নিউ জার্সিতে গার্ডেন সিটি পুজো কমিটির পুজো।
স্নেহম ব্যানার্জি, নিউ জার্সি: বেশ কয়েক বছর হল বিদেশ বিভুঁইয়ে। আমরা এখন প্রবাসী। অস্বীকার করব না, আমেরিকার আদবকায়দা, অভ্যাস, জীবনযাত্রা, সবই আমরা আপন করে নিয়েছি৷ কিন্তু সেটা তো বহিরঙ্গে। সেটাই তো সব নয়। অন্তরে আমরা কেউই প্রবাসী নই- বাঙালি, ভারতীয়। মা দুর্গার আগমন আমাদের সেটা আরও বেশি করে মনে করিয়ে দেয়। এই চারটে দিন শুধুই আমাদের। সারা বছরের ‘একলা চলো রে’ ভুলে আমরা এই ক’দিন একান্নবর্তী পরিবারের অংশ। নিউ জার্সির গার্ডেন স্টেট পুজো কমিটির পুজোয় আমরা চেষ্টা করি বাঙালির চিরাচরিত আটপৌরে সংসারটা ধরে রাখতে। মাতৃমূর্তির সাবেকি রূপ থেকে ঠাকুরদালান তৈরি, বিদেশেও আমরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে সেই সংস্কৃতি বহমান রাখতে চাই।
আমাদের পুজোর পথচলা শুরু ১৯৮১ সাল থেকে। যাঁদের হাত ধরে পুজোর সূত্রপাত হয়েছিল, তাঁরা আজ প্রবীণ। নাতি-নাতনিদের হাত ধরে উৎসবে শামিল হন। আসলে জার্সি সিটি ভৌগোলিকভাবে নিউ জার্সি ও নিউ ইয়র্ক শহরের কাছে অবস্থিত। ফলে কর্মসূত্রে আগত বাঙালিদের জন্য এই জায়গাটা খুবই সুবিধাজনক। মূলত সপ্তাহের শেষে পুজো হয়। এবার যেমন ৩,৪,৫ অক্টোবর আমাদের এখানে পুজো। পুজোর শুরুর দিন থাকবে ‘শারদমেলা’।
বাগবাজারের দুর্গাপ্রতিমার যে সাবেকি রূপ, আমরা সেটাকেই অনুসরণ করি। অসুরের রং হয় সবুজ। তবে হ্যাঁ, পুরোটাই ফাইবারের তৈরি। জাহাজে করে মূর্তি আসে, তাকেই আমরা প্রতি বছর যত্নসহকারে সাজিয়ে তুলি। মোটামুটি পাঁচ-ছয় বছর ব্যবহার করার পর নতুন মূর্তি আনা হয়। পুজোর পুরো জায়গাটা আমরা যামিনী রায়ের ছবি দিয়ে সাজিয়ে তুলি। শাস্ত্র মেনে পুজো হয়। নিজেরাই ঢাকির ভূমিকা পালন করি। দশমীর দিন অন্তত ১৫০০ লোকের সমাগম হয় এখানে। লাল-পেড়ে সাদা শাড়িতে মহিলাদের সিঁদুর খেলা থেকে ঢাকের তালে ধুনুচি নাচ, সে এক বিরাট কাণ্ড! সব মিলিয়ে পুজোর ক’টা দিন তিন-চার হাজার মানুষের সমাগম হয়। এমনকী, অনেকে প্লেনে এখানে এসে হোটেলে থেকে আমাদের পুজোয় অংশগ্রহণ করেন।
এটা ঠিক যে, শরৎ এলে একটা সময় খুব মনখারাপ হত। মা ঘরে ফিরছেন, কিন্তু আমরা পারছি না। সেটা বলে বা লিখে বোঝানো সম্ভব নয়। এখনও যে হয় না, তা নয়। তবে মেনে নেওয়া আর মানিয়ে নেওয়ায় অভ্যস্ত হতে হতে জার্সি সিটির পুজোর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে পড়ে বুঝেছি, এরও একটা নিজস্ব আনন্দ আছে। সত্যি কথা বলতে, কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গের পুজোর থেকে আমাদের পুজো অনেক দিকেই অভিনব। নতুন জামাকাপড় পেলে তো সবারই আনন্দ নয়। কলকাতায় দেখেছি, নতুন জামাকাপড় বলতে জিন্স বা টি-শার্টকেও বোঝায়। এখানে কিন্তু তা নয়। পুজোর ক’টা দিন শুধুই ধুতি-পাঞ্জাবি কিংবা শাড়ি। বিদেশে আমরা নিজেদের শিকড়টা আরও বেশি করে আঁকড়ে ধরতে চাই।
