অভিরূপ দাস: অপেক্ষা করতে হবে না ফরেনসিক রিপোর্টের জন্য! মৃত্যুর সময় বলে দেবে মাছি। শুনতে অবাক লাগলেও এটাই সত্যি। রহস্য মৃত্যুর ক্ষেত্রে নিখুঁত সময় জানিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে ‘সত্যান্বেষী’র ভূমিকায় কাজ করবে একঝাঁক নীলাভ-সবুজ মাছি। ময়নাতদন্তের ক্ষেত্রে এমনই অসাধ্য সাধন করে বিপ্লব ঘটালেন একঝাঁক বাঙালি বিজ্ঞানী। জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার ওই বিজ্ঞানীদের কথায়, ”ডিএনএ-তে মিলবে মৃত্যুর একেবারে সঠিক সময়। রহস্য মৃত্যুর ক্ষেত্রে প্রথম সাক্ষী হবে এই পতঙ্গ।” কীভাবে তা সম্ভব? কী বলছেন গবেষকরা?
তাঁদের ব্যাখ্যা, কোনও মৃত ব্যক্তির দেহে যখন পচন শুরু হয়, একপ্রকার মাছি সবার প্রথম সেখানে পৌঁছায়। এই মাছির রঙ নীলাচে ধাতব। মূলত ‘ব্লো ফ্লাই’ হিসাবেই পরিচিত। আর এই মাছিই যে কোনও রহস্য মৃত্যুর পর্দাফাঁস করবে। ময়নাতদন্তের ক্ষেত্রে নতুন দিক খুলে দেবে। বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, ‘ব্লো ফ্লাই’ মৃতদেহের উপর ডিম পাড়ে। তৈরি হয় লার্ভা। দেহের পচনের সময়কালই মৃত্যুর আনুমানিক সময় জানিয়ে দিতে পারবে। বিজ্ঞানীদের কথায়, পুরো প্রক্রিয়াটিকে ফরেনসিক ভাষায় বলা হয় ‘পোস্টমর্টেম ইন্টারভ্যাল’ বা PMI। কিন্তু এক্ষেত্রে ছিল বড় চ্যালেঞ্জ।
মাছিগুলির সঠিক পরিচয় নির্ধারণ ছিল একপ্রকার অসম্ভব। ডিম বা পিউপা অবস্থায় পাওয়া যেত। কিন্তু বাংলার জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার একদল গবেষক একপ্রকার এই রহস্যের পর্দাফাঁস করে ফেলেছেন। এই গবেষক দলে রয়েছেন ঐশিক কর, অর্ক মুখোপাধ্যায়, কৌস্তুভ মুখোপাধ্যায়, দেবদীপ প্রামাণিক, অতনু নস্কর এবং ডিরেক্টর ড. ধৃতি বন্দ্যোপাধ্যায় (প্রধান)। তাঁদের এই যুগান্তকারী গবেষণা সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক মানের PLOS ONE পত্রিকায়। যেখানে বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেছেন, মাছির ডিএনএ বারকোডই হতে পারে একটি মৃতদেহের নির্দিষ্ট সময় ও স্থান নির্ধারণের নির্ভুল হাতিয়ার।
তবে এই গবেষণা চালাতে বাংলার চারটি আলাদা আলাদা এলাকা থেকে মোট ২,৯৭৭টি ‘ব্লো ফ্লাই’ প্রজাতির মাছির নমুনা। জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার তরফে জারি করা বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, ‘COI’ নামে পরিচিত মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ বিশ্লেষণের মাধ্যমে বাঙালি বিজ্ঞানীরা ১৭টি স্বতন্ত্র প্রজাতিকে শনাক্ত করেছেন। যা চারটি গুণের অন্তর্গত- Calliphora, Chrysomya, Lucilia এবং Hemipyrellia। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, একই প্রজাতির মাছির মধ্যে জিনগত পার্থক্য প্রায় নেই বললেই চলে। অথচ আলাদা প্রজাতির মধ্যে সেই পার্থক্য হতে পারে ১২.২৯% পর্যন্ত। আর সেটাই বিভিন্ন প্রজাতির মাছিকে আলাদা কর দেয়।
এখানেই শেষ নয়, BIN, ASAP, PTP ও GMYC – এই চারটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত প্রজাতি সীমা নির্ধারণ পদ্ধতিও একই রকম ফল দিয়েছে, যা গবেষণার নির্ভরযোগ্যতাকে আরও মজবুত করেছে বলেও দাবি বিজ্ঞানীদের। এখানেই শেষ নয়, Neighbour-Joining বিশ্লেষণেও আলাদা আলাদা ক্লাস্টার তৈরি হয়েছে প্রতিটি প্রজাতির ক্ষেত্রে। আর এর মাধ্যমেই বাঙালি গবেষকরা আরও প্রমাণ করেছেন, প্রতিটি মাছির ক্ষেত্রে জিনগত পরিচয় রয়েছে আলাদা আলাদা। এর ফলে খুব সহজেই শনাক্ত করা সম্ভব।
গবেষণা বলছে আরও বলছে, COI বারকোডিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে যে কোনও পর্যায়ের ব্লো ফ্লাই – হোক সে ডিম, লার্ভা বা প্রাপ্তবয়স্ক – খুব দ্রুত ও নির্ভুলভাবে শনাক্ত করা যায়। বিজ্ঞানীদের কথায়, আর এই অসাধ্য সাধনের ফলে ফরেনসিকের ক্ষেত্রে সময় অনেকটাই বাঁচবে। বিজ্ঞানীদের কথায়, অপরাধ তদন্তের স্বচ্ছতা এবং গতি আসবে। জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, বাঙালি বিজ্ঞানীদের এই গবেষণা BOLD ও NCBI-এর মতো আন্তর্জাতিক ডিএনএ ডেটাবেসেও অন্তর্ভুক্ত হবে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.