সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: One Picture is Worth a Thousand Words-ইংরেজি এই প্রবাদ যে অক্ষরে অক্ষরে সত্যি, তা আবার প্রমাণ করল কাশ্মীরের একটি ছবি। কাশ্মীর উপত্যকার সমস্যা ও তার পরিণতি নিয়ে এযাবৎ যত আলোচনা হয়েছে, যত প্রবন্ধ-নিবন্ধ লেখা হয়েছে তা যেন মুহূর্তে হতবাক হয়ে যেতে পারে এই একটি ছবির সামনে। কারণ হাজারো অক্ষরে যে সমস্যার মূলে নাড়া দেওয়া যায় না, হাজারো শব্দের বেড়াজালে সংকটের ছবি ফুটি ফুটি করেও ফুটে ওঠে না, একটি শব্দ খরচ না করেও সে সবই বলে দিচ্ছে এ ছবিটি। এবং, বলছে এতটাই ভাণহীন ভাবে, এতটাই সরাসরি যে আপামর ভারতীয় সে ছবি নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে পারছেন না। এমনকী প্রিজমাতে মজে থাকা নেটদুনিয়া ক্যাটরিনার ‘কালা চশমা’কে পিছনে ফেলে সামনের সারিতে তুলে এনেছে এ কাশ্মীরি বাস্তবতাকেই।
কী দেখাচ্ছে এ ছবি? প্রখ্যাত এক সংবাদসংস্থার চিত্রগ্রাহক এস ইরফানের তোলা ছবিতে দেখা যাচ্ছে, এক কাশ্মীরি বালক (বরং শিশু বলাই ভাল) গুলতি তাক করে ধরেছে সেনার দিকে। এক সেনা আলগোছ নিজেকে সে আক্রমন থেকে আড়াল করেছেন। বলা ভাল, আড়াল না করে পারছেন না। পাশে দাঁড়িয়ে চোখে খানিকটা, বিস্ময় আর খানিকটা হেয় মেশানো দৃষ্টি নিয়ে দাঁড়িয়ে আরও দুই সেনা।
A boy plays with security jawans during curfew, in the downtown area of Srinagar on Saturday. (PTI Photo by S Irfan)
— Aditya Raj Kaul (@AdityaRajKaul)
অনেক কথা, তত্ত্ব, তথ্য মিথ্যা করে এ ছবি শেল হেনেছে ভারতবাসীর বুকে। প্রশ্ন জাগছে, এই কি পরিণতি হওয়ার ছিল? এ দেশেরই এক বালকের, দেশের সেনার প্রতি এতখানি বিদ্বেষ বুকে নিয়ে বেড়ে ওঠার সত্যিই কি কোনও প্রয়োজন ছিল? মানবতা বলবে, ছিল না। রাজনীতি বলবে, না হয়ে উপায় ছিল না। এটাই কাশ্মীরের বাস্তবতা। স্বীকার করা হোক বা না হোক, এর থেকে ভয়ংকর সত্যি আর কিছু নেই। আর কে না জানে, ছবি মিথ্যে কথা বলে না!
ক’দিন আগেই এক কাশ্মীরি কিশোরী খোলা চিঠি পাঠিয়েছিল প্রধানমন্ত্রীকে। মোটে ১৭ বছর বয়স হলেও সে বুঝেছিল, কাশ্মীর সবাই চায়, কিন্তু কাশ্মীরের মানুষের ভাল কেউ চায় না। চাইলে তো, কাশ্মীরের মানুষের কথায় কর্ণপাত করত প্রশাসন। কই, তা তো কেউ করছে না। একদল বুরহান ওয়ানিকে জঙ্গি বলছে, আর একদল বলছে শহিদ। কিন্তু বুহানের মতো মেধাবী ছাত্র হাতে বন্দুক তুলে নিল তা তো কেউ খেয়াল করে দেখল না!
