সোনা সবসময় লাভের নিশ্চয়তা দেয় না। বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিবেশ, ডলার, জ্বালানি তেলের বাজার, এমনকি ভূরাজনৈতিক ঘটনাবলীর প্রভাবে সোনার দাম ওঠানামা করে । যেসব দেশে সোনা আমদানি নির্ভর, সেখানে টাকার দুর্বলতায় সোনার দাম বাড়ে। আবার, আন্তর্জাতিক মন্দা বা সুদের হার বৃদ্ধি পেলে চাহিদা কমে দামও নামতে পারে। সুতরাং, সোনায় লগ্নি একদমই ঝুঁকিমুক্ত নয়—বরং এটি এক ধরণের ভারসাম্যের খেলা, যেখানে সময় ও কৌশল দুটোই জরুরি। কলমে, দেবাশিস কর্মকার।
ধনতেরস মানেই ভারতীয় মননে শুভ লগ্নির সময়। এই দিনে সোনা কেনা শুধু ধর্মীয় বিশ্বাস নয়, এক অর্থনৈতিক অভ্যাসেরও প্রতিফলন। বিশেষ করে ভারতীয় সমাজে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে সোনা হয়ে উঠেছে নিরাপত্তা ও সম্পদের প্রতীক। সোনা এক এমন সম্পদ যা মুদ্রাস্ফীতি, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা কিংবা বাজারের ওঠানামার সময়েও তার দ্যুতি হারায় না। তাই ধনতেরসের আগে মানুষ যখন সোনার দোকানে ভিড় জমায়, তখন তা শুধু ঐতিহ্যের আবেগ নয়, বরং এক আর্থিক আত্মবিশ্বাসের প্রকাশও বটে।
সোনায় লগ্নীর মূল যুক্তি নিহিত তার সীমিত সরবরাহ ও স্থায়ী চাহিদায়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কগুলি পর্যন্ত তাদের রিজার্ভের এক অংশ সোনায় রাখে—এমন একটি উপাদান যা কোনও দেশের নীতি, মুদ্রা বা বাজারের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত নয়। ফলে সংকটকালে, যখন শেয়ার বা বন্ডের দাম তলানিতে নামে, সোনা তখন তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল থাকে। এই স্থায়িত্বই সোনাকে ‘safe haven asset’ হিসেবে পরিচিত করেছে। শেয়ার বাজারের বিনিয়োগকারীরা যখন আশঙ্কায় থাকে, তারা আশ্রয় নেয় সোনার।
তবে সোনা সবসময় লাভের নিশ্চয়তা দেয় না। বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিবেশ, ডলার, জ্বালানি তেলের বাজার, এমনকি ভূ-রাজনৈতিক ঘটনাবলীর প্রভাবে সোনার দাম ওঠানামা করে । যেসব দেশে সোনা আমদানি নির্ভর, সেখানে টাকার দুর্বলতায় সোনার দাম বাড়ে। আবার, আন্তর্জাতিক মন্দা বা সুদের হার বৃদ্ধি পেলে চাহিদা কমে দামও নামতে পারে। সুতরাং, সোনায় লগ্নী একদমই ঝুঁকিমুক্ত নয়—বরং এটি এক ধরণের ভারসাম্যের খেলা, যেখানে সময় ও কৌশল দুটোই জরুরি।
যদি এমন হয় যে অধিকাংশ মানুষ একসঙ্গে সোনা বিক্রি করে দেয়, তবে তখন বাজারে সরবরাহ বেড়ে যাবে। অর্থনীতির সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী, চাহিদা অপরিবর্তিত থাকলে সরবরাহ বৃদ্ধিতে দাম পড়ে যায়। কিন্তু সোনার ক্ষেত্রে এ প্রভাব সাধারণত অল্প সময়ের জন্য থাকে। কারণ বাস্তবে কখনোই সবাই একসঙ্গে সোনা বিক্রি করে এমন অবস্থা হয় না। সোনার বাজার বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত ও গভীর। এক দেশের বিক্রয়চাপ অন্য দেশের ক্রয়চাহিদা সামাল দিয়ে ফেলে। তাছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা প্রায়ই দাম নামলে কিনে নেয়, ফলে দীর্ঘমেয়াদে ভারসাম্য ফিরে আসে।
অন্যদিকে, সোনার আবেগজনিত মূল্যও তার দামে বড় ভূমিকা রাখে। এটি শুধু একটি ধাতু নয়—একটি আস্থা, একটি নিরাপদ সঞ্চয়ের প্রতীক। ভারতীয় সমাজে বিয়ের গয়না থেকে উৎসবের উপহার—সবেতেই সোনার উপস্থিতি। এই সংস্কৃতিক মূল্যবোধ তার চাহিদাকে চিরস্থায়ী করে রেখেছে। অর্থাৎ, সোনার বাজার কেবল অর্থনৈতিক নয়, আবেগেরও।
তবু বর্তমান সময়ে, আর্থিক পরামর্শদাতারা বলছেন, সোনায় লগ্নী যেন মোট বিনিয়োগের ১০-১৫ শতাংশের বেশি না হয়। কারণ সোনা আয় দেয় না—শেয়ার বা বন্ডের মতো লভ্যাংশ বা সুদ এখানে নেই। এটি কেবল মূলধন সংরক্ষণের উপায়। তাই যে বিনিয়োগকারী দীর্ঘমেয়াদে স্থির মুনাফা চান, তার জন্য সোনা একমাত্র ভরসা নয়, বরং এক সহায়ক সঙ্গী হতে পারে।
ধনতেরসের এই উৎসবের প্রাক্কালে সোনা কেনা এক দ্বিমুখী বার্তা বহন করে—একদিকে ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধা, অন্যদিকে অর্থনৈতিক সচেতনতার প্রকাশ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ডিজিটাল গোল্ড, গোল্ড ইটিএফ বা সার্বভৌম গোল্ড বন্ডের মতো বিকল্প এসেছে, যা সোনায় লগ্নীকে আরও নিরাপদ ও সহজ করেছে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.