যেমন গতবছর থেকে শুরু হওয়া ঠাকুরদালান। বাংলার বাইরে আর কোনও পুজোয় কখনও ঠাকুরদালান হয়েছে বলে তো মনে হয় না। কয়েকমাস ধরে ৪০-৫০ জন ঠিক সময় বের করে ঠাকুরদালান তৈরির অনুশীলন করি। দৈর্ঘ্যে মোটামুটি ৮০ ফুট, আর প্রস্থে ২০ ফুট তো হবেই। এখানে অবশ্য বাঁশের ব্যবহার হয় না। তাই আমরা পাইপ দিয়ে ভিতরের পুরো গড়নটা তৈরি করেছি। খিড়কি জানলা, দরজার গোলাকৃতি মুখ, পায়রার বাসা—সব যেন বাস্তবের মতো। এবার বলা যাক, কেন এই ঠাকুরদালান তৈরির পরিকল্পনা আমাদের মনে এল? একসময় ঠাকুরদালান মূলত জমিদার বাড়িতেই থাকত। তাতে বিধিনিষেধের বালাই ছিল। তারপর বারোয়ারি পুজো এল। আমাদের উদ্দেশ্য সর্বজনীন ঠাকুরদালান তৈরি করা। এখানকার মানুষ প্যান্ডেল ব্যাপারটা কী জানেন না। ফলে তাঁদের কাছে বাংলার সংস্কৃতি তুলে ধরার এটাও একটা উপায়।
এমন নয় যে, জার্সি সিটির পুজোর মূল দর্শক ও পৃষ্ঠপোষক কেবল বাঙালিরাই। পুজোর ক’টা দিন, ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের মিলনস্থল হয়ে ওঠে আমাদের পুজো। অসংখ্য বিদেশিও আমাদের পুজোর শুভাকাঙ্ক্ষী। দুর্গাপুজো ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পাওয়ার পর বিদেশিদের উৎসাহ আরও বেড়েছে। রঙের উৎসব, শব্দের উৎসব, আনন্দের উৎসবের সঙ্গী হতে আসেন তাঁরা। এটা কিন্তু তখন শুধু ধর্মীয় উৎসবের মধ্যে আটকে থাকে না। তা বৃহৎ সামাজিক প্রেক্ষাপট ছুঁয়ে হয়ে ওঠে বাঙালিয়ানা, ভারতীয়ত্বের উদযাপন।
সেই সূত্রে একটা কথা মনে হয়। আমি হয়তো কলকাতায় থাকতাম। আবার অনেক বাঙালির ছোটবেলা কেটেছে দিল্লিতে বা বেঙ্গালুরুতে। সেও এখন কর্মসূত্রে জার্সি সিটিতে উপস্থিতিতে। সে তো কার্যত দু’দফায় প্রবাসী। এখন তো এমনও হচ্ছে, লন্ডনের প্রবাসী বাঙালি এখানে চলে আসছেন। অনেকে বিদেশিনীর সঙ্গে এখানেই সংসার পেতেছেন। দেশে বসে দিল্লির বাঙালি কলকাতার বাঙালির কাছে প্রবাসী। কিন্তু আমাদের কাছে দিল্লি, মুম্বই, লন্ডন, পেনসিলভ্যানিয়া, সব বাঙালির পরিচয়- বাঙালি ও ভারতীয়। শুরুতেই বললাম না, অন্তরে আমরা কেউই প্রবাসী নই- বাঙালি, ভারতীয়। তাই এই পুজো আমাদের জন্য সেই কেন্দ্রবিন্দু, যেখানে বাঙালিয়ানাকে উদযাপন করা যায়। পরের প্রজন্মকে বাংলার সংস্কৃতি, রীতি, উৎসব, পোশাক, খাওয়াদাওয়া সব বিষয়ের সঙ্গে পরিচিত করে তোলা যায়।
আমাদের যে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়, তার নেপথ্যেও এই যোগসূত্র কাজ করে। এখানকার বাঙালিরাই মিলেমিশে নাচ-গান-নাটকে ভরিয়ে রাখি। কচিকাঁচাদের কণ্ঠে শোনা যায় রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলগীতি। এছাড়া প্রতিবারই কলকাতার বিখ্যাত কোনও শিল্পী এখানে এসে অনুষ্ঠান করেন। এবার যেমন আসছে ইউফোরিয়া ও ফসিলস। তার যে দর্শনীমূল্য, তাতে আমরা কোনও ভেদাভেদ করি না। মানে বেশি টাকা দিলে সামনের সিট, এরকম নয়। এমনিতেই তো আমাদের মধ্যে এত বিচ্ছিন্নতা। পুজোর ক’টা দিন শুধুমাত্র কয়েকটা টাকার জন্য সেটাকে প্রাধান্য দেব? না, আমরা তাতে বিশ্বাসী নই। মা আসেন একান্তবর্তী পরিবার নিয়ে। আমরাও আন্তরিকতায়, আতিথেয়তায় সেই একান্নবর্তী পরিবারের ঘরোয়া অনুভূতিটা বাঁচিয়ে রাখি।
আর রসিয়ে-কষিয়ে খাওয়াদাওয়া ছাড়া কি বাঙালি হয়? দাঁড়ান, এবার পুজোয় পেটপুজোর আয়োজনটা বলে রাখি। যাকে আমরা এখানে আদর করে বলি ‘বঙ্গভোজ’। দুপুরে থাকে ভোগপ্রসাদ। খিচুড়ি, লাবরা কিংবা পোলাও, আলুর দম, ফল, মিষ্টি ইত্যাদি থাকে। আর রাতে থাকে জমাটি আয়োজন। শনিবার রাতে ভাত, আলুভাজা, পাঁঠার মাংস, মাছ, মিষ্টি অ্যান্ড মোর…। আর রবিবার ফিশফ্রাই, ডিমের কালিয়া, চিকেন রোস্ট— ইত্যাদি মেনু। সব মিলিয়ে কবজি ডুবিয়ে খাওয়াদাওয়া। আমাদের পুজোর ট্যাগলাইন ‘হোক পুজো’, খাওয়াদাওয়ার ক্ষেত্রেই বা সেটা বাদ যাবে কেন?
তবে এই সব শুনে যদি কেউ মনে করেন, পুজো মানেই শুধু আনন্দ-ফূর্তি, তাহলে কিন্তু ভুল করবেন। কারণ, অনুষ্ঠান আয়োজন থেকে সমগ্র পুজো পরিকল্পনা, তার পিছনে আমাদের একটা মহৎ উদ্দেশ্য থাকে। আমরা বৈশাখী করি, সরস্বতী পুজো করি। বিদেশে থাকলেও দেশের মানুষের পাশে প্রতি কর্তব্যকেই সবসময় এগিয়ে রাখি। কলকাতার দুটো স্কুলকে— একটি অনাথ আশ্রম ও গোলপার্ক রামকৃষ্ণ মিশনের গদাধর পাঠশালাকে অর্থসাহায্য করা হয়। সারাবছর বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কাজের সঙ্গে আমরা যুক্ত থাকি। আবার কোভিড হোক বা যশ ঘূর্ণিঝড়, অসহায়-বিপদগ্রস্ত মানুষের জন্য আমরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলাম। মায়ের আগমনী আমাদের জন্য আরও বেশি করে সেই সুযোগ এনে দেয়। একটা কথা আমরা বিশ্বাস করি। মা দুর্গা আসেন সন্তানদের মুখে হাসি ফোটাতে। প্যান্ডেল হপিং, খাওয়াদাওয়া, নতুন জামাকাপড়—উৎসব মুখরতায় ভরে থাকে কয়েকটা দিন। কিন্তু প্রদীপের নিচে তো অন্ধকারও থাকে। পুজো তো তাদেরও। সেই দুস্থ মানুষদের দিনগুলোকে আনন্দে ভরিয়ে তোলা কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। নাহলে যে মায়ের আগমনের উদ্দেশ্যটাই মাটি।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.