Advertisement
Advertisement
UFO

অজ্ঞাত উড়ন্ত বস্তু, সত্যজিৎ রায় ও প্রেমেন্দ্র মিত্রের রচনা

গল্পে আধুনিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন উপাদান।

UFO in Bengali literature
Published by: Kishore Ghosh
  • Posted:July 5, 2025 9:12 pm
  • Updated:July 8, 2025 2:26 pm  

সত্যজিৎ রায় ও প্রেমেন্দ্র মিত্রর রচনায় আধুনিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন উপাদান–
যেমন: রোবট, টাইম মেশিন, অদৃশ্যতা এসেছে, তেমনই এসেছে ভিনগ্রহ, মহাকাশযান ও ‘ইউএফও’-র রোমাঞ্চকর ইঙ্গিত। লিখছেন মানস ভট্টাচার্য।

Advertisement

যে-প্রশ্ন আমাদের সর্বাধিক নাড়া দেয় তা হল, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে আমরা কি একা?
না কি আমাদের ‘প্যারালাল’ কোনও ইউনিভার্স আছে, যেখানে অস্তিত্ব রয়েছে পৃথিবীর মতো প্রাণেরও? আমরা যেমন তাদের সন্ধান করে চলেছি প্রতিনিয়ত; কে জানে তারাও হয়তো প্রতিনিয়ত খুঁজে চলেছে আমাদের! এই সন্ধানপ্রক্রিয়ার গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম– ‘ইউএফও’।
‘ইউএফও’-র অনুসন্ধান যেমন বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে রোমাঞ্চকর গবেষণা, তেমনই আকাশপথে নিয়ত যাতায়াতকারী বিমানের নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ প্রায় ১৪৪টি দেশের বিভিন্ন মানুষের বয়ানে বারবার উঠে এসেছে ‘ইউএফও’ দেখতে পাওয়ার ঘটনা, এর মধ্যে সবথেকে বেশি তথ্য দিয়েছেন বিমানচালকরা। ‘ইউএফও’ শুধুমাত্র বিজ্ঞানভিত্তিক রহস্য অনুসন্ধান বা গবেষণা নয়; মানুষের নিজেকে জানার, নিজের সীমাকে অতিক্রম করার রূপকও বটে। অজানাকে জানার আকাঙ্ক্ষা, মানবসভ্যতার সীমা এবং আধুনিক জীবনের প্রযুক্তিনির্ভরতা– সবকিছু মিলিয়ে একটি বৃহত্তর সাহিত্যিক ও দার্শনিক আলোচনার পরিসর তৈরি করে এই ধরনের আলোচনা।

বাংলা সাহিত্যে ‘ইউএফও’-র ভাবনা আমাদের কল্পনা, বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান এবং আত্মিকবোধের পরিচয়। সত্যজিৎ রায় ও প্রেমেন্দ্র মিত্রর রচনায় আধুনিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন উপাদান– যেমন: রোবট, টাইম মেশিন, অদৃশ্যতা এসেছে, তেমনই এসেছে ভিনগ্রহ, মহাকাশযান ও ‘ইউএফও’-র রোমাঞ্চকর ইঙ্গিত। প্রফেসর শঙ্কু সিরিজে সত্যজিৎ রায় বহুবার ‘ইউএফও’ এবং ‘ভিনগ্রহী’ জীবনের প্রসঙ্গ এনেছেন। তঁার লেখায় ‘ইউএফও’ শুধুমাত্র অজানা মহাজাগতিক রহস্য নয়, বরং এটি মানুষের ভয়, কৌতূহল, আত্মান্বেষণ এবং সামাজিক-রাজনৈতিক চেতনার প্রতিফলন। ‘ইউএফও’-কে তিনি ব্যবহার করেছেন ‘অপরত্ব’ রূপে, যার মধ্য দিয়ে মানুষ টাইম মেশিনে ভ্রমণ করে বাস্তবতা ও কল্পনার মাঝে সেতুবন্ধন তৈরি করেছে, যা আবার আমাদের চেতনার রূপক। প্রফেসর শঙ্কু সিরিজে ‘অজ্ঞাত বস্তু’, ‘মহাজাগতিক প্রাণী’, ও ‘ভিনগ্রহী সভ্যতা’-র উপাদানের কথাও বারবার এসেছে। ‘ব্যোমযাত্রীর ডায়রি’ (১৯৬১), ‘প্রফেসর শঙ্কু ও ইউএফও’ (১৯৮২) গল্পে লেখক সরাসরি ‘ইউএফও’-র ধারণাকে ব্যবহার করেছেন। ‘স্বর্ণপর্ণী’ (১৯৯০) গল্পেও মহাজাগতিক রহস্য ও ভিনগ্রহী চিন্তা উঠে এসেছে। ‘অন্য পৃথিবী’-তে ধরা পড়েছে এলিয়েন সভ্যতার ছবি।

