রমেন দাস: স্ত্রী-কন্যার সঙ্গে কাশ্মীর বেড়াতে গিয়েছিলেন বেহালা নিবাসী সমীর গুহ। পহেলগাঁওয়ের বৈসরন উপত্যকায় বড়জোর মিনিট পনেরো আগে পৌঁছেছেন তাঁরা। আচমকাই কানে এল একের পর এক গুলির শব্দ। প্রাথমিকভাবে স্থানীয় দোকানদারেরা জানান, বিষয় তেমন কিছু না। নেহাতই বাঁদর তাড়াতে ভারতীয় সেনাকর্মীদের রোজকার প্রয়াস। তা বলে এতবার? সন্দেহ বাড়তে প্রশ্ন করেছিলেন সমীর। ততক্ষণে দেরি হয়ে গিয়েছে। জঙ্গিহানার কানাঘুষো খবর কানে আসতেই স্ত্রী, কন্যা-সহ সমীর নিজেও মাথা নিচু করে শুয়ে পড়েছিলেন মাটিতে।
কলমা পাঠের ‘হুমকি’ এসে গিয়েছে ততক্ষণে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই সমীরের মাথা লক্ষ্য করে গুলি চালায় এক সন্ত্রাসবাদী। মুহূর্তে লুটিয়ে পড়ে তাঁর প্রাণহীন নিথর দেহ। চোখের সামনে পরিবারের ছাদটিকে যেন উপড়ে যেতে দেখেন মা-মেয়ে। সে অবস্থাতেই কেউ বলে ওঠে যে আবারও গুলি চলার আগে নেমে আসতে হবে উপত্যকা থেকে। কোনও দিক না ভেবেই মেয়েকে নিয়ে নেমে আসেন সমীরের স্ত্রী শবরী। স্বামী যে ছেড়েই চলে গিয়েছেন তাঁদের, সে ধারণা তখনও ধোঁয়াশায়।
উৎসবের আবহে পাশে নেই কাছের মানুষ। সমীর গুহ যতদিন ছিলেন, পাড়ার পুজোয় গুরুভার একাই সামলাতেন অনেকখানি। মিশুকে মানুষ ছিলেন। তিনি যে উচ্চপদে কর্মরত ছিলেন তার আন্দাজটুকুও পাওয়া যেত না দেখে। ওঁর মতো মানুষ বর্তমান সময়ে সত্যিই বেমানান, সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে এমনটাই জানিয়েছেন প্রতিবেশীরা। সমীর কাশ্মীরে, সে কারণেই নাকি পুজোর মিটিং পিছিয়ে দেওয়া হয়েছিল এক সপ্তাহ। যাতে ফিরে সেখানে উপস্থিত থাকতে পারেন তিনি। ঝকঝকে যে মানুষটা পরিবার নিয়ে ভূস্বর্গ বেড়াতে গেল, ফেরার পথে যে কফিনবন্দি হয়ে ফিরতে হবে তাঁকে, সে কথা আর তখন কে বা জানে?
এরপর পেরিয়ে গিয়েছে বেশ কয়েক মাস। সময়ের নিয়মেই ক্যালেন্ডার পৌঁছে গিয়েছে উৎসবের দিনে। এখন থেকেই আনন্দে ভাসছে বাংলা-সহ শহর কলকাতা। কিন্তু এসবের মধ্যে কেমন আছেন স্বজনহারা শবরী গুহ? ২৬ জন পর্যটকের মৃত্যু যে অবশ্যম্ভাবী যুদ্ধ-পরিস্থিতি তৈরি করেছিল দুই প্রতিবেশী দেশের মাঝে, তা রুখতে একের পর এক ‘অপারেশন সিঁদুর’ ও ‘অপারেশন মহাদেব’ হয়ে গিয়েছে এর মধ্যেই। কিন্তু তাতে কি শবরী গুহর জীবনে কিছু বদলেছে সত্যি করে? খানিক নিঃস্পৃহ ভঙ্গিতে শবরী বলেন, “যে আঘাত আমরা পেয়েছি, এসবে তাতে বড়জোর প্রলেপ লেগেছে বলা চলে। এই ক্ষতি আদতে অপূরণীয়। কোনও কিছুর জন্যই জীবন থেমে থাকে না, তাই চলছে।”
পুজো (Durga Puja 2025) আসছে… এতদিনের দমবন্ধকর পরিস্থিতি বদলে যাক, চাইবেন না? “ঈশ্বরের কাছে আর কিছুই চাওয়ার নেই, সত্যি বলতে। বাড়ির মানুষটিকে ফেরত চেয়েছিলাম, পাইনি। এখন যদি চাইতেই হয়, কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে আগামীদিনের জন্য জঙ্গিমুক্ত ভারতবর্ষ চাইব। সেদিনের ক্ষতি তো কেবল আমার একার হয়নি। আরও অনেক পরিবার এর ভুক্তভোগী।” এমন উত্তরের সামনে স্তব্ধ হয়ে যেতে হয়। আরও বলেন শবরী, “চব্বিশ বছরের বিবাহিত জীবন। একসঙ্গে ঠাকুর দেখতে বেরতাম পুজোর সময়ে। যেখানেই যেত, আমাদের নিয়ে যেত। ও নেই, এ-কথা মানি না আজও!” পুজোর উচ্ছ্বাস কি কখনওই বদলে দিতে পারবে এমন প্রাণহীন গৃহস্থ বাড়ির মানচিত্র? প্রশ্ন তোলা রইল ভবিষ্যতের কাছে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.