Advertisement
Advertisement
Rare earth metals

বিরল খনিজের একচ্ছত্র অধিপতি! আমেরিকাকে পেড়ে ফেলে বিশ্বকে স্তব্ধ করে দিতে পারে এই ‘চৈনিক অস্ত্র’

বিরল খনিজের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ভারতের অবস্থান কোথায়?

China's monopoly on rare earth metals
Published by: Amit Kumar Das
  • Posted:July 16, 2025 3:53 pm
  • Updated:July 16, 2025 3:53 pm  

অমিত কুমার দাস: কথায় বলে যাহা কিছু বিরল, তাহা অমূল্য। যার হাতে রয়েছে সেই সাত রাজার ধন মানিক, সেই হয়ে ওঠে রাজাধিরাজ। প্রযুক্তি নির্ভর বিশ্বে আমেরিকার মাথায় টুপি পরিয়ে সেই রাজাধিরাজ এখন চিন। নেপথ্যে ‘রেয়ার আর্থ মেটাল’ বা বিরল খনিজ। এর জেরেই আমেরিকার চোখ রাঙানিতে ভয়ে গুটিয়ে যাওয়া তো দূর, বরং পাল্টা চোয়াল শক্ত রাখার সাহস পায় বেজিং। চোখ-কান খোলা রাখলে নজরে পড়বে পৃথিবীজুড়ে অস্ত্রের ঝনঝনানির মাঝেই শুরু হয়েছে আর এক নিঃশব্দ বিশ্বযুদ্ধ তার এই খনিজকে কেন্দ্র করে। কিন্তু কী এই বিরল খনিজ? এর কার্যকারিতাই বা কী? জ্বালানি তেলকে পায়ে মাড়িয়ে কেন একে পেতে এত মরিয়া আমেরিকার মত দেশ? দুর্মূল্য এই খনিজের লড়াইয়ে ভারতের অবস্থানই বা কী?

Advertisement

সালটা ১৭৮৭ সুইডেনের ইটারবি গ্রামের একটি খনিতে লেফটেন্যান্ট কার্ল অ্যাক্সেল অ্যারেনিয়াস প্রথম এই খনিজের সন্ধান পান। তারপর ধাপে ধাপে বহু পথ পেরিয়ে আধুনিক পৃথিবীর অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছে এটি। এই খনিজের মধ্যে রয়েছে ১৭ টি ধাতু। দেখা যায় এই ধাতু অন্য সাধারণ ধাতুর সঙ্গে মিশে তার বিশেষত্বকে বাড়িয়ে দেয় বহু গুণ। যেমন ধরুন ১ কিউবিক ইঞ্চির স্টিল ৪০ মেট্রিক টন চাপ সহ্য করতে পারে। কিন্তু যদি এতে মলিবডেনাম মিশিয়ে দেওয়া যায় তাহলে ওই স্টিলের ওজন অনেকটাই কমে যাবে এবং চাপ সহ্য করার ক্ষমতা বেড়ে দাঁড়াবে ১৩৬ মেট্রিক টন। শুধু তাই নয়, এই ধাতু প্রবল তাপ ও মাত্রাতিরিক্ত গতিতেও কার্যকরী ভূমিকা পালন করবে। একইভাবে নিওডিমিয়ামের মাধ্যমে তৈরি করা যায় প্রচণ্ড শক্তিশালী স্থায়ী চুম্বক। যার মাধ্যমে তৈরি করা যায় শূন্যে ভাসমান চৌম্বকীয় শক্তিতে চালিত ট্রেন। গ্যালিয়াম ও জার্মেনিয়াম ছাড়া বৈদ্যুতিন যন্ত্রের ব্যবহৃত সেমিকন্ডাক্টার তৈরিই করা যাবে না। এছাড়া সামান্য হেডফোন, এলইডি লাইট, স্মার্টফোন, লেজার, হাই স্পিড ডেটা ট্রান্সফার, এমআরআই, স্ক্যানার মেশিন, সোলার প্যানেল, রকেট, স্যাটেলাইট ও অত্যাধুনিক সামরিক অস্ত্র সর্বত্র এই বিরল খনিজের দাপাদাপি।

যদিও খনিজের আগে ‘বিরল’ শব্দ থাকলেও বাস্তবে এটি কিন্তু একেবারেই বিরল নয়। বরং পৃথিবীজুড়ে এর বিপুল সম্ভার। বিরল হল, এই খনিজের উত্তোলন ও প্রক্রিয়াকরণের পদ্ধতি। কারণ এগুলি আলাদাভাবে পাওয়া যায় না। অন্যান্য খনিজের সঙ্গে খুব অল্প মাত্রায় মিশে থাকে। ফলে বিরল খনিজ পেতে গেলে প্রচুর পরিমাণে খনন করতে হয়। কোটি কোটি টন খনিজের প্রক্রিয়াকরণের পর অল্প মাত্রায় মেলে এই ‘অমৃত’। তবে অমৃতের পাশাপাশি গরলের ঝুঁকিও রয়েছে। এটি খননের সঙ্গে উঠে আসে বিপুল পরিমাণ রেডিও অ্যাক্টিভ পদার্থ যা পরিবেশের জন্য বিপজ্জনক। একইসঙ্গে বিরল খনিজ উত্তোলন ও প্রক্রিয়াকরণ বিপুল অর্থ ব্যয় ও সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া। কিন্তু আমেরিকার মাথায় ‘টুপি’ পরিয়ে সেই প্রক্রিয়াকরণের সহজ ও সস্তা পদ্ধতি রপ্ত করেছে চিন। হয়ে উঠেছে বিশ্বের একছত্র অধিপতি।

১৯৮০ সাল পর্যন্ত আমেরিকা ছিল এই খনিজের সবচেয়ে বড় উৎপাদক। এরপর চিনকে বিরল খনিজ প্রসেসিংয়ের প্রযুক্তি দেয় আমেরিকা। উদ্দেশ্য ছিল সস্তায় চিন থেকে এই খনিজ কেনা। শুরুতে সবকিছু ঠিকঠাকই ছিল। কিন্তু ১৯৯৩ সাল নাগাদ দেখা যায় আমেরিকাকে ছাপিয়ে চিন এই খনিজের সবচেয়ে বড় উৎপাদক ও সাপ্লায়ার হয়ে উঠেছে। আমেরিকা থেকে পাওয়া প্রযুক্তিকে আরও অত্যাধুনিক করে অত্যন্ত কম খরচে এই খনিজ প্রক্রিয়াকরণের পন্থা রপ্ত করে তুলনামূলক কম দামে বিশ্বব্যাপী রপ্তানি শুরু করে চিন। যার জেরে পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে যায় যে আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়ার বহু সংস্থা কার্যত উঠে যায়। চিন ‘বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা’ (WTO)-তে সামিল হওয়ার পর থেকে এখনও পর্যন্ত আমেরিকার প্রায় ৬০ হাজার কারখানা বন্ধ হয়েছে।

বাজার থেকে সকলকে হটিয়ে বর্তমানে বিরল খনিজে বিশ্বের একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে উঠেছে ড্রাগন দেশ। ২০২৫ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বিরল খনিজ মজুত রয়েছে চিনে। ৪৪ মিলিয়ন মেট্রিক টন, দ্বিতীয় স্থানে ব্রাজিলে রয়েছে ২১ মিলিয়ন মেট্রিক টন, তৃতীয় স্থানে রয়েছে ভারতে ৬.৯ মিলিয়ন মেট্রিক টন। ৫ নম্বরে রাশিয়া এবং ৭ নম্বরে আমেরিকা। তবে খনি থাকা এবং তার উৎপাদন করা দুটি ভিন্ন বিষয়। ভারতে খনিজ মজুদ থাকলেও জানা নেই, উত্তোলন করে তার প্রক্রিয়াকরণ পদ্ধতি। এদিকে চিনের ৬ প্রদেশে বিরল খনিজের বিরাট ভাণ্ডার রয়েছে। এছাড়া আফ্রিকার ১৪টি দেশে চিনা বিনিয়োগে বড় পরিসরে শুরু হয়েছে এই খনিজের উত্তোলন প্রক্রিয়া। যার ফল, বিরল খনিজের পাশাপাশি এর সঙ্গে ব্যবহৃত হওয়া আরও একাধিক খনিজের সবচেয়ে বড় উৎপাদক এখন চিন। স্বাভাবিকভাবেই বিশ্বের বিরল খনিজকে নিয়ন্ত্রণ করে তারা। পশ্চিম-সহ কার্যত গোটা বিশ্ব এক্ষেত্রে চিন নির্ভর। এই ঘটনা বিশ্বব্যাপী নতুন বিবাদের জন্ম দিয়েছে।

