অর্পণ দাস: হাল ছেড়ো না বন্ধু… কবির সুমনের গান হতে পারে সৌভিক সরকারের রিংটোন। ফোনের না হোক, জীবনের রিংটোন তো এটাই। মৃত্যুমুখ থেকে ফিরে এসে ‘অলিম্পিকে’ পদকজয়। সব মিলিয়ে তিনটে সোনা, একটি রুপো ও একটি ব্রোঞ্জ। তাও সেটা দুটো খেলা মিলিয়ে। কখনও অস্ট্রেলিয়া, কখনও জার্মানিতে দেশের নাম উজ্জ্বল করার দায়িত্ব এখন সৌভিকের কাঁধে। কিন্তু সেটাই সব নয়। বর্তমানে বেঙ্গালুরুবাসী যুবক আসলে খেলাধুলোর ঊর্ধ্বে প্রত্যেকদিন জীবনের নতুন গল্প শেখাচ্ছেন। এক মহৎ বার্তা ছড়িয়ে দিতে চান দেশবাসীর কাছে। সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটালকে তিনি শোনালেন সেই গল্প।
দেশের অধিকাংশ ক্রীড়াভক্তই হয়তো সৌভিক সরকারের নাম শোনেননি। ‘অলিম্পিক’ থেকে পদক এল, অথচ সেই নিয়ে খুব একটা চর্চা হল, সেটাও একটু আশ্চর্যের নয় কী? তাই প্রথমে এই প্রতিযোগিতার বিষয়টা খোলসা করা যাক, তারপর আসা যাবে সৌভিকের ‘আশ্চর্য’ গল্পে। অলিম্পিক, প্যারালিম্পিকের পাশাপাশি অনেকগুলি খেলা নিয়ে একটি বিশেষ ইভেন্ট হয়। যা আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি দ্বারা স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। তবে এই ইভেন্টের একটি বিশেষত্ব আছে। এই ইভেন্টে অংশগ্রহণ করতে পারেন শুধু তাঁরাই, যাঁদের শরীরের কোনও অংশ ট্রান্সপ্লান্ট করা হয়েছে। এই ইভেন্টের নাম ‘দ্য ওয়ার্ল্ড ট্রান্সপ্লান্ট গেমস’। যাকে অনেকে অঙ্গ প্রতিস্থাপনের দাতা ও গ্রহীতাদের ‘অলিম্পিক’ বলেও আখ্যা দেন। ২০২৫-এ এই টুর্নামেন্টের আসর বসেছিল জার্মানির ড্রেসডেনে। ভারত সেখানে ১৬টি সোনাসহ ৬৩টি পদক অর্জন করে। শেষ করে ১১তম স্থানে। ২০২৩-এ অস্ট্রেলিয়ার পর জার্মানি, দুবারই দেশের সাফল্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিলেন সৌভিক। চলতি বছরের আগস্টে জার্মানি থেকে টেন পিন বোলিং, ডার্ট ও পেটাঙ্ক ইভেন্টে অংশগ্রহণ করেছিলেন তিনি।
এরকম অনেক সৌভিকের গল্পই লেখা হয় দ্য ওয়ার্ল্ড ট্রান্সপ্লান্ট গেমসে। সৌভিকের গল্প শুরু দক্ষিণ দিনাজপুরের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে। জন্ম থেকেই তাঁর ব্লাডারের গঠনে সমস্যা ছিল। শারীরিক সমস্যার জন্য কোনও দিন সেভাবে খেলাধুলোর সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না। বয়স যখন ৪-৫ তখন জানতে পারেন, সমগ্র রেচনতন্ত্র নিয়েই সমস্যা। এমনকী এই শারীরিক অবস্থা নিয়ে আদৌ কতদিন বাঁচবেন, তা নিয়েও সংশয় তৈরি হয় অনেকের মধ্যে। ১২ বছর বয়সে ধরা পড়ল, একটি কিডনি ইতিমধ্যেই নষ্ট। তবু এই পরিস্থিতিতেই রাজ্যস্তরে র্যাঙ্ক করে উচ্চমাধ্যমিক পাশ। তারপর ইলেকট্রনিক্সে ইঞ্জিনিয়ারিং। ততদিনে একপ্রকার নিশ্চিত হয়ে গিয়েছে যে কিডনি প্রতিস্থাপন করতেই হবে। ২০১৫ সালে শরীর যেন সমস্ত শক্তি হারিয়ে ফেলে, শুরু হয় ডায়ালিসিস। ঠিক হয়, মায়ের থেকে কিডনি গ্রহণ করা হবে। কিন্তু আচমকাই সৌভিকের মা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন, কার্যত প্যারালিসিস। বাবার শরীরেও অসুস্থতা ধরা পড়ে। একদিকে নিজের ডায়ালিসিস চলছে, অন্যদিকে মা-বাবার শরীর নিয়ে আচমকা ভয়াবহ উদ্বেগ। অবশেষে মামার সাহায্যে কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়। মা-বাবাও সুস্থ হয়ে ওঠেন।
এখান থেকে সৌভিকের জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু। তিনি বলছিলেন, “আমার বাবা সবসময় বলতেন, ‘দেখাই যাক না কী হয়’। সেটাই আমার জীবনের মন্ত্র। কিডনি প্রতিস্থাপনের পর ঠিক করি, নতুন জীবনের সবটা উপভোগ করব। তার মধ্যে খোঁজ পাই, যাঁদের অঙ্গ প্রতিস্থাপন হয়েছে, তাঁদের জন্য আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা হয়। ভারতে যাঁরা সেই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন, আমার সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগ হয়। সেখানে একদিন একটি ভিডিওয় দেখি, ৬৫ বছরের এক ব্যক্তি টেনিস খেলছেন। তাঁর হার্ট ট্রান্সপ্লান্ট করা হয়েছে। আর সেই তিনিই কি না প্রায় ৫ মিনিটের র্যালি খেলছেন! তাও মাত্র একটা পয়েন্টের জন্য। ওটাই আমার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট।” ব্যস শুরু হল সৌভিকের অনুশীলন। ডাক্তারের নির্দেশ মেনেও আরেকটু বেশিই পরিশ্রম করা শুরু করেন। ২০২১-র ওয়ার্ল্ড ট্রান্সপ্লান্ট গেমস অনুষ্ঠিত হয় ২০২৩-এ, অস্ট্রেলিয়ায়। সেখানে ভারত থেকে অংশগ্রহণ করেছিলেন ৩৫জন প্রতিযোগী। সৌভিক ডার্টের একক ইভেন্টে ও বোলিংয়ে সোনা এবং ডার্টের দলগত ইভেন্টে রুপো জেতেন। তারপর জার্মানিতে ২০২৫-র ইভেন্টে ৫৭জন প্রতিযোগী। এখানে সৌভিকের ঝুলিতে টেন পিন বোলিংয়ে সোনা ও ডার্টে ব্রোঞ্জ। ৬৩টি পদক নিয়ে ভারত থামে ১১তম স্থানে।
তবে শুধু পদকের লড়াই নয়, সৌভিকদের যুদ্ধের মঞ্চ অন্যখানে। জার্মানি, অস্ট্রেলিয়ায় নয়, ভারতে। এদেশের মানুষের মনে। তাঁর বক্তব্য, “ভারতের মানুষের মনে এখনও অনেক ছুঁৎমার্গ আছে, ভুল ধারণা আছে। যেন অঙ্গ প্রতিস্থাপন মানেই জীবন শেষ। কিন্তু আমার মতো আরও অনেকে অঙ্গ প্রতিস্থাপনের পর স্বাভাবিক জীবনযাপন করছি। এমনকী পদক জিতে দেশের মুখ উজ্জ্বল করছি। আমরা চাই, আরও বেশি মানুষ অঙ্গ প্রতিস্থাপনে এগিয়ে আসুক। খেলাধুলোয় অংশগ্রহণ করে আমরা সেই সচেতনতা বাড়াতে চাই। অন্যান্য দেশের তুলনায় অঙ্গ প্রতিস্থাপনে ভারত অনেক পিছিয়ে। তবে আস্তে আস্তে পরিচিতি বাড়ছে, লোকের কাছে বার্তা পৌঁছচ্ছে। সরকারের থেকে আমাদের মতো ক্রীড়াবিদরা কোনও সাহায্য পাই না। আমরা অনুরোধ করেছি, প্যারালিম্পকসের মতো আমরাও যেন মহৎ উদ্দেশ্য ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে সাহায্য পাই। আমি তো বলব, অঙ্গ প্রতিস্থাপন জীবনকে আরও বড় করে দেয়।” শুনে মনে পড়ছিল, ‘আনন্দ’ সিনেমার সেই বিখ্যাত সংলাপ, “জিন্দেগি লম্বি নেহি, বড়ি হোনি চাহিয়ে।”
শুধু ইনডোর গেম নয়, সৌভিক এখন ম্যারাথনেও অংশগ্রহণ করছেন। যিনি কোনও দিন মাঠে নামতে পারবেন না বলেই সবাই ধরে নিয়েছিল, তিনি আজ ৫ কিলোমিটার ম্যারাথন অনায়াসে শেষ করেন। ৩৮ বছর বয়সি সৌভিক বর্তমানে একটি বহুজাতিক সংস্থার বড় দায়িত্বে। তার বাইরে লক্ষ্য দেশের নাম কীভাবে আরও উজ্জ্বল করা যায়। কীভাবে অঙ্গ প্রতিস্থাপনের বার্তা আরও ছড়িয়ে দেওয়া যায়। তিনি বলেন, “আমি সেটাকে ইতিবাচক হিসেবে নিয়েছে। কথায় আছে, জীবন অনিশ্চিত। তার মানে অনিশ্চিত মানে তো ভালোও হতে পারে, খারাপ কেন হবে? আমি যদি মৃত্যুমুখ থেকে ফিরে এসে নতুন জীবন উপভোগ করতে পারি, তাহলে বাকিরা কেন অনিশ্চিয়তার ভয়ে মরছে? আমিও বাবার মতো করে বলি, দেখাই যাক না কী হয়।” জীবনের নতুন মন্ত্র নিয়েই লড়ে যাচ্ছেন সৌভিক। আরও অনেক সৌভিকরা। তাঁরা হাল ছাড়ছেন না। জীবনকে আরও ভালোবেসে আঁকড়ে ধরছেন।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.