অভিরূপ দাস: যে ঘরে এসেছিলেন ছত্রপতি শিবাজির আত্মা। সেখানেই পরলোকগত পরিজনকে ডাকতে চান তাঁর কুটুম্ব-স্বজন। প্রার্থনা একাধিক।
বয়সজনিত কারণে অকস্মাৎ মারা গিয়েছেন দাদু। ভাগ্যহীনা নাতনির বক্তব্য, “অনেক কথা বলে যেতে পারেননি। একটু সাহায্য করুন। সে কথা জানতে চাই।”
স্বজন হারানো পরিবারবর্গের ভিড় কলেজ স্কোয়ারে বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিটে দ্য বেঙ্গল থিওসফিকাল সোসাইটিতে। সংগঠনের অ্যাসোসিয়েট মেম্বার জয়শ্রী দাসের কথায়, “ফি সপ্তাহে কেউ না কেউ আসছেন। সকলকেই আমরা বলি এখানে এসে কোনও লাভ নেই। আমরা এখন প্ল্যানচেট করি না। যদি সত্যিই জানতে চান প্রয়াত প্রিয়জনের কথা, একান্তে ধ্যানে বসুন। মনঃসংযোগ করতে পারলে সেখান থেকেই উত্তর পাবেন।”
কেন এত ভিড় ৪/৩ এ বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিটের ঠিকানায়? নিচের বই-ঘর পেরিয়ে মান্ধাতার আমলের সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেলে যে হলঘর। সেখানেই তো প্ল্যানচেটে বসেছিলেন খোদ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পুত্র শমীন্দ্রনাথের আত্মাকে নামিয়ে এনেছিলেন।
১১৬ বছর আগে প্রখ্যাত আইনজীবী সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়ও নিয়মিত ঘর অন্ধকার করে প্ল্যানচেট করতেন এখানে। কথায় বলে তাঁর প্ল্যানচেটে এসেছিলেন খোদ ছত্রপতি শিবাজি। সেসব গল্প লোকমুখে ফেরে। যে কারণে প্রয়াত স্বজনদের সঙ্গে কথা বলতে অনেকেরই ভরসা বেঙ্গল থিওসফিকাল সোসাইটি।
১৮৭৫-এ আমেরিকায় এই সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন দুই পরলোকবাদী হেলেনা পেত্রোভনা ব্লাভাটস্কি, কর্নেল হেনরি অলকট। দুই পরলোকবাদীর মৃত্যুর পর থিওসফিকাল সোসাইটির সভাপতি হন অ্যানি বেসান্ত। পরলোকচর্চায় তিনিও অত্যন্ত সুপরিচিত। ১৮৮২ সালে তাঁর উদ্যোগে কলকাতায় গড়ে ওঠে এই শাখা। কলকাতায় যে ঘরে অ্যানি বেসান্ত থাকতেন তা এখনও বিরাজমান। একসময় এই সমিতির পরিচালনায় যুক্ত ছিলেন রবীন্দ্রনাথের দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, দিদি স্বর্ণকুমারী। দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলায় প্রেতচর্চায় চর্চিত নাম।
পরলোকগত পরিজনদের সঙ্গে কথা বলতে আগ্রহীদের স্রোতে তাই দোষ দেখেন না অনেকে। এহেন ঐতিহ্যশালী প্রেতচর্চার প্রতিষ্ঠানে আজ কেন বন্ধ প্ল্যানচেট? ‘দ্য বেঙ্গল থিওসফিকাল সোসাইটি’র সদস্যরা মনে করছেন, সমাজের আর পাঁচটা ক্ষেত্রর মতো প্রেতচর্চাতেও প্রবেশ করেছে বেনোজল। বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিটে সোসাইটির কালচারাল কনভেনর মধুশ্রী চৌধুরী জানিয়েছেন, “প্রেতচর্চার বিষয়ে অনেক বেনোজল ঢুকে গিয়েছে। আমাদের সংগঠনের পূর্বজরাই তা বুঝতে পেরেছিলেন। যাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন তাঁরাই হয়তো এটা বন্ধ করে দিয়ে গিয়েছেন।” আজকাল কোনও দুর্ঘটনার পর আকছার সেখানে পৌঁছে যান প্যারানর্মাল অ্যাক্টিভিস্টরা। কথায় কথায় আত্মা নামিয়ে দেখান। মধুশ্রীর ধারণা, “সিংহভাগেরই কোনও সারবত্তা নেই। প্রেতচর্চা কোনও প্রচারের বিষয়ই নয়। উপলব্ধির বিষয়। হিমালয়ে যে ঋষিরা এই কাজ করেন তাঁরা লোকসমাজে আসেনই না।” সংগঠনের এক সদস্যের আবার অভিমত, “যখন আত্মাকে ডাকা হয় তাঁর কষ্ট হয়। আর ডাকলে যে একজনই। আসবে তার কী মানে। ওই জন্য হয়তো বলা হয়েছে আত্মাকে ডেকো না।”
এহেন বিতর্ক এড়িয়ে নতুন প্রজন্মের অনেকেই থিওসফি সমাজের সদস্য হতে চান। এই বছর সোসাইটির ইন্টারন্যাশনাল কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হচ্ছে কানাডাতে। দেশ থিওসফিকাল সোসাইটির একাধিক শাখা থেকে ৭১ জন যাচ্ছেন কানাডায়। কলকাতা থেকে যাচ্ছেন জয়শ্রী দাস। তবে এই সোসাইটির প্রেতচর্চার বিষয়টিতে একটু বিরক্ত সদস্য সত্রাজিৎ চক্রবর্তী জানিয়েছেন, শুধু প্রেতচর্চা নয়। জাত-পাত-ধর্ম-লিঙ্গ এসবের ঊর্ধ্বে উঠে গোটা মানবজাতিকে সৌভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করার কাজ করতে চায় সোসাইটি। দু’টি গ্রিক শব্দের যোগফল এই থিয়োসফি। ঘিয়স শব্দের অর্থ ঈশ্বর, সোফিয়া হচ্ছে উইসডম বা প্রজ্ঞা। সেটাই প্রতিষ্ঠা করা আসল উদ্দেশ্য।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.