Advertisement
Advertisement
Upendrakishore Ray Chowdhury's Bangladesh Home

বাংলাদেশে ধূলিসাৎ সত্যজিতের ভিটে, এখানেই প্রবাদপ্রতিম রায় পরিবারের ইতিহাসের শিকড়

ছাত্রাবস্থা থেকে ব্রাহ্মবাদে অনুরাগ, উপেন্দ্রকিশোরের বাংলাদেশের ভিটের ইতিহাস জানেন?

হাসিনা পরবর্তী অধ্যায়ে 'বদলের বাংলাদেশে বিপ্লবী ছাত্রদের' কর্মকাণ্ড দেখে একাধিকবার চক্ষু চড়কগাছ হয়েছে সভ্যসমাজের। শুধু তাই নয়, লাগাতার ভারতবিরোধী মনোভাবের পরিচয় দিয়েছে নতুন বাংলাদেশ। কখনও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পৈতৃক ভিটে কখনও বা পাবনার 'রমা' সুচিত্রা সেনের স্মৃতি বিজড়িত বাড়ির উপর কোপ পড়েছে ইউনুস সরকারের। এবার ইউনুস শাসনকালে আরও একবার সেই বিদ্বেষের প্রমাণ পাওয়া গেল।

সম্প্রতি বাংলাদেশের ময়মনসিংহে সত্যজিৎ রায়ের পৈতৃক ভিটে ভেঙে ফেলার কাজ শুরু করেছে বাংলাদেশ সরকার। যে বাড়ির প্রতিটি কোণায় রয়েছে তাঁর ঠাকুরদা উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর স্মৃতি। ইতিমধ্যেই পদ্মাপারের সংস্কৃতিমনস্ক মানুষেরা প্রতিবাদে গর্জে উঠেছেন। বিষয়টির তীব্র নিন্দা করে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও কেন্দ্রীয় সরকারের হস্তক্ষেপ দাবি করেছেন। রায় পরিবারের পারিবারিক ভিটে ভেঙে ফেলায় গর্জে উঠেছেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ও। এমন আবহে আবারও চর্চায় উপেন্দ্রকিশোরের বাংলাদেশের ভিটের অজানা ইতিহাস।

উপেন্দ্রকিশোরের স্মৃতিবিজড়িত যে ভিটে এখন ধ্বংস করার পথে ইউনুস সরকার, জানেন কি এই বাড়িতে পা রাখার আগে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম এই পথপ্রদর্শকের নাম ছিল কামদারঞ্জন। তবে হরিকিশোর তাঁকে দত্তক নেওয়ার পর নিজের নামের সঙ্গে মিলিয়ে ছেলের নাম রাখলেন উপেন্দ্রকিশোর রায়। মসুয়ার খ্যাতি, প্রতিপত্তিতে প্রতাপান্বিত এই রায় বংশের সঙ্গে জুড়ে গেলেন উপেন্দ্রকিশোর। সেই প্রেক্ষিতে দেখতে গেলে এই ভিটেই রায় পরিবারের উৎসস্থান। কীভাবে?

তাহলে একটু শুরু থেকে বলা যাক। ময়মনসিংহের মসুয়া গ্রাম। যা কিনা অবিভক্ত বাংলায় খুকুরপাড়়া বলেই পরিচিত ছিল। সেই অঞ্চলের দোর্দণ্ডপ্রতাপ ব্যক্তিত্ব রামনারায়ণ রায়। তারই তিন পুত্রের মেজ হরিকিশোর। বিপত্নীক হরিকিশোর দুবারের স্ত্রী বিয়োগের পর কামদারঞ্জনকে দত্তক নিয়ে মসুয়ার এই ভিটেতেই আনেন। যেখানে রীতিমতো জাঁকজমক করে ছেলের নামকরণ করেন উপেন্দ্রকিশোর রায়।

দত্তক নেওয়ার দু বছর পর হরিকিশোরের তৃতীয় স্ত্রী রাজলক্ষীদেবী দুই সন্তানের জন্ম দেন। এদিকে উপেন্দ্রকিশোর তখন বেড়ে উঠছেন ময়মনসিংহের ভিটেতে। জানা যায়, ময়মনসিংহ জেলা স্কুলের সমস্ত শিক্ষকদের কাছেই অতি প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছিলেন বালক উপেন্দ্রকিশোর। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র। তবে কিঞ্চিত অভিযোগও নাকি তাঁকে নিয়ে ছিল।

সর্বদা ক্লাসে প্রথম হওয়া ছাত্রের যে পাঠ্যবইয়ের প্রতি কোনও আকর্ষণই নেই। তবে পড়া ধরলে ঝরঝর করে সব বলে দিচ্ছে বিস্ময় বালক। আবার রং-তুলিতেও দারুণ মন তাঁর। পরবর্তীতে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়তে চলে আসেন উপেন্দ্রকিশোর। সেসময় আবার বাবা হরিকিশোর পড়লেন আরেক বিপত্তিতে! কী? জানা যায়, ময়মনসিংহ জেলা স্কুলে পড়াকালীনই তিনি নাকি ব্রাহ্মবাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। বাড়ি থেকে কড়া আদেশ, কোনওমতেই ব্রাহ্ম মনোভাবাপন্ন কারও সঙ্গে মেলামেশা করা যাবে না। কিন্তু তাঁকে টলানো যায় না। সেই প্রেক্ষিতে এই ভিটে উপেন্দ্রকিশোরের 'ব্রাহ্ম মুহূর্তে'রও সাক্ষী।

জানা যায়, কলকাতায় ছেলের ব্রাহ্মবাদ নিয়ে মাতামাতি দেখে হরিকিশোর নাকি দত্তকপুত্র উপেন্দ্রকিশোরকে বাংলাদেশ থেকে চিঠি লিখে বলেছিলেন- ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হলে সমস্ত সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করবেন। কিন্তু সেকথা শোনেননি তিনি। তাই ক্ষুব্ধ হয়ে সম্পত্তির মাত্র এক-চতুর্থাংশ উপেন্দ্রকিশোরের নামে উইল করেন তাঁর বাবা। পরবর্তীতে অবশ্য সেই উইল পরিবর্তন করে সকলকে সমান সম্পত্তি ভাগ করে দেন রাজলক্ষ্মীদেবী। সেসব কিছুরই সাক্ষী ময়মনসিংয়ের এই ভিটে। তবে সত্যজিৎ রায় একবার পৈতৃক ভিটের অবস্থা দেখে আক্ষেপ করেছিলেন।

কীরকম? ১৯৮৭ সালে সুকুমার রায়ের উপর ডকুমেন্টারি করছিলেন সত্যজিৎ রায়। তখন তাঁর বাংলাদেশ যাওয়ার ইচ্ছে ছিল। ওই পৈতৃক ভিটে ডকুমেন্টারিতে রাখার ইচ্ছা ছিল। মাণিকবাবু তাঁর এক সহকারীকে পাঠিয়েছিলেন। তিনি ছবি তুলে আনেন। তবে সত্যজিৎ রায় সেই ছবি দেখে খুবই মর্মাহত হয়েছিলেন। পৈতৃক বাড়ির অবস্থা খুবই খারাপ! ওই অংশটা পরবর্তীতে ডকুমেন্টারি থেকে বাদ পড়ে বলে জানান সন্দীপ রায়।

'প্রথম আলো'য় প্রকাশিত প্রতিবেদনে দাবি, শতাব্দী প্রাচীন একতলা বাড়িটি ১৯৮৯ সাল থেকে বাংলাদেশ শিশু অ্যাকাডেমি ব্যবহার করা শুরু করে। ২০০৭ সালের পর থেকে বাড়িটি অব্যবহৃত অবস্থায় ছিল। পরিত্যক্ত বাড়িটি ভেঙে বহুতল ভবন নির্মাণের পরিকল্পনায় কাজ শুরু করছে শিশু অ্যাকাডেমি। জানা যাচ্ছে, শিশু অ্যাকাডেমিই বাড়িটি ভেঙে বহুতল তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইতিমধ্যে বাড়িটির সামনের অংশের প্রায় পুরোটাই ভাঙা হয়ে গিয়েছে। যেহেতু এই বাড়ির সঙ্গে বিশিষ্ট বহু মানুষদের স্মৃতি জড়িয়ে তাই আপাতত বাংলাদেশের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের হস্তক্ষেপে ভাঙার কাজ বন্ধ হয়েছে।