বিশ্বজ্যোতি ভট্টাচার্য, শিলিগুড়ি: উত্তরবঙ্গ বিপর্যয়ের পরে কেটে গিয়েছে বেশ কয়েকটা দিন! বন্যার ধাক্কা সামলে ধীরে ধীরে ছন্দে ফিরছে সেখানকার মানুষ। বাংলার ‘হ্যালোউইন’ অর্থাৎ ভূত চতুর্দশীর পরদিন অন্য আলোর উৎসবে মেতে উঠবে রাজবংশী অধ্যুষিত উত্তরের গ্রামগুলি। যা আসলে কৃষিবন্দনা বা প্রকৃতি পুজো। সভ্যতার প্রাচীন রীতি। আঁধার রাতে ঘরদোর, শস্যখেত শুধু অলোকমালায় সাজিয়ে তোলাই নয়, এদিন গায়ের ছেলেরা মেতে উঠবে ‘চোর খেলায়’। বাড়ির কচিকাচারা কোথাও লন্ঠনের আদলে পাটকাঠির তৈরি খাঁচায় প্রদীপ রেখে ‘ন্যালটেং’ নামে এক আলো নিয়ে গ্রামে ঘুরে বেড়াবে। শুরু হয়েছে সেই প্রস্তুতি। আবার কোথাও নারকেলের মালায় হাতল লাগিয়ে মোম জ্বেলে টর্চ বানাতে দেখাতে যাবে। আগের দিন গরুকে খাওয়ানো হবে বাখর। কোথাও বসবে ‘চোর চুরনী’ পালাগানের আসর। মালদহ ও দুই দিনাজপুর জেলায় পূর্ব পুরুষের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা জানাতে আয়োজন হবে ‘হকাহকি’ অনুষ্ঠানের। আলো দেখিয়ে চলবে শান্তির আর্তি। উত্তরে এ এক অন্য উৎসব!
অমাবস্যার রাতে রাজবংশী অধ্যুষিত এলাকার চাষি পরিবারের গ্রামগুলিতে দেবতার থানের সামনে চারটি এবং ঘরের সামনে দু’টি কলাগাছ পুতে গোড়ার মাটি গোবর দিয়ে লেপে দেওয়া হবে। সন্ধ্যায় ‘অধিকারী’ নামে পরিচিত পূজারী পুজোর আয়োজন করবেন। রীতি মেনে এরপর চাষি বউ স্নান সেরে মাটির প্রদীপে আলো জ্বেলে দেবেন। সূচনা হবে ‘গছা দেওয়া’ অনুষ্ঠানের। বৃত্ত শেষ হবে ধানের খেতে কলাপাতার ডাটা কেটে তৈরি প্রদীপে সলতে জ্বালিয়ে। ঠিক কবে নাগাদ ওই অনুষ্ঠানের সূত্রপাত সেটা অবশ্য এখন জানার উপায় নেই। কিন্তু এখনও উত্তরের মানুষ একেবারে অন্য এই উৎসবে মেতে ওঠেন।
লোকসংস্কৃতি গবেষকদের একাংশের দাবি, কৃষি সভ্যতা বিকাশের হাত ধরে বিভিন্ন রীতি ও প্রথার মতো গছা দেওয়া অনুষ্ঠানের সূচনা হয়ে থাকতে পারে। রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য তথা লোকসংস্কৃতির গবেষক দীপকুমার রায় মনে করেন, গছা দেওয়া উৎসব আদতে কৃষি বন্দনা। কার্তিক মাসে ধানের খেতে পোকার উপদ্রব বেড়ে যায়। পোকা তাড়াতে আগুনের ব্যবহার অনেকদিনের। গছা দেওয়া সেটারই প্রতীক। বাখর খাইয়ে গবাদিপশুর মঙ্গল কামনার মধ্যেও রয়েছে কৃষি সভ্যতার রেশ। অবশ্য গ্রামের বাসিন্দাদের অনেকের দাবি, শুধু কৃষি বন্দনা নয়। গছা দেওয়া, ছেলেদের ন্যালটেং নিয়ে গ্রাম প্রদক্ষিণের মধ্যে অশুভ শক্তি জয়ে আর্তিও থাকে। লোকসংস্কৃতি গবেষক দিলীপ বর্মা জানান, গবাদি পশুকে বাখর খাওয়ানো, গছা দেওয়ার মতো অনুষ্ঠান পুরোপুরি কৃষি ভিত্তিক। অশুভ শক্তি জয়ের ভাবনা এরসঙ্গে অনেক পরে জুড়েছে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.