টিটুন মল্লিক, বাঁকুড়া: সালটা ১৯৫৯। সেই সময় গ্রামাফোনের প্রচণ্ড ক্রেজ। বাড়িতে ওই যন্তর একটা থাকবে না এটা ভাবাই যায় না। তাই বাবার কাছে বায়না ধরে এইচএমভির গ্রামাফোন আনিয়েছিলেন আজকের অশীতিপর নবীনগোপাল সেনগুপ্ত। ইংল্যান্ড থেকে বন্ধুর হাতে ভালভ সিস্টেম রেডিওগ্রাম উইথ রেকর্ড প্লেয়ারও আনিয়েছিলেন। সম্মিলনী কলেজে পড়াকালীন পুজোর সময় বন্ধু-বান্ধবীরা বসে শুনত নজরুল গীতি আর হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠের সেই সোনালি সুর। সেইসব স্মৃতি মনে পড়লেই চিকচিক করে ওঠে তাঁর চোখ। মুখে খেলে যায় তৃপ্তির দ্যুতি।
মহালয়ার আগে গ্রামাফোনের খোঁজ করতে বাঁকুড়ার লালবাজার এলাকায় নবীনবাবুর বাড়িতে গিয়ে দেখলাম নরম কাপড় দিয়ে পিনের মুখ মুছে তা পরিষ্কার করে রাখা রয়েছে ছোট্ট একটি কাঠের বাক্সে। সাবধানে খুব যত্ন করে রাখা একেকটা স্টাইলিশ পিন। বাড়িজুড়ে সারি সারি দাঁড়িয়ে থাকা কাঠের পুরাতন আলমারিতে তাক দিয়ে আজও রাখা আছে কালজয়ী সব রেকর্ড। কী নেই তাতে।
‘হিন্দুস্থান’, ‘মেগাফোন’, ‘সেনোলা’র পাশাপাশি ‘অলিম্পিক’, ‘ডিলাইট’, ও ‘ওরিয়েন্টাল’ রেকর্ড কোম্পানির পুজোর বিশেষ অ্যালবামও রয়েছে। চণ্ডীচরণ সাহার কলকাতার ৬/১ অক্রুর দত্ত লেনের ‘হিন্দুস্থান মিউজিক্যাল প্রোডাক্টস অ্যান্ড ভ্যারাইটিস্ সিন্ডিকেট লিমিটেড’-এর ‘হিন্দুস্থান রেকর্ড মেগাফোন’ রেকর্ড কোম্পানির পুজোর অ্যালবামগুলি, ‘শারদীয়া সুরধারা’, সেনোলা রেকর্ডের ‘পুজোর পল্লবিতা’, অলিম্পিক রেকর্ডসের ‘পূজার উজ্জ্বলতা’, ডিলাইট রেকর্ডের ‘পূজার আনন্দধারা’ এবং ওরিয়েন্টাল রেকর্ডের ‘শারদীয়ার সন্ধ্যা’— সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা আলমারি একেকটা দরজা খুলে এইসব কালজয়ী সংরক্ষিত অ্যালবাম দেখাতে দেখাতে নিজেই কাঁপা গলায় নবীনবাবু ও তাঁর মেয়ে মৌ সেনগুপ্ত গুনগুন করে উঠলেন, “ভোর হল কে যেন সরোদে শারদীয়া সুর বাজায়, চোখ মেলো দেখো সোনা রোদে পাখিরা ডানা ভাসায় ওই নীল নীল দূর আকাশে স্বপ্নেরই আবেশে আগমনী শোনা যায়।” গানের কলি শেষ হতেই নবীনবাবু বললেন, “প্রতিটি অ্যালবামের সুর ছিল যেন নতুন উৎসবের প্রতীক।”
তাঁর ঘরের কোণে গলা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা গ্রামাফোনের দিকে এগিয়ে গিয়ে ঘুরতে থাকা ‘শারদীয়ার সন্ধ্যা’ রেকর্ডটিতে পিন ঘুরিয়ে বাজাতে শুরু করলেন তিনি। অ্যানালগ সাউন্ড সিস্টেমে পুরো বাড়িজুড়ে বাজতে শুরু করল শারদীয়ার মধুর আবেশ। শুধু তাই নয়, একে একে বাজল হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠের সেই সুর। যা আজও অনেকেরই হৃদয়ে ভাসে।
বাঁকুড়া শহরের লালবাজার এলাকার বাসিন্দা নবীন গোপাল সেনগুপ্ত। তাঁর বাবা গোলকধীরাজ সেনগুপ্ত। মা অপর্ণা সেনগুপ্ত। মা, বাবা দু’জনেই গত হয়েছেন বহুদিন আগে। মা-বাবার প্রসঙ্গ উঠতেই আবেগে ভরে ওঠে বৃদ্ধ নবীনবাবুর গলা। বললেন, ‘‘মা শ্যামা সংগীতের অনুরাগী ছিলেন। মায়ের প্রিয় গান ছিল, ‘শ্যামা মা কি আমার কালো’, পান্নালাল ভট্টাচার্যের গাওয়া এই ভক্তি সংগীতে মায়ের অন্তর্নিহিত রূপের দর্শন ফুটে ওঠে।’’ এরপরই হাত বাড়িয়ে আলমারি থেকে পান্নালাল ভট্টাচার্যের একের পর এক শ্যামা সংগীতের রেকর্ড প্লেট বের করতে শুরু করে দেন তিনি। তিনি বলেন, ‘‘পুজোর (Durga Puja 2025) আগমন মানেই নতুন রেকর্ড হাতে নিয়ে ঘরময় ছুটে বেড়ানো, রেকর্ডের পিন ঘুরিয়ে সেই সুরের জাদু ছড়িয়ে দেওয়া।’’
কথা বলতে বলতেই স্মৃতির সারণিতে ডুব দেন নবীনবাবু, ‘‘১৯৫৯ সাল, স্কুল ফাইনাল পাশ করার পর বাবার কাছে বায়না করে সংগ্রহ করেছিলাম গ্রামাফোন।’’ এসব কথা শুরু করতেই তাঁর দুই নয়ন চিকচিক করে ওঠে। বাবাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে সেই সময় তাঁর কেনা গানের সুরের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ধারক আজও নরম আদরে সেনগুপ্ত পরিবারের শোভা বাড়ায়। বাবার কাঁধে হাত দিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছিলেন নবীন বাবুর একমাত্র মেয়ে মৌ সেনগুপ্ত। তাঁর কথায়, ‘‘ডিজিটাল যুগেও সেই পুরনো রেকর্ড আর গ্রামাফোনের আলাদা গন্ধ আছে!’’ নবীনবাবু বলেন, ‘‘পুজোয় বাঁকুড়া থেকে ট্রেন ধরে কলকাতায় গিয়ে সি সি সাহার রেকর্ড দোকানের রাত জেগে দাঁড়িয়ে রেকর্ড কেনা—সেই স্মৃতি আজও মনে ভাসে তাঁর। প্রতিটি রেকর্ড ছিল যেন নতুন এক উৎসবের প্রতীক।’’
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.