সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: অর্ধসমাপ্ত নিমকাঠের মূর্তি। যাঁর নাক, গলা, কান, পা প্রায় কিছুই নেই। অথচ তিনি জগতের নাথ। মহাপ্রভু জগন্নাথ।
চৈতন্যদেবের হাত ধরেই বাঙালির জগন্নাথকে চেনা। যিনি প্রভুকে দেখবেন বলে নদিয়া থেকে ছুটে গিয়েছিলেন শ্রীক্ষেত্রে। মন্দিরের সামনে যেতেই জ্ঞান হারিয়ে ভূলুণ্ঠিত হন। সে এক অন্য কথা। কিন্তু যে মহাপ্রভুকে দেখতে তিনি ছুটেছিলেন সেই দেবের প্রতিষ্ঠার কাহিনি, ইতিহাস রহস্যে ঘেরা।
জগন্নাথ দেব প্রথমে পুরীর মন্দিরের কাছেই পূজিত হতেন নীলমাধব নামে! গোপনস্থানে পুজো করতেন বিশ্ববসু নামে এক শবর রাজা। এই শবর রাজাই আগের জন্মে জরা নামে এক ব্যাথ ছিলেন। যিনি কৃষ্ণকে ভুলবশত তাঁর তীরে বিদ্ধ করেছিলেন। যার ফলে পার্থসারথী প্রাণ ত্যাগ করেন। স্কন্দপুরাণে বর্ণিত, প্রিয় মাধবের গুরুতর আহতের কথা শুনে ঘটনাস্থলে আসেন ছুটে আসেন অর্জুন। তাঁর কোলেই প্রাণ ত্যাগ করেন কৃষ্ণ! দেহ দাহের সময় সব অঙ্গ ছাই হলেও হৃদয় কিছুতেই দাহ্য হচ্ছিল না। তাই একটি নিমকাঠে তা রেখে সুদর্শন চক্র চিহ্ন একে ভাসিয়ে দেওয়া হয় সমুদ্রে। পরে সেই কাঠ জল থেকে তুলে আনেন অবন্তীর রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন।
স্কন্দপুরাণ অনুসারে, অবন্তীর রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন নীলামাধব দেবতার স্বপ্ন দেখেন। বিষ্ণুর রূপ হিসেবে বিবেচিত এই অধরা দেবতার সন্ধানে নানা দিকে মন্ত্রী, পুরোহিত ও দূত প্রেরণ করেছিলেন। দেবতার সন্ধানে গিয়ে ইন্দ্রদ্যুম্নের অন্যতম মন্ত্রী বিদ্যাপতি (তাঁর বংশধররাই পুরীর মন্দিরের দৈতাপত্যি হিসাবে কাজ করছেন) শবর রাজার মেয়ে ললিতার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তারপর খুঁজে পান নীলাচলের বিগ্রহ।
জানা যায়, ললিতার সঙ্গে বিয়ের আগেই বিদ্যাপতি জানতে পেরেছিলেন ললিতার পিতা বিশ্ববসু গোপনস্থানে কোনও দেবতার পুজো করেন। বিবাহের পরে তিনি বিশ্ববসুর কাছে যাওয়ার জন্য আবেদন জানান। জামাতার আবেদন ফেলতে পারেননি বিশ্বপতি।
তবে শর্ত দেন, চোখ বেঁধে তাঁকে সেই স্থানে নিয়ে যাওয়া হবে। রাস্তা দেখতে পারবেন না। রাজি হন বিদ্যাপতি।
কিন্তু তাঁকে তো দেবতার পথ খুঁজে বার করতেই হবে। বুদ্ধি করে হাতে সরষে নিয়ে নেন। তা রাস্তার ধারে ছড়াতে ছড়াতে মন্দিরে যান। নীলাচলকে দর্শন করে ফিরে আসেন। বর্ষার পর সেই সরষের বীজ থেকে গাছ হয়। হলুদ ফুল পথ সংকেত হিসাবে কাজ করে। দেবতার পথ খুঁজে পেয়েই রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নকে খবর দেন বিদ্যাপতি। রাজা সৈনিক নিয়ে হাজির হন, কিন্তু দেবতার দর্শন পাননি। হতাশ ইন্দ্রদ্যুম্ন সেখানেই বসে পড়েন। পণ করেন দেবতাকে না নিয়ে যাবেন না তিনি। পরে রাজা স্বপ্নাদেশ পান পুরীর সৈকতে নিমকাঠ ভাসছে। তা তুলে নিয়ে মূর্তি নির্মাণ করতে হবে।
ইন্দ্রদ্যুম্ন লোক, লস্কর নিয়ে ছুটে আসেন সৈকতের ধারে। নির্দেশ দেন নিমকাঠ তুলে নিয়ে আসার। কিন্তু সফল হননি। কিছুতেই কাঠটিকে স্থলে আনা যাচ্ছে না। ফের স্বপ্ন দেখেন দেবতা তাঁকে নির্দেশ দিচ্ছেন শবরদের সাহায্যে কাঠটিকে স্থলে তুলতে হবে। বিশ্ববসুকে অনুরোধ করলে তিনি রাজি হন। নিমকাঠটি তুলে আনা হয় বালুতঠে। এখানেই ‘বাহ্মণ্য’ ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। শবরদের হাত ছাড়া মহাপ্রভু ডাঙায় উঠলেন না। এমনকী এখনও নবকলেবর উৎসবের পুজো করেন শবররাই। রথযাত্রার সময়ও তাঁদের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে।
যাই হোক কাঠ স্থলভাগে আনা গেল, এবার মূর্তি গড়ার পালা। সাধারণ শিল্পীরা কাঠ কাটতেই পারল না। অবশেষে ব্রহ্মার আদেশে বিশ্বকর্মা ছদ্মবেশে শর্ত দিলেন তিন সপ্তাহ ধরে রুদ্ধদ্বার কক্ষের ভিতর মূর্তি গড়ে যাবেন তিনি। কেউ উঁকি পর্যন্ত দিলে সেই অবস্থায় শিল্পী চলে যাবেন। সম্মত হলেন রাজা। দরজা বন্ধ করে মূর্তি গড়া শুরু হল। দিন যায় রাত কাটে সামান্য শব্দটুকুও আসে না বন্ধ ঘরের ভিতর থেকে। কৌতূহল বাড়ে রাজার। একদিন দরজা খুলে দেন। তাতেই মাথায় হাত পড়ল তাঁর। ঘর শূন্য, মূর্তি অসমাপ্ত। কেঁদে পড়লেন রাজা, আবারও স্বপ্নাদেশ, ঐ মূর্তিতেই ভগবান ভক্তদের সব বাসনা কামনা পূরণ করবেন। তারপরই থেকে সেই অর্ধসমাপ্ত মূর্তিতেই নীলাচন হয়ে উঠলেন জগন্নাথ।
জগন্নাথের প্রতিষ্ঠা পাওয়ার কাহিনী, ইতিহাস যাই বলুন না কেন, তার পরতে পরতে সংকেত দেওয়া হয়েছে পিছিয়ে পড়া অংশদের দেবতা তিনি। শবরদের হাতে প্রথমে পূজিত তিনি। নিম কাঠ তুলে আনার পিছনেও শবরদের হাত। এখন যে চারিদিকে ‘বাহ্মণ্যে’র ধ্বজা উড়ছে তা কিন্তু আসলে নয়। প্রমাণ দেয় বিভিন্ন পুরাণ। তিনি সকলের থান। তিনি জগন্নাথ।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.