রমেন দাস: রাজপথ পেরিয়ে গলিতে প্রবেশ করতেই কর্ণভেদ করে তীব্র শব্দ! ঝংকার তোলে, ‘ও দাদা, লাগবে নাকি!’ অবাক হতে হয় না, কিন্তু পেশার তাগিদে চোখাচোখি হয়! রোদ ঝলঝলমলে আকাশের মতোই ফ্যালফ্যালে দৃষ্টিতে যেন এক আকাশ স্বপ্ন ভর করে ওঁদের চোখেও! প্রশ্ন জাগে মরমে, খরিদ্দার নয় তো!
আসলে কুসুম তোমার মন নাই? শরীর-স্পর্শের কথকতার পাহাড়ে এই কুসুমরা যেন ভিন্ন! যৌনপল্লির অন্দরেও স্বপ্নের আফিমে বুঁদ হয়ে ওঁরা যেন ভাবেন ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’র শশীর কথা! যে শশীর আলোকে একদিন জীবন বদলানোর কথা থাকলেও কেমন যেন একই রয়ে যায় সবটা! যৌনপল্লির অন্ধকার ঘরে নিঝুম বসন্তে ওঁরাও যেন লেখেন পুজো-প্রেমের কবিতা! লড়াই! তপ্ত পিচগলা রাস্তার কাঠিন্যের মতোই এখানে যেন কথা বলে গলির ভাঁজ! গাড়ির কোলাহল পেরিয়ে এক অন্য দুনিয়া দেখায় রোজ! যেখানে দেওয়া-নেওয়া আর পেশার কলরবে প্রবেশ করে শুধুই লড়াই!
সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ের পাশে জটাধারী পেট্রল পাম্পের একেবারে পাশের রাস্তা দিয়ে একটু এগোলেই বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ যৌনপল্লি! প্রতিমুহূর্তে যেখানে শরীরের গন্ধে ওঠে হিল্লোল! নিরন্তর ‘মন্দ’ মেয়ের উপাখ্যানে রচিত হয় এক-একটি যন্ত্রণার উপন্যাস! নিঃশব্দ কান্না যেন বলে যায় আগমনির কথা! এক-একটি কুঠুরিতে, একের পর এক আকাঙ্ক্ষায় লিপ্ত হয় পেশা-নেশা এবং পেটের টান! কী নেই সেখানে! দালাল, ছিনতাইয়ের ভয়, লুকিয়ে থাকা রোগ, নিরলস সমাজসেবা! আবার মুদ্রার অন্যদিকের অন্ধকার ছাড়িয়েও রয়ে যায় মানব পাচার, তীব্র ব্যবসাও! উৎসব আর আতিশয্যে ভরপুর পুজোর কলকাতা ছাড়িয়ে এখানে যেন কেউ বলে যান ভিন্নকথা, অন্য পথ! সব কিছুর পাথুরে সেতুর পরতে পরতে ঝরে ওঁর অথবা ওঁদের জীবনের ক্যালেন্ডার ! যে কথার ভিড়ে বিবর্তিত হয় প্রাচীনতম কোনও আদিম ইচ্ছাও! আর প্রখর রোদ্রে ঘামে ভেজা শরীর নিয়েই শুরু হয় সিনেমা! অচিরেই বড়পর্দার ‘গাঙ্গুবাই’রা ধরা দেন রিপোর্টার দাদার কাছে!
এত কিছুর ভিড়েও কেমন পুজো কাটায় ওঁরা? দুর্বার, আমরা পদাতিকের মতো সংগঠনের কালজয়ী কাজের গহ্বরেও কীভাবে মনে থেকে যায় পদদলিত ইতিহাস, অত্যাচারের পুরনো কথার দিননামচা! পুজো আসলেই কেমন লাগে ওঁদের? পাকা রাস্তায় দু’পাশে খরিদ্দারের আশায় জ্বলজ্বল করা চোখগুলো যেন নিমেষেই উত্তর দেয়! সমস্ত উন্নয়নের মধ্যেও পাশে থাকার তীব্রতর তাগিদেও বলে যায়, মনের কথা! গহীনের কথা! অতলের কথা! ওঁরাও যেন এযুগের দুর্গা! আর সেই ‘দেবীদর্শন’ সেরে এগোতে এগোতেই নজরবন্দি হলাম আমিও। প্রশ্নের পাহাড় পেরিয়ে, কিছু সাহায্যের মিশেলে শুরু হল কথার পিঠে কথা!
বয়স বেড়েছে! অশক্ত শরীর! কাঁধে ছোট্ট ব্যাগ! পরনে সাদা এবং বেগুনি রঙের শাড়ি! ওই ব্যাগেই যেন এক সমুদ্র সম্পদ! হনহন করে হাঁটার গতি! দুর্গা চলেছেন যুদ্ধে! কথা শুরু হতেই বোঝা গেল, বয়সে বেশি হলেও এ-ও যেন সোনাগাছির সেই যুবতী মেয়েটি! যাঁকে হয়ত একদিন প্রায় বাধ্য হয়েই আসতে হয়েছে অচেনা-অজানা কলকাতায়! অথবা অন্য কিছু… মনেপ্রাণে আজও যুবতী সোনাগাছির ‘তিনি’! গম্ভীর গলায় প্রশ্ন? কেন পুজোর গল্প বলব, টাকা পাব তো? আপনাকে সময় দেব কেন? আমার কাজে তোমার কী? একের পর এক গোয়েন্দা সুলভ প্রশ্নের মোড়কে বারবার দেখে নেওয়া রেকর্ড করছি না তো! ছবি তুলছি না তো? কারণ, সম্মানরক্ষার শেষ চেষ্টাটুকু নিয়েই বাঁচেন ওঁরা! সমাজকর্মী হিসেবে প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষায় ওঁরা শুধু চান ভালো থাকার সামান্য আয়োজন! প্রত্যেক মুহূর্তে পরিবার, দায়িত্ব আর পেটের দায়ে কর্কশ শব্দেই জয় করেন দুনিয়া! বাবুরা এলেই বাড়ে ব্যস্ততা। যৌনপেশায় সুখ খোঁজেন শুধুমাত্র লড়াইয়ের তাগিদেই!
গলির ভাঁজ অথবা দেওয়ালের ছত্রে ছত্রে জমা শ্যাওলার মতোই স্যাঁতসেঁতে যেন ওঁদের পুজোও! ষষ্ঠী থেকে দশমী খরিদ্দার মাঝে। মাঝে কম হয়! কখনও আবার দিবারাত্র বাড়ে ব্যস্ততা। কেউ ফেরেন নিজের ঘরে, যে ঘর একদিন বিতাড়িত করেছিল! যে সমাজ আজও বাঁকা চোখে দেখে হয়ত! অজানা-অচেনা স্মৃতিতে যে পথ কাঁটা বিছিয়ে দেয় রোজ! সেই পথেই ‘ঘরে’ ফেরেন কেউ কেউ। আবার বেশিরভাগই থেকে যান নিজের জন্য! বিচ্যুত হয়েও আঁকড়ে ধরতে চান নিজেদের! সকলের কাছে বঞ্চিত হয়েও মায়ের কাছে যেন বলতে চান, সম্মান পাব তো মা? সোনাগাছির বিখ্যাত পুজো হয় দুর্বার সংগঠনের উদ্যোগে। প্রকাশ্য পুজোয় প্রায় ‘অচ্ছুৎ’ হলেও এই পুজো ভালো রাখে ওঁদের! প্রতি মুহূর্তের কথকতার ভিড়ে নিজেরাই যেন মায়ের কোলে উজাড় হন ওঁরা। সুন্দর শাড়ি, লিপস্টিক, মেকআপের প্রলেপ লাগে রোজ, কিন্তু দুর্গা-উৎসবের সেই সাজ চোখের জল ঢাকার নয়, খানিকটা আঁকড়ে থাকার! একটুখানি ভালোথাকার!
স্বামী কলকাতা ‘ঘুরতে’ নিয়ে এসে বিক্রি করেছিল কাউকে কাউকে! এই গল্পের নায়িকার তেমন হয়েছিল কি না, উত্তর মেলেনি! কিন্তু মুহূর্তেই অন্ধকার পাহাড়ে পা পিছলে গিয়েও লড়াইয়ে ফেরার কথা কথা এসেছে বারবার। পুজোর ভোগের সুবাসে জীবনের স্বাচ্ছন্দ্যের সুবাস ভেসেছে রোজ! মহাষ্টমীর পদ্মের পাঁপড়ির মতো ঝরেছে স্বপ্ন। দশ হাতের বদলে এখানে বড় হয়েছে টিকে থাকার লড়াই! দুই হাতেই চুল বেঁধেছেন অন্যরকম ওঁরা! বেঁচে না থাকার ইচ্ছা পেরিয়ে প্রায় তিন দশক সোনাগাছিতেই কাটিয়ে দিচ্ছেন আমাদের গল্পের নায়িকা! কিন্তু আজও মহালয়ার ভোরে তাঁর মনে পড়ে বাড়ির কথা! ষষ্ঠীর বোধনে পরিবারের জন্য কাঁদে মন! নিজেদের পুজোয় মাতৃদর্শনের পরেও বালিশে মাথা রাখতে হয়! দুর্বল শরীরে, পেশার তাগিদ পেরিয়ে মানসিক যন্ত্রণার রেলগাড়ি সৃষ্টি করে সুনামি! ঘুপচি ঘরে তেলচিটে বালিশ ভেজে বৃষ্টিতে। দুঃখের বৃষ্টি! জীবনে বহু কিছু না পাওয়ার কথা ঝড় তোলে বারবার!
জীবনের মার্কশিট নয়, এখানে রাস্তার পাশের বাড়ির নম্বর গুরুত্বের। সমাজসেবার মতোই সমাজের নিয়ন্ত্রক যেন ওঁরা! প্রত্যেক সেকেন্ডে গুনতে থাকেন জীবন! আসলে অপরাধ কমা, অসুর নিধনের গল্পলোকে, বহু চ্যালেঞ্জের মিশেলে খানিকটা যেন ‘গঙ্গাজল’ যৌনপল্লি! দুর্গা পুজোয় এখানকার মাটির ‘মিথ’ পেরিয়েও মায়ের জন্যই বাঁচেন ওঁরা! যে মা নির্বাক! মাত্র পাঁচ দিনের আলোকে জীবন বদলানোর কথা বলে বারবার! যে মা-মেয়ের মতো আগলে রাখেন কলকাতার ‘দিদি’দের! সেই মায়ের কথা বলতে গিয়েই ওঁরা বলেন, লড়াই থাকবে, কষ্ট প্রায় ভুলেছি, বাঁচার চেষ্টা করছি রোজ! কিন্তু অসম্মান কাটবে তো মা?
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.