সোমনাথ রায়, নয়াদিল্লি: কখনও উত্তরাখণ্ডের সিল্কিয়ারায় নির্মীয়মাণ টানেলে ধস। ভূমিকম্প। কখনও মেঘভাঙা বৃষ্টিতে কেদারনাথের বিপর্যস্ত হয়ে যাওয়া। কখনও আবার বন্যায় ভেসে যাওয়া বাংলা, বিহারের। পাহাড় থেকে সমতল। প্রকৃতির তাণ্ডবে হামেশাই দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে গোটা জীবজগৎকে। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রকৃতির এই রোষের জন্য দায়ি মানবজাতিই। উন্নয়ন ও বিকাশের নামে পাহাড় কেটে সুড়ঙ্গ করা, যত্রতত্র গাছ কেটে ফেলা, রেললাইন ও সড়ক নির্মাণ করতে গিয়ে সবুজ ধ্বংস ও পাহাড়ের প্রকৃতি বদল – এসবই দায়ী নিত্য দুর্ভোগের পিছনে। প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্টের জন্যই এভাবে প্রকৃতির খামখেয়ালিপনার মুখোমুখি হতে হচ্ছে, দেশবাসীকে এই বার্তা দিতে এক অভিনব উদ্যোগ নিয়েছেন হুগলির শিয়াখালার মাস্টারমশাই কৌশিক বন্দ্যোপাধ্যায়। দেশবাসীর কাছে ‘প্রকৃতিকে ভালবাসো, জীবনকে আরও সুন্দর করে তোলো’-এই বার্তা দিতে ভবানীপুরের মিত্র ইনস্টিটিউশনের প্রাথমিক বিভাগের শিক্ষক বেরিয়ে পড়েছেন গঙ্গোত্রী থেকে গঙ্গাসাগর অভিযানে। গোটা যাত্রাপথে তাঁর সঙ্গী দীর্ঘদিনের সুখ-দুঃখের সাথী – বাইসাইকেল।
স্কুল শিক্ষিকা তথা স্ত্রী শুভশ্রীর সঙ্গে বাক্সপ্যাঁটরা নিয়ে শিয়াখালার পূর্বপাড়ার বাঁড়ুজ্যের বাড়ির ‘খ্যাপা’ ছেলে রওনা দিয়ে দিয়েছেন ৩ অক্টোবর। শুক্রবার উপাসনা এক্সপ্রেসে রওনা দেওয়ার সময় হাওড়া স্টেশনে আসেন বেশ কয়েকজন বন্ধু, শুভানুধ্যায়ী। কারও সঙ্গে বিস্কুট, কেউ এনেছিলেন শুকনো খাবার। কেউ ব্যাগে গুঁজে দিয়েছিলেন জরুরি ওষুধ, কেউ দিয়েছিলেন পথের জন্য জল, গ্লুকোজ। প্রত্যেকের সঙ্গে ‘কমন’ যা ছিল, তা হল শুভেচ্ছা, ভালবাসা, আশীর্বাদ। উত্তরকাশী হয়ে রবিবারই কৌশিক-শুভশ্রী পৌঁছে গিয়েছেন গঙ্গোত্রী। কখনও ট্রেনের লাগেজ বগি, কখনও বাস ও শেয়ার ট্যাক্সির ছাদ থেকে নামিয়ে খুলে ফেলা হয়েছে সাইকেলের কভার। আপাতত তা হোটেলে রেখে সোমবার ভোরে বাঁড়ুজ্যে দম্পতি ট্রেকিং করে রওনা দিলেন গোমুখের দিকে। সেখানে গঙ্গার উৎসস্থল ঘুরে ফিরে আসবেন গঙ্গোত্রী। তারপর শুরু হবে অভিযান।
গঙ্গার উচ্চগতি অর্থাৎ হরিদ্বার পর্যন্ত কৌশিকের সঙ্গে থাকবেন শুভশ্রী। দিনের শুরুতে তিনি গাড়ি করে রওনা দেবেন আগে থেকে নির্ধারিত দিনের শেষ পয়েন্টের দিকে। সেখানে গিয়ে শুভশ্রীর কাজ রাত্রিবাসের জায়গা ঠিক করা। পরদিন সকালে আবার শুরু। হরিদ্বার এসে ট্রেনে চেপে কলকাতা ফিরবেন শুভশ্রী। কৌশিক এগিয়ে যাবেন গঙ্গাসাগরের দিকে। কৌশিকের সঙ্গে শুভশ্রীও প্রতি বছরই যান ট্রেক করতে।
