অর্পণ দাস: সমাপ্ত হল বর্ধিত কলেবরের প্রথম ক্লাব বিশ্বকাপ। নিউ জার্সির মেটলাইফ স্টেডিয়ামে পিএসজি-কে ৩-০ গোলে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হল চেলসি। হাফটাইমে নাচে-গানে মাতিয়ে রাখলেন ডোজা ক্যাট, কোল্ড প্লে। পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। একমাস ধরে ৩২টা দলের ৬৩টি ম্যাচ। ক্লাব বিশ্বকাপ প্রতি বছরই হয়। প্রতিটা মহাদেশের চ্যাম্পিয়ন দলগুলো অংশগ্রহণ করত। এবার সেটাই আরও বড় করে হয়েছে। ফিফা প্রেসিডেন্ট জিয়ান্নি ইনফান্তিনো তো বলেই দিয়েছেন, “এটাই বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্লাব টুর্নামেন্ট। ক্লাব ফুটবলের সোনালী যুগের সূত্রপাত হল। ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপ বিরাট সাফল্য অর্জন করেছে।” সেটা তো ফিফা প্রেসিডেন্টের ঘোষণা। ক্লাব বিশ্বকাপ থেকে আদৌ কি ফুটবল কিছু পেল? নাকি মুনাফার টানে ফুটবলের গরিমা ও ফুটবলারদের কেরিয়ার নিয়ে শুধুই ছেলেখেলা চলছে?
মোটা টাকা আয়: ক্লাব বিশ্বকাপের মোট পুরস্কার মূল্য ১ বিলিয়ন ডলার। টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করা প্রতিটা দলই এখান থেকে টাকা পাবে। সঙ্গে প্রতিটা ধাপ পেরনোর জন্য বড় অঙ্কের টাকা পাবে। এর বাইরে আছে টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করার টাকা। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার জন্য চেলসি পাচ্ছে ১২৩২.৯৫ কোটি টাকা। রানার্স পিএসজি পাবে ১১৩২.৭১ কোটি টাকা। এর থেকে ফিফা নিজে কোনও টাকা নিচ্ছে না। যা বেঁচে থাকবে, তা ফুটবলের উন্নয়নের স্বার্থে ব্যয় করার ঘোষণা করেছেন ইনফান্তিনো। তাহলে ফিফার স্বার্থ কোথায়? প্রথম কথা, ফিফা তো কোনও ব্যবসায়িক সংস্থা নয়। দ্বিতীয়ত, ক্লাব বিশ্বকাপ ইনফান্তিনোর স্বপ্নের প্রকল্প। এই নিয়ে অনেকবার, অনেক দেশে চেষ্টা করেছেন। যেটা আমেরিকার মাটিতে বাস্তব হয়েছে। তৃতীয় বিষয়, সম্প্রচারের দায়িত্ব নিয়েছিল DAZN। যখন তাদের সঙ্গে ফিফার চুক্তি হয়, তখন তারা ক্ষতির সামনে ছিল। সেই সংস্থার সঙ্গে ফিফার চুক্তি হয় ১ বিলিয়ন ডলারের। যেখানে ফিফা সাধারণত চুক্তি করে বিবিসি ও আইটিভি’র সঙ্গে। তাতে ফিফার নিজস্ব যে কোনো লাভ নেই, এমনটা মেনে নেওয়া মুশকিল। জানা যাচ্ছে, ক্লাব বিশ্বকাপ থেকে মোট ২ বিলিয়ন ডলার আয় হচ্ছে ফিফার। সেটা তো ফিফা ছাড়বে না। অব্যবসায়িক সংস্থার ক্ষেত্রে লাভটা নেহাত কম নয়। ক্লাবগুলোরও রাজি না হওয়ার কোনও কারণ নেই। চ্যাম্পিয়ন চেলসি যা আয় করল, তাতে তাদের নতুন তারকা জোয়াও পেদ্রোকে সই করানোর টাকা উঠে এসেছে। সেটাই বা মন্দ কী!
