নিজস্ব চিত্র
অর্পণ দাস: তুমিও হেঁটে দেখো কলকাতা… গলির পর গলি, তার ভিতরে তস্য গলি। এই হল কুমোরটুলি। পুজোর আগের ক’টা দিন যেন পা ফেলা দায়! একদিকে চলছে শেষ মুহূর্তের কাজ। জনৈক শিল্পী অর্জুনের মাছের চোখে তির বেঁধানোর একাগ্রতা নিয়ে প্রতিমার চোখে তুলি টেনে দিলেন। তার ঠিক বাইরেই ‘জ্যান্ত দুর্গা’দের ফটোশুট। ‘এই, এই সামলে… ঠাকুরের গায়ে যেন হাত না লাগে’, এরকম সংলাপও আসে কয়েকজন সাবধানি দর্শকের থেকে। রাস্তার ভিড়টা অতিক্রম করে শিল্পীদের ওয়ার্কশপে সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে অসংখ্য মাতৃমূর্তি। এই মাত্র ‘বলো দুর্গা মাইকি জয়’ ধ্বনির মধ্যে দিয়ে কোনও ক্লাবের উদ্দেশে সপরিবারে পাড়ি দিলেন তিনি। বাইরে ক্যামেরার ফ্ল্যাশ আর ভিতরে টিউবলাইটের আলো। সব মিলিয়ে, পুজোর আগে কুমোরটুলি জমজমাট!
চারশো বছর! যদিও একেবারে দিন গুনে বলা যায় না, কয়েক বছর এদিক-ওদিক হবেই। কিন্তু কালের হিসেবে তাতে কিছু এসে যায় না। কুমোরটুলি কিন্তু প্রথম থেকেই জমজমাট। সাবর্ণ চৌধুরীদের পুজোর ইতিহাস ধরলে কলকাতায় দুর্গাপুজোর ইতিহাস চারশো বছর তো হবেই। কুমোরটুলিতে অবশ্য তখন মূর্তি বানানো হত না। কলকাতার আদি কুম্ভকার সম্প্রদায় এখানে তৈরি করত মাটির বাসনপত্র। অনুমান যে, অধিকাংশরই আদি ঠিকানা ছিল হুগলির সপ্তগ্রাম। সরস্বতী নদী মজতে থাকায় তারা গঙ্গা সংলগ্ন অঞ্চলগুলিতে এসে থাকতে শুরু করে।
আসা যাক ১৭৫৭ সালে। বণিকের মানদণ্ড রাজদণ্ড হওয়ার পর আদেশ দেওয়া হয় একই পেশার সঙ্গে যুক্ত মানুষরা থাকবে একটি নির্দিষ্ট স্থানে। সেই অনুযায়ী গড়ে ওঠে কলুটোলা, আহিরীটোলা, ছুতোরপাড়া, কুমোরটুলি ইত্যাদি। ব্রিটিশদের নথি যদি ধরা যায়, তাহলে খাতায়-কলমে কুমোরটুলির গল্প এখান থেকে শুরু। সে বছরই রাজা নবকৃষ্ণ দেব শুরু করেন দুর্গাপুজো। কলকাতায় দুর্গাপুজোর প্রচলনের পর নদিয়া থেকেও অনেক মৃৎশিল্পী আসতে শুরু করেন। মাটির বাসন বানানোর সঙ্গে শুরু হয় মূর্তি তৈরির কাজ। ক্লাইভের আমল থেকে কলকাতার বাবুদের মধ্যে দুর্গাপুজো নিয়ে তোড়জোড় শুরু হয়েছিল। ওয়ারেন হেস্টিংসের আমলে আরম্ভ হয় প্রতিপত্তি দেখানোর প্রতিযোগিতা।
কুমোরটুলির প্রথম যুগের শিল্পী ছিলেন মধুসূদন পাল, কাঙালিচরণ পাল প্রমুখ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দেবীর মুখের আদল, পোশাক-আশাক, চালায় এসেছে বহু পরিবর্তন। সেসব নিয়েও আলাদা ইতিহাস হয়ে যায়। প্রথম যুগে হলুদ রঙের মাতৃমূর্তি, আমপাতার রঙের অসুর আর সাদা, সিংহের মুখ ইলিশের মতো—এটাই ছিল সনাতন রূপ। সিংহের মুখে থাকত পাকানো গোঁফ, আলতো করে কামড়ে আছে অসুরের হাত। আজও বনেদি বাড়ির পুজো পরিক্রমায় বেরলে দেখবেন দেব কিংবা লাহা বাড়ির পুজোর সিংহ এরকমই।
সিংহের কথা যখন উঠলই, তখন আরেকটা প্রসঙ্গ সেরে রাখা ভালো। আজকের দুর্গাপ্রতিমার সঙ্গে সিংহের যে রূপ, তা এল কবে? বাঙালি মৃৎশিল্পীর পক্ষে তো ‘বাস্তব’ সিংহ দেখা কার্যত অসম্ভব ছিল। ওই চওড়া কাঁধ, পেশীবহুল শরীর, আকাশে ওঠানো মাথা—এই রূপ যেন ইংরেজদের ঔদ্ধত্যের প্রকাশ। আঠারো শতকের শেষদিকে ভিক্টোরিয়া ভারতের ‘রানি’ হওয়ার পর রাজভবনের তোরণে কেশর দোলানো সিংহের মূর্তি বসান লর্ড ওয়েলেসলি। সেই রূপটাই কি পরে দুর্গাপ্রতিমার সঙ্গে জুড়ে গেল? এক পরাধীন জাতির অসহায়তাও কি এর সঙ্গে মিশে যায় না? কোনও শিল্পকর্মই জগদ্দল পাথরের মতো আটকে থাকে না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাতে পরিবর্তন আসে। সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতিও জড়িয়ে যায় তার সঙ্গে।
ঠিক যেভাবে একচালা বহু খণ্ডে ছড়িয়ে পড়ার নেপথ্যেও রয়েছে ইতিহাস। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অভিঘাত, আর্থিক মন্দা ও শিল্পায়নের জেরে টুকরো হতে শুরু করেছে যৌথপরিবার। তা যেন ধরা পড়ল পাঁচচালার খণ্ডিত রূপে। এই রূপবদলের কাহিনি জড়িয়ে রয়েছে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে। সেই মিথের চর্চায় ঢুকব না। কিন্তু যিনি এই বদলটা আনলেন, তার গল্প না বললে কুমোরটুলির ইতিহাস সম্পূর্ণ হয় না। তাঁর নাম গোপেশ্বর পাল।
১৯১৫ সালে লর্ড কারমাইকেল কৃষ্ণনগরের ঘূর্ণিতে এসে গোপেশ্বরের হাতের কাজ দেখে উপাধি দেন, ‘দ্য লাইটনিং স্কাল্পচার’। ১৯২৪ সালে লন্ডনের ওয়েম্বলি পার্কে ব্রিটিশ রাজত্বের বিশেষ প্রদর্শনীতে দেখা গেল জি পালকে। দেশবিদেশের শিল্পীদের সঙ্গে মাটির পুতুলের ডালি নিয়ে উপস্থিত বাংলার এক মৃৎশিল্পী। তাল তাল মাটি দিয়ে মূর্তি গড়ে তুলছেন আত্মমগ্ন এই শিল্পী। সেই প্রদর্শনী দেখতে আসেন রানি ভিক্টোরিয়ার পুত্র ‘ডিউক অফ কনট’। বঙ্গশিল্পীর মণ্ডপের কাছে দাঁড়িয়ে বাকরুদ্ধ তিনি। যেন কোনও এক জাদুকর চিন্ময়কে মৃন্ময়রূপ দিচ্ছেন। মাটি দিয়ে তৈরি হয়ে গেল কনটের রূপ। মুহূর্তের মধ্যে ভিড় জমে গেল সেখানে। পরদিন লন্ডনের সংবাদপত্রে জি পাল অর্থাৎ গোপেশ্বর পালের নাম ছাপা হতেই বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে গেল কৃষ্ণনগরের গল্প, সঙ্গে কুমোরটুলিরও। ইংল্যান্ড থেকে ফিরে কুমোরটুলিতে স্টুডিও তৈরি করেন গোপেশ্বর। ১৯৩৭ সাল নাগাদ পাঁচচালা হওয়ার সময় গোপেশ্বর পালই মাতৃমূর্তির হলুদ রংয়ে মেশান গোলাপি। আবার পরে রমেশ পাল মেশান কমলা রং।
এরপর এল উত্তাল চারের দশক। বাঙালির জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠল দুর্ভিক্ষ, স্বাধীনতা আন্দোলন, দাঙ্গায়। ক্রমে দেশভাগের সঙ্গে এসে পড়ল স্বাধীনতা। তিনের দশকের একচালার মূর্তিতে কিন্তু অসুরের মুখ হাঁ থাকত না। ক্রমে সেই অসুরও দাঁত-নখ নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। জোরাল হল সিংহের কামড়। দুর্গার ত্রিশূলের আঘাতে রক্তের ঝলক ফিনকি দিয়ে উঠল। গোটা চারের দশকজুড়ে একের পর এক হিংসাত্মক ঘটনার প্রভাব কি এভাবেই পড়ল মাতৃপ্রতিমায়?
দেশভাগের পর পূর্ববঙ্গ থেকে বহু শিল্পী কুমোরটুলি চলে আসেন। রুচি-ভাষাগত তফাত তো ছিল। কিন্তু সবচেয়ে বড় হয়ে দেখা দিল সাংস্কৃতিক চেতনার পার্থক্য। পূর্ববঙ্গের শিল্পীরা অনেক আগে থেকেই বহুচালার মূর্তিতে অভ্যস্ত ছিলেন। ফলে তাদের জনপ্রিয়তাও বাড়ল। ১৯৪৭-এ ফরিদপুর থেকে আসেন ধনঞ্জয় রুদ্রপাল। পরের বছর ঢাকা-বিক্রমপুরের রাখাল পালের সঙ্গে আসেন তাঁর চার ভাই হরিবল্লভ, গোবিন্দ, নেপাল ও মোহনবাঁশি। সাতের দশকে গোরাচাঁদ পালের চেতনায় ধরা দিল গ্রামবাংলার মাতৃমূর্তি। রাখাল পাল, অনিল পাল, নেপাল পাল প্রমুখ ভাস্বর হয়ে উঠলেন আপন প্রতিভায়।
সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলিতেছে। সারা বছরই কমবেশি ভিড় লেগে থাকে। কিন্তু পুজোর আগের ছবিটা সম্পূর্ণ আলাদা। ওই ভিড়ের অধিকাংশ মানুষ হয়তো জানেই না, সারাবছর কুমোরটুলির গলিগুলো দেখতে কেমন লাগে? কিংবা পুজোর ঠিক আগে আগে আগ্রহী দর্শকদের চোখ উপেক্ষা করার অনুশীলন চলে কীভাবে? আসলে কয়েকশো বছরের ইতিহাস তার প্রধান পৃষ্ঠপোষক। পরিবর্তনের বহু গলি ঘুরে এসে এক রয়ে গিয়েছে সেই চক্ষুদানের বিদ্যা। শরতের পেঁজা তুলোর মতো মেঘ, কাশফুল আর প্রতিবছর কুমোরটুলির ভিড় বাড়তেই বোঝা যায়, ‘মা আসছে’।
ঋণস্বীকার:
কলকাতার প্রতিমাশিল্পীরা, অনিতা অগ্নিহোত্রী
কলকাতার স্থাননাম, সুবীর ভট্টাচার্য
কুমোরটুলির চারশো বছরের বিবর্তন, জয়ন্ত দাস, দেশ, ১৯৯৮
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.