পড়াশুনোয় খারাপ ছিলাম না। বর্তমানে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করি। এছাড়া রেডিও শুনতে ভালোবাসি, ভালো খাবার খেতে ভীষণ পছন্দ করি। কিন্তু এ সমস্ত পরিচয় ছাপিয়ে সবার প্রথমেই মানুষ আমাকে কোন পরিচয়ে চেনেন, জানেন? দৃষ্টিহীন! অথচ অন্যদের মতো দুর্গাপুজো এলে আমারও তো আনন্দ হয়! কলম ধরলেন বিশেষভাবে সক্ষম সায়ন্তন বন্দ্যোপাধ্যায়।
ছোটবেলা থেকেই আমি চোখে দেখতে পাই না। এক মধ্যবিত্ত পরিবারে দৃষ্টিহীন হয়ে জন্মানো তো কেবল আমার একার দায় হয়ে থেমে থাকে না! আমার জন্য বাবা-মা-দাদাকে বারেবারে নানান কটাক্ষ শুনতে হয়েছে। আমি কী পারি, কতখানি পারি, তা আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইত লোকে। কোনও একটি অঙ্গ অচল হলেই যেন সে মানুষ ভিনগ্রহের বাসিন্দার মতো অদ্ভুত হয়ে যায় সমাজের চোখে!
তবে উদযাপনের আনন্দ অনুভব করেছিলাম ছোটবেলাতেই। তুতো-ভাইয়েদের সঙ্গে ঠাকুর দেখতে বেরোতাম। দেবী দুর্গার কয়টি হাত, কোন হাতে কোন অস্ত্র, কার্তিক-গণেশ কে কোনখানে বসে রয়েছে, সবটুকুই বলে দিত ভাই। আমি শুনতাম। ও-ই আমার দেখা। আমার শারীরিক অক্ষমতা নিয়ে মানুষের ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ কানে আসত যে বয়সে, সেই বয়সেই শুনেছিলাম মহিষাসুরমর্দিনী… বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠে। পুজো আর রেডিও যেন সমার্থক হয়ে গেল আমার কাছে। তাছাড়া বিরিয়ানি-চাপের গন্ধ, ধুনোর গন্ধ, মানুষের হই-হুল্লোর… পুজো যেন একসঙ্গে এই সব কিছু নিয়ে আসত আমার অনুভবে। আসলে আমার স্পর্শেই যেন পুজো দেখা! মাকে দেখা। নিরন্তর ছুঁয়ে দেখা মা দুর্গাকে।
নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন ব্লাইন্ড বয়েজ অ্যাকাডেমি জীবন সম্পর্কে আমার দৃষ্টিভঙ্গি অনেকখানি বদলে দিয়েছিল। অনুভব করেছিলাম, যা পেয়েছি, তা-ও কম নয়। এই অক্ষমতাকে স্বীকার করেই মাথা উঁচু করে, সসম্মানে বাঁচা শিখতে হবে। সে সময় পুজোর আনন্দ হয়ে গিয়েছিল একেবারে অন্যরকম। আকাশবাণীর আরজে-রা পুজোর চারদিন জুড়েই রাত ন’টা থেকে বারোটা পরিক্রমায় বেরোতেন। কোন প্যান্ডেলে কী দেখা যাচ্ছে, তাঁদের গলায় শুনে শুনেই দেখা হয়ে যেত আমারও।
আমাদের মতো মানুষদের কাছে জগতের অনেকখানিই তো স্পর্শনির্ভর। তাই দেবী দুর্গাকে ছুঁয়ে দেখার যে অভিজ্ঞতা জীবনে একবারই ঘটেছিল, তা আজও স্মৃতিতে অমলিন। সৌজন্যে, বালিগঞ্জ কালচারাল। সাল ২০১৮, জানতে পারলাম দৃষ্টিহীনদের জন্য আলাদা করে মণ্ডপ তৈরি হচ্ছে। ভিতরে মা দুর্গার প্রতিমা তো ছিলই, তবে মণ্ডপের বাইরের অংশে দৃষ্টিহীনদের সুবিধার্থে আরও একটি প্রতিমা ছিল, যা ছুঁয়ে আমরা মায়ের অবয়ব অনুভব করতে পারি। কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে পড়তেও বন্ধুরা সঙ্গে যেত পুজোর সময়ে। ওরাই সব বলে বলে দিত।
মানুষ যত বড় হয়, পুজোর অর্থ তো পালটে যায় অনেকখানি। আমার ক্ষেত্রেও তাই। এখন পুজো এলে মনখারাপ লাগে। মনে হয়, আরও একটা বছর ফুরিয়ে গেল। ভাবি, সবাই তো ‘ইনক্লুশনের’ কথা বলে। কিন্তু সেই ছোটবেলার পর থেকে আর তো কখনও এমন পুজো মণ্ডপ দেখলাম না যেখানে দৃষ্টিহীনদের সুবিধের কথা ভাবা হয়েছে! অথচ কত রকমারি থিম পুজো হয় আজকাল। শারীরিক প্রতিবন্ধীদের কথা ভেবে হুইল চেয়ার, অথবা অডিও-ভিস্যুয়াল মাধ্যমে পুজোর বিবরণী – এতটুকু কি করা যায় না প্রত্যেক পুজো মণ্ডপে? যাতে আমি অথবা আমরা, বাবা-মা-বন্ধু-আত্মীয় কারও সাহায্য ছাড়াই পুজো অনুভব করতে পারি?
অনুলিখন –উৎসা তরফদার।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.