝোঁক। আর সেই কারণেই তার হাত ধরাধরি করে ঢুকে পড়ে এক আতঙ্ক। অম্বল হবে না তো? নেমন্তন্ন বাড়ি যাওয়া মানেই বাঙালির পকেটে অবধারিত পুদিনহারা কিংবা হাজমোলা… খেয়ে উঠে খানিক পায়চারি করে সে চায় খাবারটা সঠিক ভাবে হজম হয়ে যাক। কিন্তু শেষে দেখা যায়… এই অম্বলের বিচ্ছিরি ভূত তাকে ছেড়ে যায় না। এমনকী গ্যাস ভেবে হৃদরোগ বাঁধিয়ে বসার ঝুঁকি মাথায় রেখেও সব কিছুতেই অম্বলের ভূত দেখার বিরাম নেই তার।

লেট ভূত- বাঙালি চিরকালই লেট। এমন একটা ধারণাকে কি নস্যাৎ করা যায়? অবিশ্যি সকলকে এক ব্র্যাকেটে ফেলে দেওয়াও রীতিমতো অন্যায্য ব্যাপার। তবু সাধারণ ঝোঁকটা ধরলে দেখা যায়, অফিসে সময়মতো ঢুকতে পারাটা বাঙালির কাছে একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ! ঘুম থেকে উঠে ইস্তক এই ভয় তাকে চিমটি কাটতে থাকে। লেট হওয়া মানেই বসের গম্ভীর মুখ, এইচআরের মেল… জীবন যেন একেবারে হাঁমুখ আতঙ্ক হয়ে ওঠে… বিলম্বিত লয় জীবনের সেতারকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলতে থাকে। তিনটে লেট হলে একটা সিএল কাটা যায় কিনা সেটা জরুরি নয়। ওই লেট করে ঢোকার পর হাড়হিম এক পরিবেশ, এটা বাঙালিকে প্রবল ভীত করে তোলে। তবে শুধু কি অফিস? দেরি করে এলে প্রেমিকা কিংবা বউ কি চকোলেট দেবে? রবিবার তাসের আসর সেরে দেরি করে ওঠা দুপুরের বাড়ি কিংবা প্রেমিকাকে ‘এই তো অটোতে, আর পাঁচ মিনিট’ বলার পরও একঘণ্টা দেরিতে সামনে গিয়ে দাঁড়ানো- বাঙালি পুরুষের এক চিরন্তন দুঃস্বপ্ন। কেবল কি পুরুষ? বাঙালি নারী জানে, সময়ের এদিকে ওদিক হলে শাশুড়িমায়ের মুখটা কেমন হয়ে যায়! স্কুলের লেট অবশ্য সেই তুলনায় নেহাতই তুচ্ছ। বড়জোর স্যারের কানমলা। বড় হলে সব কিছুই যে জটিল হয়ে ওঠে, লেট-আতঙ্কের এই ছবিটাই বোধহয় সেটা বুঝিয়ে দেয়।

প্রতিবেশী ভূত- বাঙালির এক বড় ভূতের নাম প্রতিবেশী! হ্যাঁ, ঠিকই বলছি। এখানে প্রতিবেশী মানে স্রেফ পাশের বাড়ির বাসিন্দা নন। অফিসে পাশের ডেস্কে যে বা যারা বসে তারাও তো প্রতিবেশী। আর তাদের কথা ভাবলেই বাঙালি ভয় পেয়ে যায়। এই বুঝি তাদের ভাগ্যে ভালো কিছু ঘটে গেল! এই বুঝি পাশের ডেস্কের অমুকের আরও হাজারখানেক বেশি টাকার ইনক্রিমেন্ট হল! পাশের বাড়ির তমুকবাবুর ছেলে জয়েন্টে চান্স পেলেই বাঙালি কত্তা তাঁর গিন্নিকে শুধোন, ”তোমার বাবলু পাবে তো? না হলে মানসম্মান আর কিছু…” এই এক অদম্য ভয়। লোক কী ভাববে? কী বলবে? ছেলেমেয়ের প্রেম হোক কিংবা চাকরি, বাঙালির মনে একটা ভূত সারাক্ষণ দাঁত খিঁচোয়। বলতে থাকে, লোকে কী বলবে? আজকাল সোশাল মিডিয়ায় সবাই সব কিছু পোস্ট করে। সেখানেও একই আতঙ্ক। ও কেমন পোস্ট করে দিল। আমি যদি না পারি?

কবিতার ভূত- এই ভূত ভয় দেখায় না। স্রেফ সিন্ধবাদের সেই বুড়োর মতো নাছোড় হয়ে বসে থাকে কাঁধে! যখন তার মর্জি হয়, ছেড়ে চলেও যায়। কিন্তু প্রায় প্রতি বাঙালির জীবনে এই ভূত একবার না একবার বোধহয় চাপবেই। আর এই বিষয়ে একেবারে মোক্ষম একটা গল্প হল ‘আশ্চর্য কবিতা’। সুকুমার রায়ের এই আখ্যানে এক নতুন ছাত্র আসতেই ক্লাসের সকলের মধ্যে ছোঁয়াচে হয়ে ঢুকে পড়ে কবিতা। ‘তাহার দেখাদেখি আরও অনেকেই কবিতা লিখিতে শুরু করিল। ক্রমে কবিতা লেখার বাতিকটা ভয়ানক রকম ছোঁয়াচে হইয়া নিচের ক্লাসের প্রায় অর্ধেক ছেলেকে পাইয়া বসিল। ছোট ছোট ছেলেদের পকেটে ছোট ছোট কবিতার খাতা দেখা দিল।… ইস্কুলের দেয়ালে, পড়ার কেতাবে, পরীক্ষার খাতায়, চারিদিকে কবিতা গজাইয়া উঠিল।’ শেষে এই কবিদের কী পরিণতি হল, তা জানতে গল্পটা একবার পড়ে দেখাই যেতে পারে। এখান থেকে মান্না দে-র আইকনিক ‘কফিহাউস’ গানটার সেই লাইনটায় যাওয়া যায়। ‘একটা কবিতা তার, হল না কোথাও ছাপা, পেল না সে প্রতিভার দামটা।’ এই ব্যর্থতা বহু কবির অলঙ্কার হয়ে থেকে গিয়েছে। বাকি ভূতগুলির মধ্যে কাঁটাওলা হিংসুটে দানবদের ইমেজ মনে পড়ে। কিন্তু এই ভূত কেমন যেমন একাকী এক অস্তিত্ব। যশস্বী কবিদের মধ্যেই সেই অস্তিত্ব এক অন্য ছাপ রেখে যায়। বাকিদের থেকে আলাদা থাকার বিষাদ। তবে সেটা অন্য প্রসঙ্গ। আপাত ভাবে বলাই যায়, এই ভূতই শেষপর্যন্ত তেএঁটে শয়তান, অম্বলের রোগীর পাশাপাশি বাঙালিকে মনকেমনের হাওয়া ছুঁইয়ে উদাসী বানিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে।

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