Advertisement
Advertisement
Tutu Bose

‘অঞ্জন-শম্পাকে মিস করছি’, একান্ত সাক্ষাৎকারে ‘মোহনবাগান রত্ন’ টুটু বোস

'আমি কর্মকর্তা পল্টুর ফ্যান ছিলাম ছিলাম', বললেন টুটু বোস।

'I miss Anjan and Shampa', 'Mohun Bagan Ratna' Tutu Bose in an exclusive interview
Published by: Prasenjit Dutta
  • Posted:July 29, 2025 10:11 am
  • Updated:July 29, 2025 10:11 am  

কিছু মানুষ এমন হন, যাঁরা প্রতিষ্ঠানের সমনাম হয়ে ওঠেন। মোহনবাগান ও টুটু বোস সেরকমই সমার্থক। দীর্ঘ ছয় দশক তিনি তাঁর ‘মাতৃসম’ ক্লাবের সেবায় ব্রত ছিলেন। আজ ক্লাব তাঁর পৌরোহিত্যের সম্মান দিচ্ছে। ‘মোহনবাগান রত্ন’ পাওয়ার প্রাক্কালে সংবাদ প্রতিদিন-কে একান্ত সাক্ষাৎকার দিলেন সবুজ-মেরুনের ‘প্রাণপুরুষ’। শুনলেন দুলাল দে

Advertisement

প্রশ্ন: সাধারণ সদস্য হিসেবে একসময় ক্লাবে প্রবেশ। তারপর কর্মকর্তা। সচিব-সভাপতি হয়ে মোহনবাগান রত্ন। মোহনবাগানি হিসেবে দীর্ঘ যাত্রাপথের একটা বৃত্ত সম্পূর্ণ হল মনে করছেন?

টুটু: এভাবে তো কোনওদিন ভেবে পথ চলিনি। কিন্তু কী আশ্চর্য। ভেবে দেখলাম, মোহনবাগানে সদস্য থেকে মোহনবাগান রত্ন, এই দীর্ঘ যাত্রাপথ অতিক্রম করতে আমার ষাট-ষাটটি বছর লেগে গিয়েছে। একেবারে পারফেক্ট টাইম। কাজের থেকে অবসর নেওয়ার জন্য ‘ষাট’ এই সংখ্যাটি তো অনেক আগেই নির্ধারিত হয়ে গিয়েছে। আমিও তাই ক্লাবের প্রশাসনিক পদ থেকে অবসর নিয়েছি। কিন্তু অবসর নিয়েছি বললেই কি আর নেওয়া যায়। মোহনবাগান তো আমার রন্ধ্রে রন্ধ্রে। প্রশাসনিক পদে না থাকলে কী হবে, মোহনবাগান রয়েছে আমার আত্মার আত্মায়। আমার মননে। শয়নে। স্বপনে। ফলে একজন মোহনবাগানির চলার পথের বৃত্ত পূর্ণ হয়ে গিয়েছে বিশ্বাস করি না।

প্রশ্ন: মুহূর্তটা ভাবুন। মঞ্চে আজ যখন ‘মোহনবাগান রত্ন’ সম্মান গ্রহণ করবেন, কাউকে কি মিস করবেন, যাঁর এই সময়টায় নেতাজি ইন্ডোরের মঞ্চে আপনার পাশে থাকার কথা ছিল? যে বা যাঁরা আপনার হাতে মোহনবাগান রত্ন দেখে সবচেয়ে খুশি হতেন?

টুটু: (ভাবার জন্য একটুও সময় নিলেন না) অঞ্জন আর শম্পা। একজন আমার বন্ধু। আরেকজন বন্ধু কাম সহধর্মিণী। অঞ্জন পাশে না থাকলে আমি মোহনবাগান ক্লাব চালাতে পারতাম না। দু’জনে একসঙ্গে ক্লাবে এসেছি। একসঙ্গে স্বপ্ন দেখেছি। আজ আমার হাতে মোহনবাগান রত্ন সম্মান দেখলে সবচেয়ে খুশি হত। তাই মঞ্চে উঠে আমি হয়তো অঞ্জনকেই খুঁজব। আরেকজন আমার সহধর্মিণী শম্পা। সে না থাকলে ক্লাবে গিয়ে ঘরের বনের মোষ তাড়াতে পারতাম না। শম্পা ছিল বলেই সারাদিন ক্লাবে পড়ে থেকেছি। আর অঞ্জন ছিল বলে, ক্লাবটা মসৃণভাবে চালাতে পেরেছি।

প্রশ্ন: আজ বিকেলে মোহনবাগান রত্ন গ্রহণ করবেন। তার আগে ঠিক কোন ঘটনা আপনাকে এই মুহূর্তে স্মৃতিমেদুর করে তুলছে?