অন্যদিকে, প্রেমেন্দ্র মিত্রর লেখা ঘনাদা সিরিজেও নানা সময়ে ‘ইউএফও’ কিংবা মহাকাশ-ভিত্তিক রহস্যের উল্লেখ এসেছে, যেখানে গল্পকার বৈজ্ঞানিক যুক্তি ও রোমাঞ্চের সমন্বয়ে ভিন্ন অভিজ্ঞতা দিয়েছেন। পদার্থবিদ ঘনাদা এমন একটি অদ্ভুত বস্তুর সন্ধান আমাদের দেন, যা আকাশে হঠাৎ করে ভেসে ওঠে এবং রহস্যজনকভাবে অদৃশ্য হয়ে যায়। পাঠকের মনে তখন এ বর্ণনা একপ্রকার ‘ইউএফও’ চিত্র হয়ে ফুটে ওঠে।

‘ঘনাদা ও লালগ্রহের অভিযান’ গল্পে মঙ্গল গ্রহ নিয়ে এক বৈজ্ঞানিক অভিযানের কথা রয়েছে– যেখানে ভিনগ্রহের অস্তিত্ব ও সেই সন্ধানযাত্রার ইঙ্গিত সুস্পষ্ট। ‘ঘুংরু’, ‘ম্যাজিক’, ‘পিঁপড়ে’ এসব কাহিনিতে পরোক্ষভাবে এলিয়েন সভ্যতা ও অজানা গ্রহের কথা বলেছেন। শুধুমাত্র বাংলা কথাসাহিত্য নয়, মেহেরুন্নিসা পারভীন, নির্মলেন্দু গুণের আধুনিক কবিতায়ও মহাজাগতিক অনুভূতি, অজানা বাস্তবতা ও বিস্ময়ের প্রতিচ্ছবি অনেক সময় ‘ইউএফও’-র রূপকে প্রকাশ পেয়েছে। এই ধরনের সাহিত্যিক প্রয়াস কেবল বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধই করেনি, বরং বাঙালির কল্পনাশক্তিকে ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ প্রসারিত করেছে।

‌‘ইউএফও’ আসলে কল্পবিজ্ঞান সাহিত্য ঘরানার অংশ। বাংলা কল্পবিজ্ঞানে ভবিষ্যতের পৃথিবী কেমন হতে পারে, প্রযুক্তির অপব্যবহার সমাজে কী বিপর্যয় আনতে পারে, তা বারবার এই উঠে এসেছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, জলবায়ু পরিবর্তন, মহাকাশ অভিযানের মতো আধুনিক বৈজ্ঞানিক ধারণাকে বাংলার পাঠকের কাছে তুলে ধরেছেন বহু লেখক। নিখাদ ‘ফ্যান্টাসি ফিকশন’ হলেও সত্যজিৎ রায় বা প্রেমেন্দ্র মিত্রর লেখায় রয়েছে হিউমার-থ্রিল-অ্যাডভেঞ্চারের সংমিশ্রিত রেসিপি। আবার বিশ্বসাহিত্যের দিকে তাকালে দেখব, প্রায় ৫৫ বছর ধরে বিশ্বের সর্বাধিক বিক্রীত কল্পবিজ্ঞান কাহিনির লেখক ফ্র্যাঙ্ক হার্বার্টের লেখা উপন্যাস ‘ডিউন’ আসলে জলহীন এক মরুগ্রহের কথা বলে।

জুল ভের্নের ‘টোয়েন্টি থাউজেন্ড লিগ্‌স আন্ডার দ্য সি’ লেখার প্রায় ১৮ বছর পর সত্যিকারের ইলেকট্রিক সাবমেরিন তৈরি হয়, এবং এইচ. জি. ওয়েলসের ‘দ্য ওয়ার্ল্ড সেট ফ্রি’ লেখার প্রায় ৩০ বছর পর তৈরি হয়ছিল পারমাণবিক বোমা। চিনের কল্পবিজ্ঞান-লেখক সিশিন লিউ তঁার
‘দ্য থ্রি-বডি প্রবলেম’ গল্পে মাল্টিভার্সের কথা বলেছেন। গল্পের নায়কের সঙ্গে যোগাযোগ হয় ভিনগ্রহী প্রাণীর, যারা পৃথিবীতে নতুন প্রাণের সঞ্চার ঘটাতে চায়।

সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে মানব মনের নতুন ভাবনাকে রূপ দেয় বিজ্ঞানের নতুন আবিষ্কার, যা প্রতিষ্ঠিত করে লেখকের কাল্পনিক বক্তব্যকেও। এখানেই কল্পবিজ্ঞান সাহিত্য নিজেকে প্রাসঙ্গিক করে তুলেছে বিশ্বসাহিত্যের মানচিত্রে।

(মতামত নিজস্ব)
লেখক অধ্যাপক,
রামকৃষ্ণ মিশন আবাসিক মহাবিদ্যালয়
[email protected]

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement