গৌতম ব্রহ্ম: রোশনাইয়ে চারদিক ঝকঝকে। নিশুতি রাতে ঝলমলিয়ে চোখ ধাঁধায় বাহারি আলোর বন্যা। ঔজ্জ্বল্যের স্রোতে ভেসে যায় শহরের প্রতিটি কোণ। এবং সেই কৃত্রিম আলোর ছোবলেই ঘোর বিপদের দোরগোড়ায় জীবজগৎ। বিশেষত এলইডি (LED) আলোর বাড়বাড়ন্ত ইদানীং সে বিপদ কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। মনুষ্যেতর জীবকুলের জৈব ঘড়ির (বায়োলজিক্যাল ক্লক) চালচলনে ডেকে এনেছে দুর্মর ছন্দপতন।
পরিণাম ভয়াবহ। ঘুমের ব্যাঘ্যাত ঘটায় বাদুড়, পেঁচার মতো বহু নিশাচরের শারীরবৃত্তীয় কার্যকলাপ তথা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতায় সাংঘাতিক ঝাঁকুনি। ফলে তাদের দেহভাণ্ডারে সঞ্চিত ভাইরাস ও অন্যান্য জীবাণু ছলকে বেরোচ্ছে। যার মারণ প্রভাব পড়ছে মানবসভ্যতায়। যে সব জীবাণু এতদিন মানবগোষ্ঠীতে ছিল না, প্রজাতিগত বাধা অতিক্রম করে সেগুলো মানুষের শরীরে থাবা বসাচ্ছে। সার্স, নিপা, ইবোলা, হেন্ড্রা এবং সাম্প্রতিককালের নভেল করোনার (Coronavirus) জীবাণুও বাদুড় থেকে ছলকে এসেছে। যার জেরেই মহামারী। কিন্তু এই ছলকে আসা বা ‘স্পিল ওভার’-এর কারণ পরিষ্কার হচ্ছিল না। নতুন গবেষণায় সেই চমকপ্রদ তথ্যই সামনে এল। পরিষ্কার হয়ে গেল, কৃত্রিম আলোর ছটায় সভ্যতা যত বেশি উদ্ভাসিত হবে, ততই আঁধার নামবে জৈবশৃঙ্খলে। ধীরে ধীরে খাদের কিনারায় চলে যাবে জীবকুলের অস্তিত্ব।
একাধিক গবেষণাপত্র বিশ্লেষণ করে এমন সিদ্ধান্তেই পৌঁছেছেন ভারতের একদল বিজ্ঞানী। যার নেতৃত্বে বাংলার কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যানিম্যাল সায়েন্সের বিভাগীয় প্রধান ড. অসমঞ্জ চট্টরাজ (Asamanja Chattoraj)। “কৃত্রিম আলো যত বাড়ছে, তত জুনোসিস বাড়ছে। বিশেষত নিশাচররা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।” হুঁশিয়ারি তাঁর। তিনি বলছিলেন, “কৃত্রিম আলো ব্যবহারে আমরা সতর্ক না হলে কিন্তু মহা বিপদ।”
গবেষণাপত্রটি বৃহস্পতিবারই ‘ফ্রন্টিয়ারস ইন এন্ডোক্রিনোলজি’ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছে। পর্যবেক্ষণ, আলো-দূষণ এখনও কোনও আন্তর্জাতিক কনভেনশেন আলোচ্য হয়ে ওঠেনি। ফলে সেভাবে গুরুত্ব পায়নি। কিন্তু তার দাপটে কিছু জীবের শারীরবৃত্তীয় কার্যকলাপ বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ছে। পাচনতন্ত্র থেকে ইমিউন সিস্টেম, রক্ত সংহবন থেকে জননতন্ত্র, সমস্ত জৈবিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে। এতে ভাইরাস-জীবাণু আর শুধু ‘হোস্ট’ বা পোষকের শরীরে আবদ্ধ থাকতে পারছে না। উছলে বেরিয়ে চড়াও হচ্ছে মানুষের ঘাড়ে। যার অন্যতম পরিণাম কোভিড–১৯ অতিমারী।
যা নিয়ে চিন্তিত ভাইরোলজিস্টরাও। বেলগাছিয়া প্রাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডা. সিদ্ধার্থ জোয়ারদারের বক্তব্য, “পৃথিবী যে শুধু মানুষের জন্য নয়, কোভিড-১৯ ফের তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। আমাদের মাথায় রাখতে হবে যে, সারা বিশ্বের স্বাস্থ্য একটি অবিচ্ছন্ন বিষয় (ওয়ান হেলথ)।” চিন্তায় পতঙ্গবিদরাও। গবেষক অর্ণব চক্রবর্তী জানান, “কৃত্রিম আলোয় মেলাটোনিন নিঃসরণে হেরফের হওয়ায় ইমিউন সেলগুলি ‘ডাউন রেগুলেটেড’ হয়ে যায়। তার জেরেই জীবদের মধ্যে সংক্রমণের প্রকোপ বাড়ে। ফলে ভাইরাল শেডিং’–ও বেড়ে যায়।
গবেষণায় অসমঞ্জের সহযোগী ছিলেন তাঁর বেশ কয়েক জন ছাত্র। জিশান আহমেদ খান, থাঙ্গাল ওয়াই, গোপীনাথ মণ্ডল, জ্যোতি এস এইচ, রাজীব সি এইচ, সঞ্জিতা দেবী ও রাজেন্দ্রকুমার লাবালা। যাদের অনেকেই মনিপুরের ‘ইনস্টিটিউট ফর বায়ো–রিসোর্সেস অ্যান্ড সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট, ডিবিটি’–এর সঙ্গে যুক্ত। ২০১১ থেকে কৃত্রিম আলো নিয়ে কাজ করছেন অসমঞ্জ। এর আগে তিনি দেখিয়েছেন, কৃত্রিম আলোয় টানা রাখা হলে জেব্রা ফিসের ডিম্বাশয়ে টিউমার সৃষ্টি হচ্ছে। ‘সায়েন্স অফ দ্য টোটাল এনভায়রনমেন্ট’ ম্যাগাজিনে সেই গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়। কোভিড পর্ব শুরু হতেই গবেষণার ব্যাপ্তি ঘটনা তাঁরা। কোভিড ১৯-এর সঙ্গে কৃত্রিম আলোর সম্পর্ক খুঁজতে শুরু করেন। তাতেই উঠে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.