Advertisement
Advertisement
Bonedi Barir Durga Puja

অসুরদলনী নন, বরানগরের দত্তবাড়িতে ২৫২ বছর ধরে মেয়ে-জামাই রূপে আসছেন দুর্গা-শিব

একসময় বলি চালু থাকলেও এক অলৌকিক ঘটনার পর তা বন্ধ হয়ে যায়।

Bonedi Barir Durga Puja: 252 years old Durga Puja at Baranagar Dutta Bari
Published by: Arpan Das
  • Posted:September 30, 2025 2:05 pm
  • Updated:September 30, 2025 2:17 pm   

প্রসূন বিশ্বাস: উমা আশ্বিনে সপরিবারে বাপের বাড়ি আসেন। কিন্তু সেই চিত্র কি আমরা মণ্ডপে-মণ্ডপে দেখতে পাই? পাই না। বরং অকালবোধনে এই পূজা-অর্চনায় মণ্ডপে-মণ্ডপে যে দেবীর মূর্তি দেখি তা সবই অসুরদলনী রূপ। কী প্রবল রুদ্র তাঁর তেজ! কী প্রখর তার দৃষ্টি!

Advertisement

অথচ বাঙালি পারিবারিক জীবনের দৃষ্টিকোণ দিয়ে দেখতে গেলে এই উমাই যেন গ্রাম বাংলার আর পাঁচটা সংসারী মেয়ের একজন প্রতিনিধিস্বরূপ। তাঁর আছে একটা আত্মভোলা স্বামী, সঙ্গে ছেলে-মেয়ে ভরা সংসার। কিন্তু এই ঘরোয়া রূপ বারোয়ারি মণ্ডপের দুর্গায় দেখা মেলে না সবসময়। সেখানে পা রেখে দেবী মূর্তির দিকে তাকালে কানে ভাসে সেই অমোঘ লাইনগুলো, “জাগো দুর্গা, জাগো দশপ্রহরণধারিণী। অভয়াশক্তি বলপ্রদায়িনী, তুমি জাগো। জাগো, তুমি জাগো।” আবার বনেদি বাড়িগুলোতে একেবারে এমন রূপ দেখা যে মেলে না সেটাও বলা সঠিক নয়।

এই যেমন ধরুন না, বরানগরের দত্তবাড়ির দুর্গাপুজোর প্রতিমার রূপ কিন্তু অসুরদলনী নয়। সেখানে উমা যেন দত্তবাড়িরই মেয়ে। ব্যোমভোলার সঙ্গে মর্তে এসেছেন কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতীদের নিয়ে। এখানে উমার বাহন সিংহ নেই। বরং শিবের বাহন নন্দী মহারাজ রয়েছেন তাঁর প্রভুকে পিঠে বসিয়ে। শিবের কোলে রয়েছেন দেবী। তবে দেবীর হাতেও অস্ত্র বা ত্রিশূলও নেই। উমার দশ হাতের বদলে রয়েছে দুই হাত। তার মধ্যে একহাত দিয়ে তিনি আশীর্বাদ করছেন। শিব-দুর্গার পায়ের কাছে রয়েছে একটি কাটা মহিষের মুন্ডু। এটাই যা অল্পবিস্তর হিংসার ছবি। তবে সেটাও বলতে পারেন ঈঙ্গিতবাহী। প্রতিমার সামনে রয়েছে জয়া-বিজয়ার দুটি ছোট্ট মূর্তি। এই জয়া-বিজয়ার মূর্তি অনেক বনেদি বাড়ির প্রতিমার সামনেই লক্ষ্য করা যায়। দুশো বাহান্ন বছর ধরে এইরূপেই দুর্গাকে পুজো করে আসা হচ্ছে বরানগর দত্তবাড়িতে। এই বাড়ির সদস্যরা বলে থাকেন, এখানে দুর্গা আর শিব যেন বাড়ির জামাই আর মেয়ে।

Bonedi Barir Durga Puja: 252 years old Durga Puja at Baranagar Dutta Bari

এমন মন্ত্রমুগ্ধ প্রতিরূপ দেখতে দেখতে একটা গানের কথা মনে পড়তে বাধ্য আপনার। ইদানিং দোহার লোকগানের দল এই গানটা গায়। “বলদে চড়িয়া শিবে শিঙায় দিলা হাঁক/ শিঙ্গা শুনি মর্তেতে বাজিয়া উঠল ঢাক/ শিবের সনে কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতী/ আশ্বিন মাসে বাপের বাড়ি আসেন ভগবতী।” খুব জানতে ইচ্ছা করল এই গানের শিকড়টা কী? যাঁর মুখে এই গান একটা সময় শোনা, সেই কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য আর নেই। অগত্যা তাঁদের দলেরই আরেক গায়ক রাজীব দাসকে ফোন করে প্রশ্নটা করেই ফেললাম। তবে এই গানের প্রেক্ষাপট না জানতে পারলেও দু’চার কথায় এমন কয়েকটা তথ্য দিলেন সেটাও কম কীসের? এই গানটির কিছুটা অংশ লেখা কালিকাপ্রসাদের জ্যাঠামশাই শ্যামাপ্রসাদ ভট্টাচার্যের। আর এই গানের মাঝে কিছুটা রয়েছে প্রচলিত কথা। সেই অংশের রচয়িতার নাম জানা যায় না। আমি প্রচলিত অংশটায় যেতে চাই না, সেটা একটু অন্যরকম। তবে শুরুর এই কথাগুলো শ্যামাপ্রসাদ ভট্টাচার্যেরই। তিনি কী এমন কোনও দেবী রূপ দেখে এই লাইন লিখেছেন? প্রশ্ন থেকেই গেল। এর পরের কথাগুলো আরও সুন্দর, “গৌরী এল, দেখে যা লো / ভবের ভবানী আমার/ ভবন করিল আলো/ গৌরী এল,দেখে যা লো।।” প্রচলিত অংশটাতে আবার রয়েছে, “ও দেখি সিংহের উপর উইঠা ছুঁড়ি/ অসুরের টিক্কি ধরি।।” এই প্রসঙ্গটা কিন্তু আলাদা। আমি এই জায়গাটা নিয়ে আলোচনা করছি না। আমি গানের শুরুর কথাগুলো নিয়েই আলোচনা করছি।

Bonedi Barir Durga Puja: 252 years old Durga Puja at Baranagar Dutta Bari

বরানগর এমনিতেই একটা বর্ধিষ্ণু অঞ্চল। চৈতন্যদেব এখানে পা রেখেছিলেন সেই পাঁচশো বছর আগে। তারপর রামকৃষ্ণদেব, স্বামী বিবেকানন্দ, তাঁদের পার্ষদ-সহ কে না এখানে এসেছেন। ডাচরা কুঠি বানিয়েছিল এই বরানগরের কুঠিঘাট অঞ্চলেই। সেই কুঠিঘাট থেকে কিছুটা দূরে বলা যায় বর্তমানে বরানগর বাজারের পিছন দিকে এই দত্তবাড়ি।

Bonedi Barir Durga Puja: 252 years old Durga Puja at Baranagar Dutta Bari

পরিবারের সদস্য প্রিয়াঙ্কা দত্ত এই পুজো নিয়ে বলতে গিয়ে বলেন, “শিব-দুর্গা মূর্তি দেখে বুঝতেই পারছেন, মা তাঁর স্বামী-পুত্র-কন্যাদের নিয়ে বাপের বাড়ি এসেছেন। ষষ্ঠী থেকে বোধন শুরু হয়ে যায় আমাদের। অষ্টমীর দিনে ধুনো পোড়ানো হয়। এই রীতিতে বাড়ির মহিলারা লাল-পাড় শাড়ি পরে অংশ নেন ধুনো পোড়ানোতে। কুমারী পুজোর চল রয়েছে।”

Bonedi Barir Durga Puja: 252 years old Durga Puja at Baranagar Dutta Bari

ঠাকুর দালানের যে জায়গাটাতে প্রতিমাকে বসানো হয়, ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে সেই জায়গাটাকে এখনও মাটির রেখে দিয়েছেন এই বাড়ির সদস্যরা। শাক্তমতে পুজো হয়। একটা সময় পর্যন্ত মহিষও বলি হত। কিন্তু একবার বলির সময়ে বলির জন্য আনা মহিষটিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। দেখা যায়, বলির সময় পেরিয়ে গেলে, প্রতিমার চালচিত্রের পিছন থেকে বেড়িয়ে আসে মহিষটি। আসলে মহিষটি ভয় পেয়ে ঠাকুরদালানে উঠে গিয়ে প্রতিমার পিছনে আশ্রয় নিয়েছিল সেদিন। তারপর থেকে মহিষবলি বন্ধ হয়ে গিয়েছে দত্তবাড়িতে।

বিজয়া দশমীর দিন সকালে পুজোর পর পরিবারের মহিলা সদস্যরা প্রতিমাকে ঘিরে বেড়া অঞ্জলি দেন। দত্ত বাড়ির মেয়ে শান্তনা দত্ত বলেন, “পুজোর নিয়মকানুন আমরা একই রকমভাবে পালন করি। কিন্তু আগের থেকে একটু আকারে ছোট হয়ে গিয়েছে সব বিষয়। যেমন ধরুন এই মূর্তি আগে আরও বড় হত। এখন উচ্চতায় কমেছে।” এই বাড়ির ছোট ছোট সদস্যরাও পুজোর দিনগুলো বাইরের মণ্ডপে যায় না। দত্তবাড়ির পুজোর দালানই এই পরিবারের খুদে সদস্যদের চারণভূমি হয়ে ওঠে। আর এমন মেয়ে-জামাইয়ের মূর্তিই যেন প্রতিবছর পুজোর দিনগুলো আলো করে রাখে বরানগর দত্তবাড়ির পুজো দালানটাকে।

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