‘পায়ে পড়ি বাঘমামা/কোরোনাকো রাগ মামা’। বাঘের ঘরে আচমকা ঢুকে পড়ার পর গুপী-বাঘা তো গান গেয়ে ‘বাঘমামা’কে শান্ত করতে পেরেছিলেন। আজ অবশ্য তেমন হওয়ার জো নেই। মানুষ আর বাঘের জন্য ভাবছেন না। উলটে নিজেদের চাহিদা পূরণের জন্য বাঘের ঘর কেড়ে নিতেও পিছপা হচ্ছেন না তাঁরা। এদেশের জাতীয় পশু বাঘ আজ সত্যিই বিপন্ন। ২৯ জুলাই, আন্তর্জাতিক বাঘ দিবসে ব্যাঘ্র সংরক্ষণ, প্রতিকূলতা, পদক্ষেপ, সরকারের ভূমিকা – সব নিয়ে ‘সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল‘কে নিজের মতামত জানালেন ব্যাঘ্র বিশেষজ্ঞ জয়দীপ কুণ্ডু। শুনলেন সুচেতা সেনগুপ্ত।
‘জাতীয় পশু বাঘ এখন বিপন্ন’
আগে ভারতের জাতীয় পশু ছিল সিংহ। কিন্তু তাকে পালটে জাতীয় পশু করা হয় বাঘকে। কারণ, বাঘ আমাদের ইতিহাস, সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সেকথা মাথায় রেখেই এই সিদ্ধান্ত। যাতে পুরো নজর বাঘের দিকে দেওয়া যায়, বাঘ সংরক্ষণের কাজ আরও ভালোভাবে করা যায়। তারপর থেকে ভারতজুড়ে শুরু হয় বাঘ সংরক্ষণ। তা একটা স্তর পর্যন্ত পৌঁছয়। সরকারি, বেসরকারি স্তরে এখনও নানা কাজ হচ্ছে। কিন্তু এখন জঙ্গল কমছে। বিপন্নতা বাড়ছে বাঘেদের।
জঙ্গল কেটে নির্মাণযজ্ঞ চলছে, নিজেদের চারণভূমি কমে যাওয়ায় কতটা মানিয়ে নিতে হচ্ছে পশুরাজকে? এ প্রশ্নের উত্তর সহজেই অনুমান করা যাবে ছোট উদাহরণ দিয়ে। ধরা যাক, একটা ফ্ল্যাটের চারটি ঘরে চারজন থাকেন। সেখানে আচমকা দুটি ঘর দখল হয়ে গেল। বাকি দুটি ঘরে মানিয়েগুছিয়ে চারজনকে থাকতে হচ্ছে। জায়গা ছোট হওয়ায় নানা অসুবিধা তৈরি হচ্ছে। এতদিনের অভ্যাস একটি ঘরে একা থাকা। কিন্তু এখন সেই ঘরে অন্য একজনকে জায়গা দিতে হচ্ছে। ফলে কিছু কিছু সংঘাত তো তৈরি হবেই। তেমনই জঙ্গল কাটার ফলে বাঘের ক্ষেত্রে একজনের এলাকায় অন্যরা ঢুকে গেলে সমস্যা হবেই। নিজেদের মধ্যে সংঘাত তৈরি হবে।
এখন জঙ্গলের ভিতর দিয়ে রেললাইন পাতা, ইমারত, কারখানা তৈরি হচ্ছে। সবই তো মানুষের প্রয়োজন বা চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে। এর ফলে যে শুধু বাঘের বাসস্থান কমছে, তা নয়। জঙ্গলে থাকা অন্যান্য প্রাণীরও থাকার জায়গাও সংকুচিত হচ্ছে, বিপন্ন হয়ে পড়ছে তারা। আসলে আমাদের লোভ, প্রয়োজনের অতিরিক্ত প্রয়োজনের কারণে এমন পরিস্থিতি। এই লোভের কারণে কারণে জঙ্গল হার মানছে। ধরুন, কোথাও কারখানা তৈরি হবে। কোনও জনবসতি সরিয়ে কারখানা গড়া অপেক্ষা জঙ্গলের অংশ কেটে তা তৈরি করা অনেক সহজ। আসলে জঙ্গল ও জঙ্গলের বাসিন্দাদের বা বাঘেদের তো ভোটাধিকার নেই। তাই সংরক্ষণ তালিকায় তাদের কোনও অগ্রাধিকারও নেই। ভোটাধিকার আর অগ্রাধিকার, দুইই খুব গুরুত্বপূর্ণ।
