Advertisement
Advertisement
Kazi Nazrul Islam

ষষ্ঠীতেই হয়েছিল ইংরেজ বিসর্জনের পালা! ‘দেবী দুর্গা’র গানে স্বাধীনতার হুঙ্কার নজরুলের

ফিরে দেখা সেই আগুনে ইতিহাস।

Kazi Nazrul Islam wrote song for Devi Durga
Published by: Arpan Das
  • Posted:September 28, 2025 6:14 pm
  • Updated:September 28, 2025 6:14 pm   

অর্পণ দাস: ১৯৩৯ সালের অক্টোবর মাস। বাতাসে পুজো নয়, বারুদের গন্ধ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ প্রবল পরাক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়েছে ইউরোপের বুকে। আর বাংলা তথা ভারতের নাভিশ্বাস উঠেছে ইংরেজ সরকারের দানবিক ফাঁসে। স্বাধীনতা খুব বেশি দূরে নয়। শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে ছিনিয়ে আনতে হবে দেশের অধিকার। অন্যদিকে সভ্যতার মোহময়ী মুখোশ খুলে নৃশংস হয়ে উঠছে ইংরেজ। তার মধ্যেই দেবীর আবাহন। পরাধীনতার শিকল পরেও বরণ করে নিতে হবে মা দুর্গাকে। দেশবাসীর মনে যেন একটাই আকাঙ্ক্ষা—অসুরদলনী শক্তির আরাধনায় বধ করতে হবে অসুররূপী ইংরেজকে। ১৮ অক্টোবর (৯ কার্তিক ১৩৪৬), মহাষষ্ঠীর দিন মিনার্ভা মঞ্চে অভিনীত হল মহেন্দ্র গুপ্তের ‘দেবী দুর্গা’ নাটক। সঙ্গীতের ডালি সাজালেন কাজি নজরুল ইসলাম। না, শুধু দেবীবন্দনা নয়, এ যেন হয়ে উঠল নিষ্পেষিত জাতির রণহুঙ্কার।

Advertisement

‘দেবী দুর্গা’ নাটকের কাহিনিতে অভিনবত্ব কিছু নেই। আর পাঁচটা পৌরাণিক নাটকের মতোই। মেথস মুনির পরামর্শে ভক্ত সমাধি দশভুজা দুর্গার কাছে মুক্তিকামনা করলেন। অন্যদিকে রাজত্ব বিস্তারের আশীর্বাদ চাইলেন রাজা সুরথ। কিরাতকন্যার বেশে দেবীর আগমনে দুজনের মনস্কামনাই পূর্ণ হল। কোনও রূপক নেই, স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা নেই। নিছক অলৌকিক ঘটনা ও মঞ্চমায়ার আতিশয্য। সেই নাটকই অনন্য হয়ে উঠল নজরুলের লেখা গানে। যেন তিনি স্বয়ং মঞ্চে বসে ডেকে নিচ্ছেন মহিষাসুরমর্দিনীকে।

নজরুলের গানে-কবিতায় এর আগে শক্তিদায়িনী দেবীর বন্দনা এসেছে। ‘অগ্নিবীণা’ (১৯২২) কাব্যগ্রন্থের ‘আগমনী’ কবিতায় দেশের রণাঙ্গনে আহ্বান করেছিলেন ‘রণ-রঙ্গিণী জগতমাতা’কে। ‘আনন্দময়ীর আগমনে’-র পরে কারাবরণ করতে হয়েছিল। ১৯৩০-এ মন্মথ রায়ের ‘কারাগার’ নাটকের জন্য কয়েকটি গান লিখেছিলেন তিনি। সেখানেও কৃষ্ণের হাতে কংসের মৃত্যু সুনিশ্চিত হয় নজরুলের ‘মাভৈঃ’ ডাকে। ‘দেবী দুর্গা’ও পুরাণের কাহিনি থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গী হয়ে ওঠে নজরুলের সঙ্গীতের গুণে।

Kazi Nazrul Islam wrote song for Devi Durga

নাটকের শুরুতে মেধস মুনির আশ্রমে বেদ গানের পর আহ্বান জানানো হয় ঊষাকে। নজরুল তার বর্ণনা দিচ্ছেন,
“তিমির কারারুদ্ধা ধরণী ঊর্ধ্বে চাহে,
মুক্ত করি তারে আনো উদার আলোতে।।”

শুধু কি প্রকৃতি? ভারতভূমির আকাশও আজ অন্ধকার। ‘বিদ্রোহী কবি’ তাকে উদার আলোতে নিয়ে আসার স্বপ্ন দেখছেন। দুর্গাস্তবের মাধ্যমে দেশমুক্তির আরাধনা করেন নজরুল। দ্বিতীয় অঙ্কে রাজা সুষেণের লোকেরা সুরথকে খুঁজে না পেয়ে কিরাতপল্লিতে আক্রমণ করে। ঘর-বাড়ি পুড়িয়ে দেয়, শিশু-মহিলারাও রেহাই পায় না। সেই সময় কিরাতদের যুদ্ধঘোষণার গান,

“ভারত-শ্মশানে শবের মাঝে শিব জাগাও
তাথৈ তাথৈ নৃত্যে পাষাণের ঘুম ভাঙাও।”

এবার আর বরাভয়প্রদানকারী দেবী দুর্গা নয়, ডাক পড়েছে সাক্ষাৎ ‘চণ্ডিকা মহাকালী’-র। তিনিই পারবেন এই ভয়ানক অসুরদের হাত থেকে কিরাতপল্লি তথা ভারতভূমিকে রক্ষা করতে। ধ্বংসের ছন্দে জেগে উঠুক প্রলয়ঙ্করী করালী। রক্তরাগে লাল হয়ে উঠুক দশদিক। গলায় নাচুক নৃমুণ্ডমালা। দৈত্যের কারাগারে জ্বলুক আগুন। তবেই শান্তি, তবেই স্বাধীনতা।

Kazi Nazrul Islam wrote song for Devi Durga

চতুর্থ অঙ্কে বিশ্বাসঘাতক সুষেণ কিরাতদলের হাতে বন্দি হওয়ার পর ক্ষমা চায়। কিন্তু যে ঘৃণ্য অপরাধ সে বছরের পর বছর করে এসেছে, তার কোনও ক্ষমা নেই। তাই দেবীপূজার পুণ্যলগ্নে চরম দণ্ডের ব্যবস্থা করা হয় অত্যাচারী রাজার জন্য। এও যেন প্রতীকী। সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রাম তখন তুঙ্গে। গান্ধীজির পথ থেকে আলাদা হয়ে যাচ্ছেন সুভাষচন্দ্র বোস। এরপরই নজরুল অনাগত ভবিষ্যতের বার্তা দিয়ে বলবেন,

“এ দুর্দ্দিন রবে না তোর আসবে শুভদিন
নূতন আশায় বুক বাঁধ রে অন্ন বস্ত্র হীন।।”
Kazi Nazrul Islam wrote song for Devi Durga

 

যেন পুব আকাশে নতুন সূর্যের আলো দেখতে পাচ্ছেন। শুধু সাহস করে একবার বিপদের মাঝে ঝাঁপিয়ে পড়। যার সঙ্গে স্বয়ং দানবদলনী আছেন, তার আবার মৃত্যুভয় কীসের? সুখ-দুঃখ, ভালো-মন্দ সব তো তাঁর হাতের খেলা। তাঁর উপর ভরসা রেখেই হাতে অস্ত্র তুলে নে,
“তুই দেখবি সেদিন রইবি না আর এমন পরাধীন।।”

এর ৮ বছর পর ভারতবর্ষ স্বাধীনতা পায়। কিন্তু নজরুলের স্বপ্নের সঙ্গে মেলেনি সেই স্বাধীনতার রূপ। তবু গানে-কবিতায় মহাপ্রলয়ের তাথৈ নৃত্যের সুরে তিনি শান্ত-স্নিগ্ধ দেবীকে পরিয়েছিলেন রণাঙ্গনের সাজ। মহাষষ্ঠীর পুণ্যলগ্নে ইংরেজদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে পেশাদার মঞ্চে বোধন হয়েছিল ‘দেবী দুর্গা’-র। প্রতিটি বোধনের দিনে বঙ্গভূমে ফিরে ফিরে আসে সেই অনন্য বোধনের স্মৃতি। 

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