টুটু: কত পুরনো ঘটনা। ফ্ল্যাশব্যাকে এক এক করে সরে সরে যাচ্ছে। এক সময় মনে হচ্ছে, এটাই বোধহয় আমার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। পরক্ষণেই অন্য আরেকটা ঘটনা এসে প্রথমটাকে সরিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু ফিফার টাস্ক ফোর্সের মেম্বার হওয়াটা সত্যিই অনন্য। প্রিয়দা তখন ফেডারেশন সভাপতি। আর শেফ ব্লাটার ফিফার সভাপতি। প্রিয়দা সেই সময় আমাকে ফিফার টাস্ক ফোর্সের সদস্য করেছিলেন। ফলে ব্লাটারের সঙ্গে একটা বন্ধুত্ব শুরু হয়ে যায়। আর সেই বন্ধুত্বের সুযোগেই ব্লাটারকে মোহনবাগান ক্লাবে নিয়ে এসেছিলাম। সবুজ-মেরুন জনতা নিশ্চয়ই সেই দিনটা মনে রেখেছেন, যেদিন ব্লাটার এসে মোহনবাগান লনে একটা গাছ লাগিয়েছিলেন।

প্রশ্ন: এবার আর ব্যক্তিগত নয়। কর্মকর্তা হিসেবে আপনার কোন সিদ্ধান্তটা ক্লাবের জন্য সবচেয়ে কার্যকরী সিদ্ধান্ত হয়েছিল মনে হয়?

টুটু: অবশ্যই সেই অন্ধকার পরিস্থিতি থেকে ক্লাবকে বাঁচানো। ডার্বিতে গ্যালারি থেকে ঢিল পড়ার জন্য আমরা সেবার যুবভারতী থেকে দল তুলে নিয়েছিলাম। তারপর ভয়ংকর পরিস্থিতি। ফেডারেশন আমাদের সাসপেন্ড করে দিল। প্রফুল্ল প্যাটেল তখন ফেডারেশন প্রেসিডেন্ট। ঠিক হল, আমাদের নামিয়ে দেওয়া হবে পরের ডিভিশনে। আমি জড়িয়ে ধরেছিলাম প্রফুল্লকে। বন্ধুত্বের অধিকার নিয়ে বলেছিলাম, তুই এরকম করতে পারিস না। মোহনবাগান কোটি কোটি সমর্থকদের ক্লাব। ঠিক হল, তিন কোটি টাকা ফাইন আর শূন্য পয়েন্ট থেকে খেলা শুরু করতে হবে। সেই সময় তিন কোটি ফাইন মানে বুঝতে পারছেন? আবার বন্ধুত্বের জোর খাটালাম। তিন কোটি পারব না। দু’কোটি। নিজের বন্ড ভেঙে ২ কোটি টাকা ফাইন দিয়ে ক্লাবকে বাঁচিয়েছিলাম। সেই হিসেবটা অনেকদিন পরে ছিল। আমার অ্যাকাউন্টটেন্ট পরামর্শ দেয় ২ কোটি টাকা ক্লাবের ডোনেশন খাতে দেখিয়ে অ্যাকাউন্টটাকে ক্লোজ করে দিতে। সেই সময় ২ কোটি টাকাটা বড় ব্যাপার নয়। বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ হল, আমার সেই টাকায় ক্লাবের বিপদ কেটে গিয়েছিল।

প্রশ্ন: আচ্ছা সেই সময় কোন সিদ্ধান্তটা নিতে গিয়ে আপনার রাতের ঘুম নষ্ট হয়ে গিয়েছিল? চিমাকে মোহনবাগানে সই করানো না কি ক্লাবের জন্য প্রথম স্পনসরশিপ আনা?