‘বাংলার বাঘ, বাঘের বাংলা’
পশ্চিমবঙ্গে বাঘেদের জন্য মূলত দুটি বনাঞ্চল রয়েছে – দক্ষিণবঙ্গে সুন্দরবন এবং উত্তরবঙ্গে বক্সা ব্যঘ্র প্রকল্প। এর বাইরে কোনও জঙ্গলে কোনও বাঘ নেই, তা কিন্তু নয়। আমি আমার জীবনে প্রথম বাঘ দেখেছিলাম জলদাপাড়ায়। এখন তা অনেকেই বিশ্বাস করতে চায় না। কিন্তু সেখানেও বাঘ আছে। নেওড়াভ্যালিতে বাঘ আছে। বাংলার বনাঞ্চলের আজ পর্যন্ত সবচেয়ে ভালো বা ইতিবাচক দিক হল যৌথ বনপরিচালন ব্যবস্থা। সেটা কী? জঙ্গল প্রান্তিক মানুষ অর্থাৎ জঙ্গল লাগোয়া গ্রামগুলির বাসিন্দাদের সংরক্ষণের আওতায় আনা হয়েছে। বন্যপ্রাণীদের বাঁচাতে বনকর্মী, বনদপ্তরের আধিকারিকরাই শুধু নয়, জঙ্গলবাসীকেও সংরক্ষণের অংশীদার হতে হবে। অর্থাৎ তাঁদেরও বুঝতে হবে, বাঘ বা অন্যান্য পশুকে বাঁচিয়ে রাখা দরকার। নিজেদের জন্য তাদের হত্যা করা সমাধান নয়, বরং বিপদ থেকে রক্ষা করার দায়িত্বও যে মানুষেরই, তাও বুঝতে হবে জঙ্গল লাগোয়া এলাকার বাসিন্দাদের। তাঁরা যদি না বোঝেন, তাহলে সংরক্ষণের কাজ সম্পূর্ণ হতে পারে না। ভারতের নিরিখে পশ্চিমবঙ্গে বাঘেদের কথা যদি বলা হয়, তাহলে বলব, আজ পর্যন্ত যেভাবে কাজ হচ্ছে, এটা চলতে থাকে এবং আরও উন্নতি করে এগোতে পারা যায়, তাহলে ভবিষ্যৎ ভালো। এই সিস্টেম ব্যাহত হলে তাহলে অন্ধকার দিন।
বাঘ সংরক্ষণে জোর দেওয়া প্রয়োজন এসব বিষয়ে
জঙ্গলের উপর মানুষের নির্ভরতা কমানো, জঙ্গলের নিরাপত্তা বাড়ানো, জঙ্গলের মধ্যে করিডরগুলিতে জনবসতি না গড়ে তা বাঁচিয়ে রাখা। করিডরগুলিতে বসতি স্থাপনের জন্য মানুষ-বন্যপ্রাণ সংঘাত বাড়ছে। এগুলো বাঁচিয়ে রাখতে না পারলে এই সংঘাত বড় আকার নেবে। আসলে জঙ্গল লাগোয়া এলাকার গ্রামবাসীদের জঙ্গল নির্ভরতা রয়েছে। তা কমানো দরকার। সুন্দরবনের কোর এরিয়ায় তাঁরা যে মধু, কাঁকড়া সংগ্রহ করতে যাচ্ছে, তা বিপজ্জনক। এতে যেমন তাঁদের বিপদ, তেমনই বাঘেরও বিপদ। কাঁকড়া ধরতে যাওয়া কোনও মানুষকে বাঘে টেনে নিয়ে যাচ্ছে – এই খবর পাওয়া যায় তাঁর সঙ্গীর থেকে। কিন্তু তাঁরাও যে বাঘকে কুড়ুল বা দা দিয়ে পিটিয়ে আসে অর্থাৎ আহত করছে, সেটা আর আমরা জানতে পারি না। ফলে যদি মানুষের জঙ্গলের নির্ভরতা কমানো যায়, তাঁদের জন্য বিকল্প অর্থনীতি, কাজের ব্যবস্থা করে দেওয়া যায়, তবেই ওই সংরক্ষণের কাজ পুরোপুরি করা সম্ভব। এতে সরকারি, বেসরকারি সব পক্ষকেই এগিয়ে আসতে হবে। তবে একথা মুখে বলা যত সহজ, কাজে করা ততটাই কঠিন।
বাঘের পরিসংখ্যানে ‘বিভ্রান্তি’
বাঘ, বাঘের বাসস্থান, সংরক্ষণ নিয়ে যখন এত কথা, তখন স্বাভাবিকভাবেই তথ্য-পরিসংখ্যান নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। দেশে কি বাঘের সংখ্যা বাড়ছে? এই প্রশ্নের জবাব ‘হ্যাঁ’ অথবা ‘না’-এ দেওয়া কঠিন। এসব পরিসংখ্যান আসলে নির্ভর করে অনেক কিছুর উপর। যে সব বাঘ বনাঞ্চলে অর্থাৎ প্রকৃতির মাঝে ঘুরে বেড়ায়, তাদের সংখ্যা কত, সেটাই এক্ষেত্রে মূল বিষয় হওয়া উচিত। যারা চিড়িয়াখানার বাসিন্দা, তারাও সংরক্ষিত নিঃসন্দেহে। কিন্তু খাঁচাবন্দি বাঘের পরিসংখ্যান পৃথক। তবে সামগ্রিকভাবে বিবেচনা করলে ইদানিং দেশে বাঘের সংখ্যা আগের তুলনায় বেশি।
‘জঙ্গলপ্রেমী না হলে বন্যপ্রাণ সংরক্ষণের গুরুত্ব বোঝা কঠিন’
পরিসংখ্যান থেকেই আসে সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়, গুরুত্ব এবং তা সমাজে পরিবেশ সচেতনতা বাড়ানো। এই কাজ অর্থাৎ সচেতনতা গড়ে তোলার কাজ একটি নিরলস প্রক্রিয়া। তা অত্যন্ত কঠিন কিন্তু অসম্ভব নয়। কলকাতা এবং সুন্দরবনের অন্তত ৯০ টি স্কুলে যাতায়াত করে ছোটদের মধ্যে প্রকৃতি বিষয়ক প্রাথমিক ধারণা তৈরি এবং শিশুমনকে প্রকৃতিমুখী করে তোলার জন্য বহু কর্মশালা হয়েছে। বন-জঙ্গল সংরক্ষণের মতো বৃহৎ ধারণা করা ছোটদের পক্ষে কঠিন। তাদের বোঝানো হয় যে তার বাড়ির পাশের গাছটি বাঁচিয়ে রাখাও জরুরি। কারণ, সেই গাছে হয়ত পাখিদের বাসা রয়েছে, সেই গাছের পাতা খেয়ে হয়ত বেঁচে থাকে অন্য কোনও প্রাণী। এভাবে ছোট ছোট স্তরে সহজ করে তাদের মনে প্রকৃতি সম্পর্কে বোধ তৈরি করার কাজ চলে ক্রমাগত। আশা এই যে, একদিন এই প্রকৃতি মানুষের মত বাঘেদেরও নিরাপদ চারণভূমি হয়ে উঠবে অনায়াসে। নিজেদের বৃত্ত নিয়ে আর নিজেদের গোষ্ঠীর মধ্যে লড়াই করতে হবে না, মানুষের আগ্রাসনে ভীত হতে হবে না ডোরাকাটা চারপেয়েদের। আন্তর্জাতিক ব্যাঘ্র দিবসে এটাই চাওয়া সকলের।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.