করোনায় অস্পৃশ্যতাকে জয় করেছি। মানুষ বাঁচানোই আমাদের উৎসব। পুজো কাটানোর অভিজ্ঞতা নিয়ে কলম ধরলেন সরকারি হাসপাতালের নার্স সুমনা মজুমদার।
সিস্টার দিদি বড্ড খারাপ! সারাক্ষণ খিটখিট করেন! সরকারি হাসপাতালের স্বাস্থ্য পরিষেবায় বারবার এই শব্দগুলো শুনতে শুনতেই অভ্যস্ত হয়েছি আমরা। কিছু ভুল থাকেই, কিন্তু দুঃশ্চিন্তায় থাকা রোগীর আত্মীয়দের প্রশ্ন, কড়া ভাবমূর্তির আড়ালে আসলেই লুকিয়ে থাকে আমাদের কথা। যদিও ভালোও থাকে নিরন্তর। কাজের বাইরেও জোটে অচেনা-অজানাদের স্নেহ। ভালো-মন্দের উপাখ্যানে জড়িয়ে যায় আমাদের উৎসবের কথা। অনেকেই বলেন, তোমার ছুটি আমার নয়, আমরা বলি ছুটি নয়, মানুষ বাঁচানোতেই আনন্দ খুঁজি আমরা।
গলি-তস্যগলি অথবা রাজপথের আলোয় সুসজ্জিত পুজোকথায় জড়িয়ে থাকে আমাদের লড়াইও। আমিও মা, আমার ৪ বছরের সন্তানের অপেক্ষার সঙ্গে মিলিয়ে ফেলি ওদের কথা। প্রত্যেক মুহূর্তে দেখি হয়তো চিকিৎসকের লেখা ওষুধ, ইনজেকশনের অপেক্ষায় এমনই কোনও মা! হয়তো তাঁর সন্তানের বেঁচে থাকার আশা নিয়ে উৎসব কাটাচ্ছেন হাসপাতালেই। চিন্তায় রাত কাটছে পুজোর আলোর বাইরে!। তখন আর মনেহয় না, পুজোয় নাইট ডিউটি অথবা উৎসবে কাজ করেও অখুশি আমরা। মাতৃবন্দনার মন্ত্র, দুর্গাপুজোর অষ্টমীতেও যখন হাসপাতালে রোগীর পরিবারের হাহাকার শুনি, তখন নার্স তো বটেই একজন মা হিসাবেও মনে পড়ে সন্তানের কথা। হয়তো এখানেই লুকিয়ে আমাদের পেশার সার্থকতা। তথাকথিত ডেডিকেশন। পুজোয় যে আনন্দে মাতি না, এমন নয়, একদিন ছুটি পাই, খুশি মনে সেদিনই চেষ্টা করি পরিবারের সঙ্গে কাটাতে।
আমার ক্ষেত্রে একটু অন্যরকম পুজো কাটে। আমি পেশায় যেমন নার্স, আমার স্বামী চিকিৎসক। বাড়িতে বাবা নেই। তিনি ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে প্রয়াত হয়েছেন। মা একাকী। আমিও জানি, রোগীর কাছে, তাঁদের পরিবারের কাছে উৎসব বলে কিছু হয় না! তাই, নিজেও যখন কাজ করি, এভাবেই ভাবতে থাকি রোজ। আমি যে সরকারি হাসপাতালে কাজ করি সেখানকার ক্যানসার ইউনিটে কর্মরত এখন। রোজ দেখি, ছোট্ট বাচ্চা ক্যানসার আক্রান্ত। কারও বাবা নেই, কারও মা নেই। কেউ একেবারই অনাথ। কেমো চলছে। কান্না, হাহাকার, কষ্টের ছবি চোখে ভাসে প্রতিনিয়ত। ভাবি, একটু হলেও তো ভালো আছি! আমার সন্তান তো আছে আমার কাছে! ভাবুন তো, যে মা উৎসবের আবহেও নির্ঘুম সন্তান হারানোর বেদনায়! যে বাবা হয়তো পুজোর অষ্টমীতে সন্তান হারালেন! যে কন্যা তাঁর বাবার মুখাগ্নি করছেন বিজয়া দশমীর দিন! যে পুত্র তাঁর বাবার শবদেহ কাঁধে নিচ্ছেন বোধনের দিন, তাঁদের দুর্গাপুজো? একজন চিকিৎসাকর্মী হিসাবেও এমনটাই বুঝে নিয়েছি এখন।
তাই বলে কি খারাপ লাগে না? যখন ভিড় মেট্রোয় দেখি ঠাকুর দেখার ভিড়! যখন দেখি হাসপাতালের কাছেই বড় বড় পুজো প্যান্ডেলে মানুষের কোলাহল, মনখারাপ হয়, কিন্তু সেটাও উবে যায়, যখন দেখি আমার হাসপাতালের ওয়ার্ডে কোনও মায়ের কান্না! কিন্তু করোনাকালে দেখেছি উৎসব পেরিয়েও বাঁচার লড়াই কাকে বলে! মানুষের সেবা করেও শুনেছি কটূক্তি! মানুষ বাঁচিয়েও একঘরে হয়েছি। করোনা আক্রান্ত বলে অস্পৃশ্য হয়েছি বারবার। তবুও লড়াই চালিয়েছে, বেঁচেছি রোগীর জন্যই, কারণ ওঁরাই আমাদের সব। আর পুজোয় ওঁদের নিয়েই বেঁচে থাকাই তো নার্সদের জীবনের সম্পদ!
অনুলিখন: রমেন দাস
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.