এই না দেখার বিদ্বেষই দিনে দিনে জমা হয়েছে। রাজনীতি কাশ্মীরকে ব্যবহার করেছে ফায়দা লোটার কাজে। বিদেশি শক্তির কাছে তা হয়ে উঠেছে বিছিন্নতবাদকে মদত দেওয়ার হাতিয়ার। প্রশাসন বিছিন্নতবাদীদের মদত দিতে পারে না, ফলত রাষ্ট্রীয় দমনও একরকম অনিবার্য হয়ে পড়ে। আর এই দ্বন্দ্বের মাঝে বহুকাল পিষ্ট কাশ্মীরবাসী, নানাভাবে এ চক্রব্যুহ থেকে বেরনোর পথ খুঁজেছে তাঁরা। কিন্তু বেরনোর মন্ত্র যেন তাঁদের জানা নেই। এই নিয়তির মধ্যেই এক শ্রেণির বলিউডি ছবি কাশ্মীরকে সুন্দর দেখানোর ‘মিশন’ নিয়ে আদিখ্যেতা করেছে। কিন্তু ‘কাশ্মীর কি কলি’ যে সেই কবেই বিনষ্ট হয়েছে, তা যেন দেখেও দেখেনি ভারতবাসী। সেই উপেক্ষা, আর অবহেলার ভিতরেই জন্ম নিয়েছে ‘হায়দার’, জন্ম নেয় বুরহান। হয়তো এ শিশুও চলেছে সেই পথেই। দেশের শাসকদলের রং বদলাবে, এ রাজনীতির রং কি পাল্টাবে! এ উত্তর কারওরই জানা নেই।
ফলত এ শিশুর ভবিষ্যতও যে কী হবে তাও জানেন না কেউই। এমন ফুলের মতো নিষ্পাপ একটি শিশুও হয়তো টানাপোড়েনের রাজনীতির ভিতর দাঁড়িয়ে কোনওদিন হাতে বন্দুক তুলে নেবে। সেই ভবিতব্যের আশঙ্কা গ্রাস করেছে নেটিজেনদেরও। নেটদুনিয়ার যে অধিবাসীরা ট্রেন্ডিংয়ের বাইরে বিশেষ মাথা ঘামান না, তাঁরাও এ ছবি দেখে আঁতকে উঠেছেন। যদিও কেউ কেউ এ ছবিকে ‘খেলাচ্ছলে’ ক্যাপশনেই আটকে রাখতে চাইছেন, কিন্তু প্রাক্তন আইপিএসও এ ছবির ভয়াবহ ভবিতব্য থেকে মুখ ফেরাতে পারছেন না। কাশ্মীরে সেনা যে সঠিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে, এ ছবি দেখে এমনটাই মত তাঁর। যদিও তাঁকে সমালোচনা করেছেন অনেকেই। তাঁদের বক্তব্য, এ নেহাতই এক খেলা। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, এ কোন খেলা যা যুদ্ধের থেকেও মারাত্মক! এ কোন খেলা যা বালককে সেনার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরা শিখিয়ে দেয়?
When such a young kid aims his slingshot at a policeman, we must realize that we have comprehensively failed Kashmir
— Sanjiv Bhatt (IPS) (@sanjivbhatt)
খানিকটা তর্ক, মতভেদ, বিরোধ, টুইট-পাল্টা টুইটের পর এ ছবি সরে যাবে ট্রেন্ডিং লিস্ট থেকে। জনগণ মেতে উঠবে নতুন বিষয়ে। কিন্তু সেই আড়ালে এ ছেলে কীভাবে বড় হয়ে উঠবে? তার মনে জমে থাকা বিদ্বেষ কে সরাবে? আজ যদি সে ‘খেলাচ্ছলে’ এ কাজ করে থাকে, কাল যে এটাই বড় সত্যি হয়ে উঠবে না, তার নিশ্চয়তাই বা কে দেবে? প্রশ্নগুলো না সহজ, না এর উত্তরও তো জানা। না জানার ভিতর সরে যায় তর্কের আসর, পুরনো হয়ে যায় ট্রেন্ডিং তালিকা, কাশ্মীর থেকে যায় সেই কাশ্মীরেই।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.