এবার ‘সতীন’ সাইকেলের সঙ্গে স্বামীকে ছেড়ে মাঝপথে বাড়ি ফিরতে হওয়ায় কিছুটা মন খারাপ শুভশ্রীর। বললেন, “হিংসা তো হচ্ছেই। তবে আমি থাকলে ওর লক্ষ্যে পৌঁছতে কিছু ব্যাঘাত ঘটতে পারত। আমার লক্ষ্য যাতে ওর অভিযান সফল হয়। হরিদ্বার থেকে কিছু গরম জামাকাপড় নিয়ে আমি বাড়ি চলে যাব। ওর লাগেজও কমে যাবে।” শিয়াখালার বাড়ি থেকে কৌশিকের অশীতিপর মা ছবি বন্দ্যোপাধ্যায় বলছিলেন, “কী বলব ভাই, আমার ছেলেটা এমনই খ্যাপা! বুড়ো মায়ের কথাও চিন্তা করে না। খবরে এত কিছু দেখি চিন্তা হয় না বলো? খালি বলবে, দেখো আমার বন্ধুরা কত নেশা করে, আমি তো করি না।ওটাই আমার নেশা। আবার বলবে, তুমি যে সুস্থ থাকতে ওষুধ খাও, পাহাড়ই আমার ওষুধ।”
অভিযানের প্রাথমিক যে পরিকল্পনা নিয়েছেন কৌশিক, তাতে গঙ্গাসাগর পৌঁছতে পৌঁছতে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ। এরপর বাড়ি ফিরে কিছুদিন বিশ্রাম। স্কুলে যোগ দিতে হয়ে যেতে পারে নভেম্বরের মাঝামাঝি। এখন সবে অক্টোবরের শুরু। এতদিন ছুটি পেলেন কী করে? কৌশিক জানালেন, “প্রতিবার ট্রেক করতে যাই পুজোর ছুটিতে। কোনও সমস্যা হয় না। এবার যেহেতু এতদিনের ব্যাপার, তাই আগে থেকে পরিচালন সমিতিকে লিখিত আবেদন করেছিলাম। ওঁরা ছুটি তো দিয়েইছেন, শুভেচ্ছাও জানিয়েছেন।” শুভেচ্ছাবার্তা পাঠিয়েছেন কলকাতা হাই কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি চিত্ততোষ মুখোপাধ্যায়, ইন্ডিয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ফেডারেশনের দেবরাজ দত্ত, এভারেস্ট জয়ী মলয় মুখোপাধ্যায়রাও।
সাইকেল নিয়ে অভিযান অবশ্য এই প্রথম নয় কৌশিকের। আগে শিয়াখালা-শুশুনিয়া, সান্দাকফু-গঙ্গাসাগর অভিযানের পাশাপাশি শিয়াখালার বাড়ি থেকে মোহনবাগান মাঠ হয়ে সাইকেল নিয়ে জামশেদপুর গিয়ে আইএসএল ম্যাচও দেখে এসেছেন। এবারের অভিযানটা অবশ্য একেবারে অন্যভাবে মাথায় আসে প্রকৃতিপ্রেমী স্কুলশিক্ষকের। গত বছরের মাঝামাঝি দেখেন সুরকার শান্তনু মৈত্রের তথ্যচিত্র ‘সঙ্গস অব দ্য রিভার-গঙ্গা’। সেই থেকেই মাথায় আসে গঙ্গার পার ঘুরে ঘুরেই দেবেন প্রকৃতিকে বাঁচানোর বার্তা। সেইমতো বেরিয়ে পড়া। দেখার শুধু কৌশিকের অভিযানের পাশাপাশি তাঁর উদ্দেশ্য কতটা সফল হয়।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.