Advertisement
Advertisement
Virat Kohli

রাজার মুকুট, রাজার সাজ! ক্রিকেটীয় বিশ্লেষণের ঊর্ধ্বে কোহলির হাসি-কান্নায় মাখা অধরা মাধুরী

সতেরো বছর ধরে বিরাট কোহলি নামক এক ক্রিকেট সাধকের 'কাঙালের' মতো ফিরে আসার শেষ।

IPL 2025: at last Virat Kohli wins ipl trophy after 18 years of waiting

ফাইল ছবি।

Published by: Arpan Das
  • Posted:June 4, 2025 12:09 pm
  • Updated:June 4, 2025 1:47 pm   

রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়: পরিচিত পরিত্রাহী চিৎকারটা বেরোল অনেক, অনেক পরে। ট্রফি পোডিয়ামে। মায়াবী আমেদাবাদ আকাশের নিচে স্পষ্ট দেখলাম, আঠারো বছরের সুপ্ত জ্বালা নিয়ে কেমন দিগন্তবিস্তৃত হচ্ছে এক দিগ্বিজয়ীর গ্রীবা। তীব্র সোল্লাসে আজ সে দিক-দিগন্তে এক মহার্ঘ্য বার্তা ছড়িয়ে দিতে চায়। নিছক ভারতবর্ষ নয়, সমগ্র পৃথিবীকে অমোঘ বেতার বার্তা পাঠাতে চায়, দেখো হে, আমি আজ চ্যাম্পিয়ন, আইপিএল চ্যাম্পিয়ন! আর কী আজব ব্যাপার দেখুন, চিৎকারটা কিছুতেই থামছে না! চিলতে কমছেও না। বরং উত্তরোত্তর ঝাঁজ বাড়ছে যেন, প্রতি পলকে, প্রতি লহমায়। কী মনে হল মাঝে, পোডিয়াম থেকে আচম্বিত নেমে এলেন একবার। মাঠে বসে পড়লেন হাত-পা ছড়িয়ে। সদলবলে। সুদৃশ্য ট্রফিখানা পাশে রেখে। এবং শেষে আবার চিৎকার। বারবার। মুহুর্মুহু। দু’চোখে টলটলে জল নিয়ে!

Advertisement

কেন জানি না মনে হচ্ছে, ভারতীয় ক্রিকেট যত দিন বেঁচে থাকবে, মঙ্গলবারের আমেদাবাদ রাতকে তার পক্ষে কখনও ভুলে যাওয়া সম্ভব হবে না। একই দিনে বিরাট (Virat Kohli) রাজার অক্লান্ত আক্রোশ ও অঝোর কান্না শেষ কবে দেখেছে এ পৃথিবী? শেষ কবে দেখেছে তাঁর এমন আকুতি, যা মুক্তোবিন্দু হয়ে গড়িয়ে পড়েছে গাল বেয়ে, অকাতরে? রাত্তির একটাও দেখছি, দু’পাশে অভিন্নহৃদয় সুহৃদ এবি ডে’ভিলিয়ার্স এর পাগড়ি পরিহিত ক্রিস গেইলকে নিয়ে টিভি সাক্ষাৎকার দিয়ে যাচ্ছেন বিরাট। সেই গেইল, সেই এবিডি, সেই তিনি-‘হোলি ট্রিনিটি অফ আরসিবি!’ যাঁরা একযোগে, এক জার্সিতে প্রাণান্ত প্রচেষ্টা চালিয়েছেন বহু দিন, বহু বছর। বলা ভালো, বছরের পর বছর। কিন্তু কাপ কখনও আসেনি। ক্রিকেট দেবতা কখনও ‘হোলি ট্রিনিটি’-র হাতে তুলে দেয়নি আইপিএল ট্রফি, প্রত্যেকে তার কৃতী সন্তান হওয়া সত্ত্বেও। আজ দিল। এত দিন পর দিল। আঠারো বছর পর দিল। সেই অবিস্মরণীয় সুখের দিনে, অধরা মাধুরী ছোঁয়ার দিনে, কোহলি ডাক দেবেন না দুই পুরনো মিত্রকে? কাঁদবেন না হৃদয় খালি করে? কাঁদতে-কাঁদতে হা-হা হাসবেন না উন্মাদের মতো? আজ না করলে, কোহলি এ সব আর করবেন কবে?
আজকের পর যে বিরাট প্রায় সর্বজয়ী রাজা, আইপিএলেরও রাজা! মহেন্দ্র সিং ধোনি-রোহিত শর্মা-গৌতম গম্ভীরদের মতোই এক জয়ী নৃপতি।