টুটু: অবশ্যই বিজয় মালিয়াকে ক্লাবে নিয়ে আসা। যখন খবরটা পেলাম, ইস্টবেঙ্গল বিজয় মালিয়ার সঙ্গে ডিল ফাইনাল করে ফেলেছে, রাতের ঘুম উড়ে গিয়েছিল। সেই একভাবে বিজয়কে গিয়ে পাকড়াও করলাম। এরকমটা হতে পারবে না। ইস্টবেঙ্গল পাবে, মোহনবাগানে পাবে না, এরকমটা হবে না। বিজয় তখন ওর ম্যাকডাওয়েল ব্র্যান্ডটা আমাদের দিল।

প্রশ্ন: আচ্ছা, দিনের শেষে নিজেকে কীভাবে দেখতে চান? সফল বাঙালি ব্যবসায়ী না কি সফল মোহনবাগান কর্তা?

টুটু: বিদেশে গিয়ে স্যুট-বুট পরে ব্যবসায়িক মিটিং করার থেকে আমার কাছে বড় আরামের বিষয় হল, পাজামা-পাঞ্জাবি পরে মোহনবাগান মাঠে গিয়ে সমর্থকদের সঙ্গে বসে ঘুগনি খাওয়া। সে যে কী আরাম বলে বোঝাতে পারব না।

প্রশ্ন: আচ্ছা, এই যে ৬০ বছর ধরে আপনি কর্মকর্তার ভূমিকায়, এই দীর্ঘ পথে কখনও কোনও কর্তার মধ্যে নিজেকে মানে ভবিষ্যতের টুটু বোসকে দেখতে পান?

টুটু: এর উত্তর আমি কী দেব। এর উত্তর তো মোহনবাগানিরাই দিতে পারবেন। তাঁরাই বলতে পারবেন, ময়দানের কার মধ্যে আমাকে দেখতে পান।

প্রশ্ন: আচ্ছা, আমরা তো নানারকম ভাবে আপনাকে ব্যাখ্যা করি। আপনি নিজেই বলুন তো, টুটু বোসের এই জনপ্রিয়তার মূল ইউএসপি কী?

টুটু: একদম সহজ। নিজেকে কর্মকর্তার আসন থেকে নামিয়ে নিয়ে মাঠের সাধারণ জনতার মধ্যে মিশে যাওয়া। টুটুবাবু থেকে টুটুদা হয়ে ওঠা। মোহনবাগান জনতা জানে, আমি একদম মেঠো মানুষ।

প্রশ্ন: পরজন্ম বলে যদি কিছু থেকে থাকে, আপনি নিজেকে ফের কীভাবে দেখতে চাইবেন?

টুটু: ভগবানের কাছে তো আমি বারবার প্রার্থনা করি, আমাকে পরের জন্মেও যেন মোহনবাগানি করে পাঠায়। আমার কাজ একটাই, মোহনবাগানি হিসেবে মোহনবাগান ক্লাবের সেবা করা। পরজন্ম নিয়ে এটাই আমার প্রার্থনা।

প্রশ্ন: কর্তা হিসেবে আপনি চিরকাল অ্যাটাকিং স্ট্রাইকারের মতো খেলেছেন। আপনার এই খেলায় প্রতিপক্ষ হিসেবে কোনও কর্তাকে পেয়েছেন? যাঁকে মনে হয়েছে শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী?

টুটু: (কিছুক্ষণ চিন্তা করে) হুম। পল্টু দাস। ভয়ংকর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল। পল্টু দাসের সঙ্গে লড়াইয়ের খেলাটা আমি এনজয় করতাম।

প্রশ্ন: আচ্ছা একটা কথা বলুন তো, ময়দানের সবাই তো কর্তা টুটু বোসের ফ্যান। কিন্তু আপনি কোন কর্মকর্তার ফ্যান ছিলেন? মানে, আপনার চোখে আদর্শ কর্মকর্তা বলে কেউ ছিল?

টুটু: এটাকে ঠিক আমি আদর্শ বলব না। তবে ইস্টবেঙ্গল কর্তা পল্টু দাসের আমি ফ্যান ছিলাম। তাঁর হয়তো সেভাবে আর্থিক সঙ্গতি ছিল না। কিন্তু অনেক অসুবিধার মধ্যেও আমার সঙ্গে লড়াই দিতেন। স্বাভাবিক কারণেই ওনার প্রতি আমার একটা শ্রদ্ধা রয়েছে। সেভাবে আর কারও থেকে লড়াই পেলাম কোথায়?

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement