শুভজিৎ মণ্ডল: ঋষভ পন্থ, আপনি বড্ড স্টুপিড ক্রিকেট খেলেন। আপনি গাব্বার বাউন্সে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে মিচেল স্টার্ককে ছক্কা হাঁকানোর দুঃসাহস দেখান। আপনি মেঘলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে জেমস অ্যান্ডারসনকে রিভার্স সুইপে বাউন্ডারির বাইরে ফেলে দেওয়ার গোয়ার্তুমি করেন। আপনি, পঞ্চম দিনের ঘূর্ণির সামনে দাঁড়িয়ে নায়ান লিওর মতো স্পিনারকে এক হাতে ছক্কা হাঁকিয়ে দেন। আপনি জো’বার্গের বাউন্সের চৌবাচ্চায় ডুবেও মাটিতে শুয়ে শট মারার ঔদ্ধত্য দেখান। যে পিচে বিশুদ্ধ কপিবুক ক্রিকেট খেলা তাবড় ব্যাটাররা নিজেদের উইকেট বাঁচাতে মত্ত থাকেন, সেই পিচে পালটা আক্রমণ করার মতো ‘স্টুপিডিটি’ কেন?
ঋষভ পন্থ, যে ক্রিকেট আপনাকে সাফল্য দিয়েছে, হারের মুখ থেকে আপনার দেশকে জিতিয়ে দিয়েছে, কিংবা বহু হেরে যাওয়া ম্যাচে দেশকে সম্মানজনক জায়গায় পৌঁছে দিয়েছে, সেই ক্রিকেট যদি ‘স্টুপিড’ হয়ে থাকে তাহলে আপনি বেশ করেছেন। হ্যাঁ, আপনার শট সিলেকশন নিয়ে, আপনার খেলার ধরন নিয়ে বহু মানুষের আপত্তি রয়েছে। আপনার এক হাতে ছক্কা, বা টেস্টের ব্যকরণ ভুলে গিয়ে প্যাডেল সুইপ, বা রিভার্স সুইপকে টেস্ট ক্রিকটোচিত বলে মানতে চান না অনেকে। কিন্তু তাঁরা কেউ তো আপনাকে উপেক্ষাও করতে পারছেন না। পারছেন না কারণ, এই স্টুপিড ক্রিকেট আপনাকে সাফল্য এনে দিয়েছে। টেস্ট ক্রিকেটে এখন আপনি ভারতীয় উইকেটরক্ষকদের মধ্যে সর্বাধিক সেঞ্চুরির মালিক। SENA দেশগুলিতে গিয়ে আপনার সেঞ্চুরি সংখ্যা পাঁচ। যা তাবড় তাবড় ব্যাটারদের স্বপ্ন। ৪৪ টেস্ট খেলে আপনার ব্যাটিং গড় ৪৩-এর বেশি। বর্তমান ভারতীয় দলে যশস্বী জয়সওয়ালকে বাদ দিলে আর কোনও ব্যাটারের টেস্ট গড় আপনার ধারেকাছে নয়। আলটপকা ইনিংস খেলে খেলেই অজিঙ্ক রাহানে, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়, রোহিত শর্মা, শিখর ধাওয়ান, মহেন্দ্র সিং ধোনি, গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথ, মোহিন্দর অমরনাথ, দিলীপ বেঙ্গসরকার, পলি উমরিগরদের থেকে বেশি গড় রেখে আপনি টেস্ট খেলে চলেছেন। আপনার টেস্ট গড় চেতেশ্বর পূজারা, ভিভিএস লক্ষ্মণ মহম্মদ আজহারউদ্দিনদের মতো টেস্ট কিংবদন্তিদের প্রায় সমান। মাত্র ৪৪ ম্যাচ খেলে আপনি টেস্টে ৩ হাজারের বেশি রান করে ফেলেছেন। সেটাও একটা রেকর্ড। অ্যাডাম গিলখ্রিস্টের পর দ্রুততম উইকেটরক্ষক হিসাবে ৩ হাজারি ক্লাবে ঢুকেছেন আপনি। তবে সত্যি বলতে কী, আপনাকে নিয়ে লিখতে বসে এই পরিসংখ্যানের কচকচানি অর্থহীন। কারণ মাত্র ৪৪ টেস্টের পরিসংখ্যান কখনওই প্রামাণ্য হতে পারে না। তাছাড়া কারণ কোন ম্যাচে আপনার ইমপ্যাক্ট কতটা? কোন ছোট্ট ইনিংস খেলার মোড় ঘোরাল, বা কোনও ছোট্ট ইনিংসে আপনি ম্যাচ জিতিয়ে দিল, কোনও পরিসংখ্যানেই সেটা ধরা পড়ে না। তাছাড়া নেভিল কার্ডাস তো বলেই গিয়েছেন, “স্কোরবোর্ড একটা গাধা।”