আ কিং ফাইনালি হ্যাজ হিজ ক্রাউন!

অনাবশ্যক ভাবে আবেগের আতিশয্যের শরিক হওয়ার জন্য নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি সর্বপ্রথমে। পেশাদার সাংবাদিকের আবেগ-সমুদ্রে নিজেকে নিমজ্জিত করলে চলে না। কিন্তু কী করা যাবে? বছর নয় পূর্বেও যে চিন্নাস্বামীকে শ্মশানে পরিণত হতে দেখে এসেছি, এমনই এক আরসিবি-কেন্দ্রিক আইপিএল ফাইনালের পর। সে বারও কায়মনোবাক্যে আসমুদ্রহিমাচল প্রার্থনা করেছিল, বিরাটের ট্রফি জয়ের। তবু হয়নি। কোনও এক ডেভিড ওয়ার্নার সে বছর ট্রফি কেড়ে নিয়ে চলে গিয়েছিলেন বিরাটের। কোহলিকে সে দিনও দেখেছিলাম, হাততালি দিতে-দিতে গোটা মাঠ ঘুরতে। তবে সন্তপ্ত হৃদয়ে। মঙ্গলবারের মতো জয়ীর অলিভ পাতার মুকুট পরে সগর্বে নয়। গভীর রাতে বেঙ্গালুরুর ‘ভিস্যুয়ালস’ দেখে বুঝলাম, দাক্ষিণাত্যের শহর মঙ্গল-রাতে আর ঘুমোবে না। চতুর্দিকে স্রেফ আলো আর আলো! গরিমার আলো! বিজয়ীর আলো! খেয়ালই করিনি, ততক্ষণে বিরাট রাজা চলে গিয়েছেন ক্রুণাল পাণ্ডিয়ার কাছে। সিনিয়র পাণ্ডিয়াকে জড়িয়ে নিয়েছেন বুকে।

যে দৃশ্য স্বাভাবিক, অতীব স্বাভাবিক। দুঃখের হল, ভাই হার্দিকের প্রখর প্রতাপে দাদা ক্রুণালকে নিয়ে সে রকম আলোচনাই হয় না। তিনি যেন চিরকালের ‘সেকেন্ড ক্লাস সিটিজেন’, ক্রিকেট পণ্ডিতদের কাছে ‘বিটস অ্যান্ড পিসেস’ ক্রিকেটার! ক্রুণাল এদিনের আমেদাবাদে সর্বসমক্ষে বুঝিয়ে দিলেন, রবীন্দ্র জাদেজা-উত্তর সময়ে শুধুই অক্ষর প্যাটেল নন। তিনিও যোগ্য বিকল্প হতে পারেন। এবং তথাকথিত ‘বিটস অ্যান্ড পিসেস’ ক্রিকেটার তিনি কখনওই নন। কখনও ছিলেনও না। ভাবা যায়, আইপিএল ফাইনালের মহাচাপ সামলে তিনি চার ওভারে দিলেন মাত্র ১৭! উইকেট নিলেন দু’টো। প্রভসিমরণ সিং (২৬) আর জশ ইঙ্গলিশকে (৩৯) আউট করলেন গতির হেরফেরে। দু’জনের একজনও থেকে গেলে, পরের দিকে তাণ্ডব বাঁধিয়ে দিতেন নিঃসন্দেহে। ক্রুণালের সেই দুই মারণ ডেলিভারির গতি শুনবেন? প্রভসিমরণেরটা ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার। ইঙ্গলিশেরটা একশো! ক্রুণালের কোন ডেলিভারি ঠিক কত গতিতে আসবে, ধরতে পারেননি পাঞ্জাব ব্যাটাররা। শ্রেয়স আইয়াররা বুঝতে পারেনি, তাঁদেরই প্রদত্ত দাওয়াই, দিন শেষে তাঁদের দিকেই এমন ধেয়ে আসবে!

আমেদাবাদের বাইশ গজ নামক ‘ব্যাটিং দেবভূমি’-তে যা ব্যাটারের একমাত্র প্রতিষেধক ছিল। যা কখনও শ্রেয়স প্রয়োগ করেছেন, কখনও পাতিদার। আরসিবি যে দু’শো তুলতে পারেনি, তার কারণ একটাই-পাঞ্জাব বোলারদের ব্যাক অফ লেংথ বোলিং। পরের পর স্লোয়ার বাউন্সার প্রদান। ব্যাটারকে কিছুতেই ছন্দ পেতে না দেওয়া। বড় পার্টনারশিপ না গড়তে দেওয়া। ছিনে জোঁকের মতো আরসিবি ব্যাটিং ইউনিটের পিছনে লেগে থেকে! কোহলি যে কোহলি (৪৩), তিনি পর্যন্ত ইনিংসে ৩৫ বল খেলে বুঝতে পারেননি, পরের ডেলিভারিটা ঠিক কী আসবে? যে মহৌষধি আরসিবি বোলাররাও সমান প্রয়োগ করে গেলেন। সময়-সময় মনে হচ্ছে, জিতেশের ১০ বলে ২৪ রানের বিস্ফোরণ ক্রুণালের কৃপণ বোলিং সহ জোড়া উইকেটের চেয়ে কম কিছু নয়। দশটা রান কম উঠলে খেলা পাঞ্জাবের দিকেও ঘুরে যেতে পারত। শ্রেয়সরা ফাইনাল হেরেছেন কিন্তু মাত্র ছ’রানে!

যাক গে, মরুক গে। দেশের অসহ্য আনন্দের দিনে কবেই বা এত চুলচেরা ক্রিকেটীয় বিশ্লেষণ জায়গা পেয়েছে?

মঙ্গলবারের রাত, বিরাটের রাত (Virat Kohli)। দীর্ঘ হাহাকার শেষে এক অফুরান উৎসবের রাত। নভজ্যোৎ সিং সিধু ঠিকই বলছিলেন যে, যত না বিরাট চেয়েছিলেন কাপটা জিততে, তার চেয়ে অনেক বেশি চেয়েছিল তাঁর দেশ। নাম যার ভারতবর্ষ। ব্রিটেনের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ভারতীয় বংশেদ্ভূত ঋষি সুনক পর্যন্ত মাঠে উপস্থিত হয়ে গলা ফাটাচ্ছিলেন ‘কিং’-এর জন্য। লিখলাম না, কেউ আর পারছিলেন না। বিগত সতেরো বছরে তিন আইপিএল ফাইনালে প্রিয় নায়ককে পরাভূত হতে দেখার পর, কেউ আর নতুন করে অপেক্ষার দেশে যেতে চাইছিলেন না। তাঁরা মনপ্রাণ দিয়ে দেখতে চাইছিলেন, এ যন্ত্রণার শেষ, সতেরো বছর ধরে বিরাট কোহলি নামক এক ক্রিকেট সাধকের ‘কাঙালের’ মতো ফিরে আসার শেষ। দেখতে চাইছিলেন, এক অভিশাপের মৃত্যু।

কী বললেন? প্রীতির পাঞ্জাব? ও ঠিক আছে, হবে কখনও। সবে তো দু’টো ফাইনাল খেলল!

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