২০১২ সালে এই ইস্যুতে প্রথমবার সংঘাতে জড়ায় চিন ও আমেরিকা। চিনের বিরুদ্ধে বাণিজ্যিক পদক্ষেপ নেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। যদিও তাতে বিশেষ কিছু লাভ হয়নি। এর গুরুত্ব আমেরিকার কাছে কতখানি সেটাও জানা যায় মার্কিন সংসদের এক রিপোর্টে। যেখানে দেখা যায়, মার্কিন যুদ্ধ বিমান এফ-৩৫ তৈরিতে প্রয়োজন পড়ে ৪ টনের বেশি রেয়ার আর্থ। মার্কিন নৌসেনার মিসাইল ডেস্ট্রয়ার আর্লে বার্ক ক্লাসে এর প্রয়োজন পড়ে ২ টন। ডুবোজাহাজ ভার্জিনিয়া ক্লাসে প্রয়োজন হয় ৪ টন। আমেরিকার যাবতীয় মারণাস্ত্র টিকে রয়েছে এই বিরল খনিজের উপর। জার্মানির এক রিপোর্টে জানা যায়, ন্যাটো সদস্যভুক্ত দেশগুলি বিরল খনিজের বিষয়ে পুরোপুরি চিনের উপর নির্ভরশীল। রিপোর্টে অনুযায়ী, এমন প্রায় ৫০টি বিরল খনিজ রয়েছে যার অভাবে আমেরিকার অর্থনীতি ও সামরিক ক্ষেত্র পুরোপুরি ভেঙে পড়বে।

এদিকে শুল্ক যুদ্ধের ডামাডোলের মাঝেই চিন আমেরিকাকে জার্মেনিয়াম ও গেলিয়াম রপ্তানির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। এই দুই ধাতু ছাড়া ইলেকট্রনিক ডিভাইসের সেমিকন্ডাক্টর বানানো সম্ভবই নয়। বিপদ বুঝে বিরল খনিজে চিনের ‘মনোপলি’ ভাঙতে জোটবদ্ধ হচ্ছে একাধিক দেশ। মহাশক্তি হয়ে ওঠার লড়াইয়ে বিশ্বজুড়ে শুরু হয়েছে এক নিঃশব্দ যুদ্ধ। সম্প্রতি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে জেলেনানস্কিকে সহায়তা করার প্রতিদান স্বরূপ দেশটির অর্ধেক বিরল খনিজের অধিকার চেয়েছে আমেরিকা‌। এককালে মধ্যপ্রাচ্যের তেলের খনি দখল নিতে যেভাবে উঠে পড়ে লেগেছিল পশ্চিমারা, এখন সেটাই শুরু হয়েছে এই বিরল খনিজের ক্ষেত্রে।

এদিকে আধুনিক পৃথিবীর মূল চালিকাশক্তি বিরল খনিজকে করায়ত্ব করে তাকে যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করেছে চিন। স্বার্থে আঘাত লাগলেই জারি হচ্ছে রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা। ভারতের বিরুদ্ধেও ব্যবহারিত হচ্ছে একই বাণিজ্য অস্ত্র। অথচ খাতায়-কলমে ভারতের মাটিতে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম বিরল খনিজের ভাণ্ডার মজুদ থাকলেও তা উত্তোলন ও প্রক্রিয়াকরণ কার্যত শূন্য। এক্ষেত্রে ভারত পুরোপুরি নির্ভরশীল চিনের উপর। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিঃশব্দ এই যুদ্ধে ধীর পায়ে হলেও নেমে পড়েছে আমাদের দেশ। জানা যাচ্ছে অসম, পশ্চিমবঙ্গ-সহ উত্তর-পূর্বের একাধিক রাজ্যে এই বিরল খনিজ উত্তোলনের কাজ শুরু করতে চলেছে কেন্দ্রীয় সরকার। সমস্ত প্রক্রিয়া সফল হলে, অদূর ভবিষ্যতে দেশের প্রয়োজন মেটানোর পাশাপাশি চিনের একছত্র আধিপত্য ভাঙতে পারে ভারত। তেমনটা হলে দেশের অর্থনীতিকে শিখরে পৌঁছে দেবে এই বিরল খনিজ।

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement