Advertisement
Advertisement
Kali Puja 2025

‘জঠরের জ্বালা আর সহে না তারা’, কালীসাধক রামপ্রসাদের সমাজ-সাধনা

রামপ্রসাদ সেনের রচনাকে বলা যেতে পারে কালীভক্তি আন্দোলনের সূচক।

Kali Puja 2025: The social message of Ramprasad Sen
Published by: Prasenjit Dutta
  • Posted:October 12, 2025 3:26 pm
  • Updated:October 12, 2025 3:26 pm   

প্রসেনজিৎ দত্ত: তখনও বেঁচে ছিলেন রামপ্রসাদ সেন (১৭১৮-১৭৭৫)। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের ভয়াবহ পরিণতি এড়িয়ে যেতে পারেননি বাংলার মরমী এই সাধক। তেমনটাই স্বাভাবিক। তৎকালীন আর্থিক দুরবস্থা ও গ্রামীণ সংস্কৃতির অবক্ষয়ের প্রেক্ষাপটে রামপ্রসাদ সেনের রচনাকে বলা যেতে পারে কালীভক্তি আন্দোলনের সূচক। তত্ত্বকথার আড়ালে কালই কালীর অন্যরূপ। কেবলই মন্বন্তর নয়, ১৭৩৯-এর মহাপ্লাবন, ১৭৪২ ও ১৭৫২-এর বর্গিহানা, ১৭৫৭-এর পলাশির যুদ্ধ – এসবেরও ভয়াবহ প্রভাব পড়েছিল বাংলার কৃষি ও সাধারণ মানুষের ওপর। বলাই বাহুল্য, সেই সময় আমআদমির মনের খুব কাছের হয়ে উঠেছিল রামপ্রসাদের গান। ১৮২৯ সালে রামমোহন রায় সতীদাহ প্রথা বিলোপে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তার অনেক আগেই সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে রামপ্রসাদ বলেছিলেন, ‘‘নহে শাস্ত্রসমত্বা সমত্বা সহমৃতা।’’

Advertisement

বাংলার অর্থনীতি তখন মুমূর্ষু। আর মুমূর্ষু রোগী উপযুক্ত চিকিৎসা না পেলে তার মৃত্যু ঘটা স্বাভাবিক। ঘটেছিলও তাই। দিনের পর দিন, দশকের পর দশক মুমূর্ষু বাংলার শরীর উপযুক্ত চিকিৎসা না পেয়ে ছিয়াত্তরের মন্বন্তরে প্রাণ হারাল। ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে রবার্ট ক্লাইভ এ দেশে আবার ফিরে আসেন। ইংরেজ সরকারের গভর্নর নিযুক্ত হন তিনি। তারপরেই দিল্লির বাদশা শাহ আলমের কাছ থেকে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার দেওয়ানি লাভ করেন। সেই দিনটি ছিল ১৭৬৫-র ১ আগস্ট। এর পরবর্তীতে পূর্ব ভারতের এইসব অঞ্চলে যে শাসনব্যবস্থা চালু হয়েছিল, তা ‘দ্বৈত শাসন’ নামে পরিচিত। অর্থাৎ নবাবের হাতে থাকবে প্রশাসনিক দায়িত্ব আর রাজস্ব আদায় ও ব্যয়ের পূর্ণ কর্তৃত্ব পাবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। এর জেরে বাংলার নবাব আসলেই ক্ষমতাহীন হয়ে পড়েন। এই সুযোগে কোম্পানির লোকেরা খাজনা আদায়ের নামে অবাধ লুণ্ঠন ও অত্যাচার শুরু করে দেয়। ১৭৭০ (বাংলা ১১৭৬)-এ অনাবৃষ্টি হয়। দেখা দেয় চরম বিপর্যয় ও দুর্ভিক্ষ। প্রায় ৩ লক্ষ মানুষ না খতে পেয়ে মারা যান।

রামপ্রসাদ তাঁর জীবদ্দশায় বর্গির অত্যাচার দেখেছেন। দেখেছেন মারাঠা দস্যুদের নারী নির্যাতন, শস্যভরা গোলাঘর লুণ্ঠন। পলাশির যুদ্ধে সিরাজদৌলার ভাগ্যবিপর্যয় থেকে হেস্টিংসের শাসন, সবকিছুই রামপ্রসাদের সময়কালে ঘটেছিল। এরই মধ্যে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর এবং তার আগে বাংলাদেশের শাসনতান্ত্রিক অরাজকতা ও স্বেচ্ছাচার এই সাধক কবিকে বিমুখ করতে পারেনি। দেশজনীন অন্নহীনতায় যখন দেশ কাতর, যখন ‘everybody and everything was on sale’, রামপ্রসাদ লিখলেন-

‘‘অন্ন দে গো অন্ন গো, অন্ন দে
জানি মায়ে দেয় ক্ষুধার অন্ন অপরাধ করিলে পদে পদে।
মোক্ষপ্রসাদ দেও অম্বে, এ সুখে অবিলম্বে
জঠরের জ্বালা আর সহে না তারা
কাতর হইও না প্রসাদে।’’

আর একটি পদে পাওয়া যায়, ‘‘অন্নপূর্ণা মা থাকিতে মোর ভাগ্যেতে একাদশী।’’ এ কথা তো কেবল তাঁর ব্যক্তিগত উচ্চারণ নয়। এ কথা খণ্ডিতের মধ্যে সমগ্র আবার সমগ্রের মধ্যে খণ্ডিত। পরবর্তীকালে এমনই এক কথা আরও এক দেশনায়কের কাছেও শোনা গিয়েছিল। খাদ্যখামারে যখন দুর্ভিক্ষের কীট হুল ফুটিয়েছিল, সেই বিষের জ্বালা সহ্য করা স্বামী বিবেকানন্দ ১৯ মার্চ ১৮৯৪-এ একখানি চিঠি লিখেছিলেন রামকৃষ্ণানন্দকে, ‘‘দরিদ্র আর অজ্ঞতা দেখে আমার ঘুম হয় না – একটা বুদ্ধি ঠাওরালুম Cape Comorin (কুমারিকা অন্তরীপে) মা কুমারীর মন্দিরে বসে, ভারতবর্ষের শেষ পাথরটুকরোর উপর বসে, এই আমরা এতজন সন্ন্যাসী আছি, ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছি, লোককে metaphysics (দর্শন) শিক্ষা দিচ্ছি, এসব পাগলামি। খালি পেটে ধর্ম হয় না – গুরুদেব বলতেন না, ঐ যে গরীবগুলো পশুর মতো জীবনযাপন করছে, তার কারণ মূর্খতা – পাজি বেটারা চার যুগ ওদের রক্ত চুষে খেয়েছে, আর দু-পা দিয়ে দলেছে।’’

সময় পালটালেও গরিব মানুষের উপর অত্যাচার বা নির্যাতন পালটায় না। রামপ্রসাদের কথায়, ‘‘কেউ যায় মা পাল্কী চড়ে, কেউ তারে কাঁধে করে।/ কেউ তারে দেয় শাল-দোশালা কেউ পায় না ছেঁড়া ট্যানা।’’ এইসব কথা রামপ্রসাদ প্রতিষ্ঠা করেছেন সত্য প্রতিষ্ঠার উদ্দেশে। এগুলি অসূয়াজাত নয়, কোনও অভিযোগও নয়। ভক্তের কোনও জাত নেই। ছোঁয়া-ছুঁয়ির ভয়ে নিজেকে বাঁচিয়ে চললে কি আর প্রকৃত ভক্তিতে মন দেওয়া যায়? কালী আসলে ‘সমন্বয়ের অবতার, সমঝোতার, সহানুভূতির অবতার’। এই সার কথাই মানুষ ভুলে যায়। রামপ্রসাদের সময় বলে নয়, যুগ যুগ ধরে ‘‘যার মা জগদীশ্বরী তার ছেলে মরে পেটের ভুগে’’। তখনও তাই। এখনও তাই। সভ্যতা এগোলেও প্রেক্ষিত বদলায় না। অরুণ কুমার বসু রামপ্রসাদকে নিয়ে লিখতে গিয়ে বলছেন, ‘‘…‘তুমি ভালো করেছ মা আমারে বিষয় দিলে না’ পদটিতে বিষয়বঞ্চিত সর্বহারা দিনমজুরের রূপকে কবি মাতৃসাধনার ইঙ্গিত দিয়েছেন।’’ রামপ্রসাদের অসংখ্য পদের মধ্যে দীনতার কথা ফুটে ওঠে। যেমন –

ক) থাকি একখান ভাঙা ঘরে
তাই ভয় পেয়ে মা ডাকি তোরে।।

খ) মায়ের এম্নি বিচার বটে।
যে জন দিবানিশি দুর্গা বলে তারি কপালে বিপদ ঘটে।।

গ) মাটির দেওয়াল বাঁশের খুঁটি
তায় পারি না খড় জোটাতে।।

বাবা রামরাম সেনের মৃত্যু হলে দারিদ্র্যের বশবর্তী হয়ে রামপ্রসাদ কলকাতায় এসে দুর্গাচরণ মিত্র নামে এক ধনীর কাছারিতে মাসিক তিরিশ টাকা বেতনে কেরানির কাজ শুরু করেন। কথিত আছে, কাছারির হিসাবের খাতায় শ্যামাসংগীত লিখতে শুরু করলে অন্যান্য কর্মচারী তাঁদের মালিকের কাছে রামপ্রসাদের বিরুদ্ধে নালিশ জানান। কিন্তু দুর্গাচরণ মিত্র গানগুলি পড়ে রামপ্রসাদের কবিত্বশক্তিতে মুগ্ধ হয়ে যান। তিনি কবিকে কেরানির কাজ থেকে অব্যাহতি দিয়ে স্বগ্রামে পাঠিয়ে দেন এবং তাঁর মাসিক ভাতার ব্যবস্থা করেন। তিনি নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সভাকবিও ছিলেন। ‘কবিরঞ্জন’ উপাধিও পেয়েছিলেন কৃষ্ণচন্দ্রের কাছ থেকে। তবে ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা প্রচলনের ফলে জমিদারি ব্যবস্থার টালমাটাল অবস্থা দেখা যায়। কৃষ্ণচন্দ্র রায় (১৭১০-১৭৮২) নানা মামলা-মোকদ্দমায় সর্বস্বান্ত হয়ে যান। এই কথাও লিখে রেখেছেন রামপ্রসাদ –

‘‘প্যাদার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র, তার নামেতে নিলাম জারি।
ঐ যে পান বেচে খায় কৃষ্ণপান্তি – তারে দিলি জমদারি।।’’

রামপ্রসাদ তাই অভিমান করেন। একদিকে কোম্পানির শাসনের যুগ। অন্যদিকে প্রিয় রাজার বিপর্যয়, জমিদারি পেলেন পান-ব্যবসায়ী কৃষ্ণপান্তি। বিষয়ের বিষ তাঁকে দগ্ধ করেছে। কালীকেই দুষেছেন তিনি –

‘‘হুজুরে দরখাস্ত দিতে, কোথায় পাব টাকাকড়ি।
আমায় ফকির বানায়ে, বসে আছে রাজকুমারী।।
হুজুরে উকীল যে জনা, ডিসমিস তাঁর আশায় ভাবি।
করে আসল সন্ধি সওয়ালবন্দী— যে রূপেতে আমি থরি।।
পালাইতে স্থান নাই মা, বল কিবা উপায় করি।
ছিল স্থানের মধ্যে অভয় চরণ, তাও নিয়াছেন ত্রিপুরারি।।’’

আসলে ইতিহাস এমনই। স্মরণ করব ঐতিহাসিক অমলেশ ত্রিপাঠির সেই কথা। ধনতন্ত্র ও ঔপনিবেশিকতাবাদের চরম উৎকর্ষের দিনে মার্কস বলেছিলেন, কাঞ্চনকে কেন্দ্র করে মানবসমাজ ঘুরছে। ফ্রয়েড বলেছিলেন, কাঞ্চন নয়, কাম। রামকৃষ্ণ জবাব দিলেন – কাঞ্চন বা কাম নয়, ঈশ্বরকে কেন্দ্র করেই মানব সভ্যতার উত্তরণ। বিজ্ঞানের ভাষায় Geo-centric (পৃথিবী-কেন্দ্রিক)। এরপর Helio-centric (সূর্য-কেন্দ্রিক), সাহিত্য শিল্পের ভাষায় Homo-centric (মানব-কেন্দ্রিক) এবং মরমিয়ার ভাষায় Dio-centric (ঈশ্বর-কেন্দ্রিক)। এক একটি অভিধায় সভ্যতাকে বিশ্লেষণ করেছেন সমাজবিজ্ঞানীরা। অথচ সেই সভ্যতায় সুখী থেকেছেন কেবল একশ্রেণির মানুষই। অতি মন্থনে তাই বিষই ওঠে। অমৃত পাওয়া আর হয় না। আমাদের এই দেশে অর্ধেকের বেশি মানুষ আধপেটা খেতে পায়। সমীক্ষাও তাই বলছে। রামপ্রসাদের গান তাঁর সমসময়ের গণ্ডিকে অতিক্রম করেছে। অন্নচিন্তা চমৎকারা, ঘরে ভাত নাই তাই জীয়ন্তে মরা। এরপর কথা নেই।

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