প্রসূন বিশ্বাস: পিয়ার্সন পল্লির মাঠে কয়েক বছর ধরে বিকাল হলেই একঝাঁক আদিবাসী ছেলে ফুটবল নিয়ে নেমে পড়ে। স্থানীয়রা যাকে বলে ‘বল পেটায়’ আর কি! এই আদিবাসী পল্লির হয়তো অনেক বয়স্ক মানুষেরাই জানেন না তাদের ভাষায় এই ছেলেগুলো বল পিটিয়ে পিটিয়েই মহকুমা, জেলার সেরা হয়ে এবার রাজ্য স্তরে সেরা হওয়ার লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছে।
শান্তিনিকেতনের পিয়ার্সন পল্লী আদিবাসী অধ্যুষিত গ্রাম। পাশের কালীগঞ্জও তাই। এই দুই গ্রামের মাঝেই গড়ে উঠেছে শান্তিনিকেতন ট্রাইবাল অ্যাকাডেমি। যাদের লক্ষ্যই হল ফুটবলের মাধ্যমে আদিবাসী তরুণদের মানোন্নয়ন। কোভিডের পরে শুরু হওয়া এই অ্যাকাডেমির সাফল্য চোখে পড়ার মতো। বিভিন্ন বয়সের পঞ্চাশ জন আদিবাসী ফুটবলার রয়েছে এই ফুটবল অ্যাকাডেমিতে। সঙ্গে দু’জন লাইসেন্স কোচ।
সাফল্যের খতিয়ানটা একবার চোখ বুলিয়ে নিলেই বোঝা যাবে কেন এমন কথা বলা। ২০২১ সালের ২৮ আগস্ট এই আদিবাসী ফুটবল অ্যাকাডেমির জন্ম। তারপর থেকে ২০২২ সালে তারা প্রথমবার অংশ নেয় বি ডিভিশন বোলপুর আন্তঃমহকুমা ক্লাব লিগে। প্রথমবার সুযোগ পেয়েই বি ডিভিশন চ্যাম্পিয়ন হয়ে এ ডিভিশনে উত্তীর্ণ হয়। পরের মরশুমে একইভাবে এ ডিভিশনে খেলতে নেমে চ্যাম্পিয়ন হয়ে আন্তঃমহকুমা সুপার ডিভিশনে উঠে আসে। ২০২৪ সালে সুপার ডিভিশন চ্যাম্পিয়ন হয়ে জেলা লিগে খেলার সুযোগ পায়। একই মরশুমে প্রথমবার জেলা লিগ খেলতে নেমেই ফের চ্যাম্পিয়ন হয় তারা। এবছরও আন্তঃক্লাব বোলুপুর মহকুমার সুপার ডিভিশন চ্যাম্পিয়ন হয়েছে তারা। আগামী মাসে বিবেকানন্দ কাপে খেলার সুযোগ পেয়েছে তারা। সেখানেও চ্যাম্পিয়ন রাজ্যস্তরে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছে এই অ্যাকাডেমির শিক্ষার্থীরা।
বীরভূমের প্রথম কোনও ফুটবল অ্যাকাডেমি যারা আইএফএ-র নথিভুক্ত হয়েছে। কয়েক বছর আগে তিরিশজন আদিবাসী ছেলেকে বুঝিয়ে সুজিয়ে ফুটবলার তৈরি করার কাজ শুরু করেছিলেন বিশ্বভারতীর লাইব্রেরিয়ান কৌশিক ঘোষ। এই কদিনের মধ্যেই সেই সংখ্যাটা পঞ্চাশ ছাড়িয়েছে। এই অ্যাকাডেমির ছাত্র জগাই কোঁড়া গতবার ঘরোয়া লিগে প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্লাবে খেলেছে। শুধু জগাই নয়, এবার এই অ্যাকাডেমির চারজন ফুটবলার প্রিমিয়ার লিগের কয়েকটি দলে ছিলেন। এই অ্যাকাডেমির দুই ছাত্র শান্তিরাম হাঁসদা ও সুহাগ হেমব্রম এবার সুযোগ পেয়েছে রাজ্য সরকারের বেঙ্গল ফুটবল অ্যাকাডেমিতে। এতে শান্তিনিকেতন ট্রাইবাল অ্যাকাডেমির অন্য ফুটবলাররা উৎসাহিত হয়েছে।
পিয়ার্সন পল্লির মাঠের পাশাপাশি এই অ্যাকাডেমির ফুটবলারদের পরিকাঠামো উন্নয়নের জন্য একাধিক ফুটবলপ্রেমী মানুষদের কাছে ছুটে যাচ্ছেন কৌশিক ঘোষ। যিনি পেশায় বিশ্বভারতীর কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সহ গ্রন্থাগারিক। কিন্তু নেশায় ফুটবল পাগল। আদিবাসী উন্নয়নের লক্ষ্য নিয়ে একাধিক কর্মযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছেন এই মানুষটি।
শুধু পিয়ার্সন পল্লীর মাঠে নয়। আরও ভালো মাঠের জন্য ফুটবলারদের বোলপুর স্টেডিয়ামের মাঠেও অনুশীলন করানোর ব্যবস্থা করেছেন কৌশিক ঘোষ। প্রয়োজনে শ্রীনিকেতনের মাঠেও অনুশীলন হয়। প্রচার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার্থীর সংখ্যাও বাড়ছে। প্রয়োজনে ভালো শিক্ষিত কোচের। মোট দু’জন লাইসেন্স হোল্ডার কোচ রয়েছে এখানে। আরও কয়েকজন সিনিয়র ফুটবলারকে কোচিং লাইসেন্স করানোর পরিকল্পনা রয়েছে কৌশিক ঘোষের।
শান্তিনিকেতন ট্রাইবাল অ্যাকাডেমির ফাউন্ডার ডাইরেক্টর কৌশিক ঘোষ বলেন, “কবিগুরুর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে আমরা আদিবাসী সমাজের উন্নয়ন করতেই এই কাজ করতে নেমেছি। আমাদের মাধ্যম হল ফুটবল। বীরভূমে প্রচুর প্রতিভা রয়েছে কিন্তু তাদের এতদিন একত্র করে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজ করার লোকের অভাব ছিল। আমরা এই ছেলেগুলোকে একত্রে করে একটা মঞ্চ দিতে চাই।”
আইএফএ ঘোষণা করেছে বেঙ্গল সুপার লিগ হবে। সেই লিগে বীরভূমের একটি দল থাকছে। বিএসএলে প্রতি জেলার ফুটবলারদের আধিক্য থাকবে। সেই দিক থেকে দেখতে গেলে কোপা টাইগার্সেও এই অ্যাকাডেমির ছেলেদের কাছে একটা বড় মঞ্চ হতে চলেছে। ইতিমধ্যেই জগাই কোঁড়ারা এখান থেকে খেলেই প্রিমিয়ার লিগে পরিচিত হয়েছে। এভাবেই এগিয়ে চলেছে লাল মাটির বুকে বেড়ে ওঠা এই আদিবাসী ফুটবল অ্যাকাডেমি।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.