অনেকে বলছেন, ক্রিকেট তো ভদ্রলোকের খেলা, তাতে একটু ভদ্রতা থাকবে না? ব্যাট ও বলের চুম্বনের মিষ্টি শব্দ থাকবে না? দুই ফিল্ডারের মধ্যে দিয়ে নিখুঁত শটে বল গলিয়ে দেওয়া থাকবে না, খালি নির্মমভাবে আঘাত করে যাওয়াই কি সব! উত্তর হল, আলবাত থাকবে। তাতে তো বিশেষ আপত্তি কারও নেই। যারা ওই ‘সুন্দর’ ক্রিকেট খেলতে পারেন, খেলুন না। তাতে আপনি বা আপনার ভক্তরা আপত্তি করেননি। তাহলে আপনার ভয়ংকর, বিধ্বংসী এবং ‘আউট অফ দ্য বক্স’ ক্রিকেটে বাকিদের আপত্তি কেন? আসলে একশ্রেণির ক্রিকেটপ্রেমীদের ধারণা, যা কিছু নতুন, যা কিছু চিরাচারিত নয়, সবটাই খারাপ। এরা একসময় মুস্তাক আহমেদের রিভার্স সুইপ নিয়ে আপত্তি তুলেছিল, এরা প্যাডেল সুইপকে অক্রিকেটীয় বলেছিল, এঁরা শেহওয়াগের আপার কাট দেখেও ভ্রু কুঁচকেছিল। আসলে এই বিশুদ্ধবাদীরা মনে করেন, ক্রিকেটীয় ব্যাকরণের বাইরে কোনও কিছুই সুন্দর হতে পারে না। অথচ, যখন যা নিয়ে এরা আপত্তি জানিয়েছেন সেই সব কিছু একটা সময় পর ক্রিকেটীয় অভিধানে ঢুকে গিয়েছে। আজ বিশ্বের সেরা টেস্ট ব্যাটার জো রুটের অন্যতম অস্ত্র তো ওই রিভার্স সুইপই। ক্রিকেট বিশ্বের অধিকাংশ ব্যাটারই টেস্ট ক্রিকেটে ‘ওভার দ্য টপ’ শট খেলাকে স্বাভাবিক বলে মনে করেন। খোদ ক্রিকেট ঈশ্বর শচীন তেণ্ডুলকরকেও টেস্ট ক্রিকেটে প্যাডেল সুইপ খেলতে দেখা গিয়েছে। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে ক্রিকেট যেদিকে এগোচ্ছে, তাতে ঋষভ পন্থের ওই ‘আলটপকা’ শটগুলিই আগামী দিনে নিউ নরম্যাল হয়ে যাবে না, সেটা কে বলতে পারে! তবে সোজা ব্যাটের প্রথাগত ক্রিকেটের কৌলিন্যকে উপেক্ষা করাটাও ধৃষ্টতা হবে।
প্রশ্ন উঠতে পারে, এই আলটপকা শটগুলি যেমন আপনাকে সাফল্য পাইয়ে দিতে পারে, তেমন ভুল সময়ে ভুল শট খেলে আউট হয়ে আপনি তো দলকে বিপদেও ফেলেছেন। উত্তর খুব সহজ, যে শট আপনি ভালো খেলেন, যে শটে আপনি সাফল্য পান, সেই শট সবসময় নিখুঁত হবে তেমন মাথার দিব্যি কে দিয়েছে? বিরাট কোহলিও তো কভার ড্রাইভ খেলতে গিয়ে আউট হন, স্কয়্যার কাট মারতে গিয়ে বহুবার প্লেইড অন হয়েছেন রাহুল দ্রাবিড়, লেগ গ্লান্স মারতে গিয়ে আউট হয়েছেন লক্ষ্মণ, পুল মারতে গিয়ে বহুবার বাউন্ডারির ধারে ধরা পড়েছেন রোহিত শর্মা। সেগুলি যদি অপরাধ না হয়, তাহলে এক হাতে শট খেলে পন্থ আউট হলে সেটা কেন অপরাধ হবে?
হ্যাঁ, আপনি যে ক্রিকেট খেলেন সেটা নিখুঁত নয়। হয়তো টেস্ট ক্রিকেটের ব্যাকরণেও সবটা নেই। কিন্তু তাতে কি আপনার কৃতিত্বকে খাটো করে দেখানোর কোনও কারণ আছে? শুধু ক্রিকেটীয় শট খেলতেই দক্ষতার প্রয়োজন হয়, আর এক হাতে ছক্কা মারতে কোনও দক্ষতার প্রয়োজন পড়ে না তেমনটা তো নয়! আসলে সাফল্য এবং ব্যর্থতা আঙ্গিক বদলে দেয়। আপনার যে শটের জন্য সুনীল গাভাসকর তাঁকে স্টুপিড বলে কটাক্ষ করেছিলেন, সেই একই শট যখন বাউন্ডারি পেরিয়ে ছক্কা হয়ে গেল, তখন সেই গাভাসকরই সেই একই ধরনের শটকে ‘সুপার্ব’ বলে প্রশংসা করলেন। যে প্যাডেল সুইপ এত সমালোচিত, সেটাকেই শচীন তেণ্ডুলকর ‘বুদ্ধিমান’ শট বলে দিলেন। আপনার বয়স মাত্র ২৭ বছর। খেলেছেন মাত্র ৪৪ টেস্ট। এখনই আপনাকে পথিকৃৎ বলাটা হয়তো বাড়াবাড়ি হবে। আবার এ কথাও ঠিক ৪৪ টেস্টটা নিতান্ত কমও নয়। কিন্তু আপনি যে ক্রিকেটটা খেলছেন তাতে, যদি সাফল্য আসে, তাতে যদি ম্যাচের মোড় ঘুরে যায় তাতে অন্যায় নেই। ক্রিকেট যেমন শুধু ঔদ্ধত্যের খেলা নয়, ক্রিকেট তেমন শুধু সৌন্দর্যেরও খেলা নয়। দিনের শেষে হার-জিতটাও গুরুত্বপূর্ণ।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.