প্লেয়ারদের চোট-আঘাত, ক্লান্তি: ২০২৪-এ এরকম সময়ে ছিল কোপা আমেরিকা, ইউরো কাপ। এবছর ক্লাব বিশ্বকাপ। পরের বছর বিশ্বকাপ। অর্থাৎ, টানা তিনটে মরশুমে বিশ্রাম পাচ্ছেন না বিশ্বের সেরা ফুটবলাররা। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ শুরু হচ্ছে ১৫ আগস্ট। প্রস্তুতি শুরু করতে হবে অন্তত ১৫-২০ দিন আগে। অর্থাৎ প্লেয়ারদের বিশ্রামের জন্য বরাদ্দ মেরেকেটে ১০ দিন। ফিফার আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট না থাকলে ক্লাবগুলো সাধারণত অন্য দেশের ক্লাবদের সঙ্গে প্রীতি ম্যাচ খেলতে যায়। তাতে সংযোগ বাড়ে। গত দুয়েক মরশুম থেকে সেসবের বালাই নেই। এবার যোগ হল ক্লাব বিশ্বকাপ। ফলে কী দেখা যাচ্ছে? অতিরিক্ত পরিশ্রমের জন্য প্লেয়ারদের চোট পাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। সদ্য চোট সারিয়ে ফেরা জামাল মুসিয়ালা ফের আহত হয়ে অন্তত ৬ মাসের জন্য মাঠের বাইরে চলে গেলেন। ফুটবলারদের সংগঠন অতিরিক্ত ধকলের বিষয়টি নিয়ে লড়েছে। সাফল্যও পেয়েছে। শেষ পর্যন্ত সমঝোতায় আসা গিয়েছে যে, ৭২ ঘণ্টার মধ্যে পরপর দুটো ম্যাচ করা যাবে না। মরশুমের মাঝে অন্তত তিন সপ্তাহ বিরতি থাকবে। ফিফা এই সমঝোতায় এসেছে ক্লাব বিশ্বকাপের ঠিক শেষ লগ্নে। পরের বছর বিশ্বকাপ। তাহলে এই নিয়ম লাগু হতে হতে ২০২৭। তার পরের বছর আবার কোপা ও ইউরো। মাঝে তাহলে ক্লাব বিশ্বকাপ কোনও একটা সময়ে হবে। ফিফা নিজস্ব উইন্ডো তৈরি করে নেবে। আবার বিশ্বকাপে দলের সংখ্যা বাড়ছে। অর্থাৎ যোগ্যতা অর্জনের ম্যাচও বাড়বে। চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফরম্যাট বদলেছে। ফলে প্লেয়াররা এই সমঝোতার সুফল পাবে কি না, সেটাও প্রশ্ন। মনে হচ্ছে লিভারপুলের প্রাক্তন কোচ যুর্গেন ক্লপের ধারণাই সঠিক, “ফুটবলে প্রয়োগ করা সবচেয়ে খারাপ আইডিয়া ক্লাব বিশ্বকাপ।”
ট্রাম্প, ইনফান্তিনো ও রাজনীতির অঙ্ক: ক্লাব বিশ্বকাপের পুরস্কার মঞ্চে উপস্থিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। চেলসির প্লেয়াররা ভদ্রভাবে তাঁকে নেমে যেতে বললেও নাছোড়বান্দা। আর শুধু সমাপ্তি অনুষ্ঠান নয়, শুরু থেকেই তিনি বিষয়টির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ইনফান্তিনো তো বলেই ছিলেন, “উনি খেলাধুলো খুব ভালোবাসেন। সরকারের সাহায্য ছাড়া এই ধরনের টুর্নামেন্ট আয়োজন করা যায় না। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে অনেক ধন্যবাদ।” খুব স্বাভাবিক। সরকারের সাহায্য তো দরকারই। কিন্তু জুভেন্টাসের প্লেয়ারদের নিজের ভবনে ডেকে এনে ইরানের সঙ্গে যুদ্ধের গল্প বলা কি খুব দরকার ছিল ট্রাম্পের? ট্রফির উদ্বোধনও হয়েছিল ট্রাম্পের অফিসে। ফিফা সম্প্রতি আমেরিকাতে একটি অফিস খুলেছে। সুসম্পর্ক তৈরি হওয়া তো ভালো বিষয়। সমস্যা হচ্ছে, ইনফান্তিনোর এই সুসম্পর্কটা হতে পারত চিনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের সঙ্গে। কারণ, প্রথমে এই টুর্নামেন্ট আয়োজনের কথা ছিল চিনে, ২০২১ সালে। কোভিড অতিমারীর জন্য সেটা সম্ভব হয়নি। এরপর ইনফান্তিনো গিয়েছিলেন সৌদি আরবে। কিন্তু সৌদির রাজপুত্র মহম্মদ বিন সলমান প্রস্তাব খারিজ করে দেন। তার মানে এই নয় যে, ক্লাব বিশ্বকাপ থেকে সৌদি আরব দূরে রয়েছে। টুর্নামেন্টের দু’দিন আগে ক্লাব বিশ্বকাপের অন্যতম স্পনসর হয় পাবলিক ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড। যার মাথা সেই মহম্মদ বিন সলমান। আল হিলাল-সহ সৌদি প্রো লিগের অনেক ক্লাব তাদের অধীনে। এখানেই শেষ নয়। সম্প্রচারকারী সংস্থা DAZN-এর দশ শতাংশ কিনে নিয়েছে একটি অন্য সংস্থা। যার মাথাতেও রয়েছেন মহম্মদ বিন সলমান। ২০৩৪-এ সৌদিতে বিশ্বকাপ। তার আয়োজনের নেপথ্যে যে সৌদির রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পরিকল্পনা রয়েছে, সেটা সম্পূর্ণ অন্য প্রসঙ্গ। মোট কথা, ইনফান্তিনো সব দিকেই সুসম্পর্ক বজায় রাখছেন। আর এই সুযোগে ট্রাম্পই বা নিজের প্রচার করতে কেন ছাড়বেন?
২০২৬-এ আমেরিকায় বিশ্বকাপ: ট্রাম্পকেও তো মাথায় রাখতে হচ্ছে, পরের বছর তাদের মাটিতে বিশ্বকাপ। সারা বিশ্বে যেখানেই যা সমস্যা হচ্ছে, তাতে হাজির ট্রাম্প। ‘শান্তির দূত’ বা ‘মসিহা’, নিজেকে বহু রূপে সামনে আনতে চাইছেন তিনি। এখনও পর্যন্ত সাফল্য পাননি। ফুটবলের মতো বৈশ্বিক বাজারকে সামনে রেখে ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার সুযোগ তিনি কেন ছাড়বেন? মানবাধিকার নিয়ে বিতর্কে থাকা কাতার বিশ্বকাপ আয়োজন করে ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে। সৌদিও সেই পথে। আমেরিকার প্রধান ‘শত্রু’ চিনের হাত থেকে যখন ক্লাব বিশ্বকাপ আয়োজনের সুযোগ হাতছাড়া হয়েছে, তখন ট্রাম্পের তো পোয়া বারো। পরের বছরের বিশ্বকাপের পরিকল্পনা ইনফান্তিনোও মাথায় রাখছেন। একটা কথা তো পরিষ্কার, আমেরিকার ফুটবল সংস্কৃতি নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। লিওনেল মেসির উপস্থিতিও তা উদ্ধার করতে পারেনি। শুধু অর্থব্যয় করলেই হয় না, ঠিকঠাক পরিকাঠামো দরকার। ক্লাব বিশ্বকাপ হয়ে দাঁড়াল সেটার মকশো করা। প্লেয়াররা গরমের দাপটে অতিষ্ঠ হয়েছেন, আবার কখন ঝড়-বৃষ্টিতে খেলা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। অধিকাংশ ম্যাচেই স্টেডিয়াম ভরেনি। বিশ্বকাপ আয়োজনের আগে এই সমস্যাগুলোর সমাধান করার কথাও ভাববে ফিফা। ইতিমধ্যেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, স্টেডিয়ামগুলোকে ঢাকা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। তবু একটা প্রশ্ন থেকেই যায়, প্রতি বছরই তো বিশ্বকাপ হয়, তাহলে এবার এত পরিকল্পনা কীসের? ২০১৮-র বিশ্বকাপ আয়োজক রাশিয়া, ২০২২-এ কাতার, ২০২৬-এ আমেরিকা, ২০৩০-এ ছ’টা দেশ জুড়ে, যার বেশিটাই ইউরোপে, ২০৩৪-এ সৌদি আরব। সবকটাই মহা শক্তিধর দেশ। ফিফার পরিকল্পনা ও শক্তিশালীদের রাষ্ট্রনেতাদের সঙ্গে ইনফান্তিনোর মাখামাখির কী ভবিষ্যৎ সেটা তো সময়ই বলবে। তবে একটা কথা স্পষ্ট, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান বা দক্ষিণ আফ্রিকার মতো ‘ছোট’ দেশগুলোতে আর বিশ্বকাপের আসর বসা মুশকিল। ডামাডোলের পৃথিবীতে ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য ফুটবলকে ছাড়তে রাজি নয় কোনও দেশ।
ফুটবলে লাভ হল যে দলগুলোর: নিছক ফুটবলের দিক থেকে দেখলে, মাত্র কয়েকটি দলই লাভবান হল। ব্রাজিলের ক্লাবগুলো দেখিয়ে দিয়েছে, ইউরোপের দলগুলোকে টক্কর দেওয়ার যথেষ্ট ক্ষমতা তাদের আছে। ফ্লুমিনেন্সে ডর্টমুন্ডের সঙ্গে ড্র করেছে, ইন্টার মিলানকে হারিয়েছে। গরম হোক বা যেই সমস্যা, এই মঞ্চকে পালমেইরাস বা ফ্লুমিন্সে নিজেদের প্রমাণ করার মঞ্চ হিসেবে দেখেছে। অন্যদিকে সৌদির ক্লাব আল হিলালের সাফল্যও কম নয়। ইউরোপের মধ্যে লাভবান দুটো ক্লাব- লিভারপুল ও বার্সেলোনা। দুটো দলই কিন্তু ক্লাব বিশ্বকাপে খেলেনি। লিভারপুল এখন প্রস্তুতি ম্যাচ খেলছে, বার্সেলোনাও প্রস্তুতি শিবির শুরু করে দিয়েছে। ইউরোপের অন্য ক্লান্ত দলগুলোর বিরুদ্ধে বাড়তি তরতাজা হয়ে নামতে পারবে লিভারপুল ও বার্সেলোনা।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.