বিশ্বদীপ দে: ১৯৫৪ সাল। জাপানে মুক্তি পেল একটা ছবি। নাম ‘গজিরা’। আজকের হলিউডের দৌলতে তাকে আমরা চিনি গডজিলা নামেই। বাকি পৃথিবীর কাছে অতিকায় দানবের দাপাদাপির এই ছবি হয়তো অ্যাডভেঞ্চারের জমকালো বর্ণ-গন্ধ-স্পর্শের। কিন্তু আপনি যদি জাপানের বাসিন্দা হন, তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়ায় একদম অন্যরকম। ১৯৪৫ সালের ৬ ও ৯ আগস্ট যে অবিশ্বাস্য ও অভূতপূর্ব ভয়ের কুয়াশায় ডুবে গিয়েছিল জাপান, সেই কুয়াশাই যেন জমাট বেঁধে গগনচুম্বী এক অস্তিত্ব হয়ে দেখা দিয়েছিল রুপোলি পর্দায়! গডজিলা দেখতে দেখতে কাঁদতে কাঁদতে হল ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন বহু দর্শক। অথচ সেই ছবিই যখন ১৯৫৬ সালে হলিউডে পাড়ি দিল, সেই একই ছবি দেখে আমেরিকানরা হেসে ফেললেন! কিন্তু কেন? এর পিছনে রয়েছে মার্কিন রাষ্ট্রযন্ত্রের রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র।
ব্যাপারটা বলতে গেলে শুরু থেকে শুরু করা দরকার। আরও একটা ৯ আগস্ট পেরিয়ে এল পৃথিবী। দেখতে দেখতে ৮০ বছর পেরিয়ে গিয়েছে ‘লিটল বয়’ ও ‘ফ্যাট ম্যান’ নামের দু’টি পারমাণবিক বোমা আছড়ে পড়ার সেই ইতিহাসের। দেড় থেকে আড়াই লক্ষ মানুষের মৃত্যু কেবল নয়। মৃত্যুর বীভৎসতাকে ছাপিয়ে গোটা সভ্যতার সামনেই ধ্বংসের এক অতিকায়, বলা যায় ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ পতাকা হয়ে দেখা দিয়েছিল সেই মরণশীতল কুণ্ডলী মেঘ! আসলে যুদ্ধের ভয়াবহতা সভ্যতা সেই গোড়া থেকেই দেখে এসেছে। কিন্তু এমন দমবন্ধ, অবিশ্বাস্য ছবি কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। আর সেই কারণেই মরণের এমন দিগন্তবিস্তারী চেহারা যুদ্ধবিধ্বস্ত জাপানকে একেবারে নিঃস্ব করে দিয়েছিল। এমনকী এও রটতে শুরু করে এবার টার্গেট টোকিও! অগত্যা তরুণ সম্রাট হিরোহিতো আত্মসমর্পণের ঘোষণা করেন। শেষ হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।
কিন্তু যুদ্ধশেষেও আতঙ্কের রেশ চলে যায়নি জাপান থেকে। পারমাণবিক বোমার আতঙ্ককে অত সহজে কাটিয়ে ওঠা যায় না। তাছাড়া ১৯৪৫ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত জাপান মিত্রশক্তির দখলে ছিল। জাপানের নিয়ন্ত্রণ ছিল মার্কিন জেনারেল ডগলাস ম্যাকআর্থারের হাতে। যেহেতু ‘শত্রু’ আমেরিকার নজরদারি থেকে বাঁচার উপায় নেই, তাই বিস্ফোরণের অব্যবহিত পরে তা নিয়ে প্রকাশ্যে কিছু বলারও যেন উপায় ছিল না। উইলিয়াম সুতসুইয়ের লেখা ‘গডজিলা অন মাই মাইন্ড: ফিফটি ইয়ার্স অফ দ্য কিং অফ মনস্টার্স’ বইয়ে এই দিকগুলোয় আলো ফেলা হয়েছে গডজিলার জন্মকথা বলতে গিয়ে। পরে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলার সময় তাঁকে বলতে শোনা গিয়েছে, ”জাপানের পেশাদার শিল্পী, চলচ্চিত্র নির্মাতা, ঔপন্যাসিকরা কেউই কিন্তু খোলামেলা ভাবে পরমাণু বিস্ফোরণ নিয়ে কথা বলতে পারতেন না। একই ভাবে জাপানের সাধারণ নাগরিকরাও কেমন যেন স্বল্পভাষী হয়ে পড়ছিলেন ওই নিয়ে কথা বলতে গেলে। কেননা ব্যাপারটা এতই ভয়াবহ ছিল যে প্রত্যেকের মনের মধ্যে এর জন্য একটা অপরাধবোধ ও লজ্জা কাজ করছিল।”
কিন্তু ১৯৫২ সালে আমেরিকানরা জাপান ছেড়ে গেলে পরিস্থিতি বদলায়। আর এই সময় থেকেই চলচ্চিত্র নির্মাতাদের মাথায় পাক খেতে থাকে অতিকায় মনস্টারদের চিত্রকল্প। তাঁদেরই একজন ইশিরো হন্ডা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন যুদ্ধবন্দি। হিরোশিমা-নাগাসাকির ওই নারকীয় পরিবেশের দৃশ্য তাঁর মনের ভিতরটা তছনছ করে দিয়েছিল। আর সেই মনের ধ্বংসস্তূপ থেকেই একসময় মাথা তুলে দাঁড়াল গডজিলা। গডজিলাকে নিয়ে তৈরি বিবিসির তথ্যচিত্রে ইশিরো হন্ডার স্ত্রী কিমি হন্ডার কথায়, ”উইদাউট দ্য বম্ব দেয়ার কুড নট হ্যাভ বিন আ মনস্টার।” এই একটা বাক্যেই ধরা আছে গডজিলার জন্মবৃত্তান্ত।
কিন্তু কেন গডজিলা? ছবিতে গডজিলা জুরাসিক যুগের এক বিপন্ন ডাইনোসর, যে কোনওভাবে টিকে গিয়েছে। দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরে সাঁতার কেটে এগিয়ে আসা সেই দানবকে সুতসুই বলছেন, ”হিরোসিমার মাঠে খেলা করতে থাকা কোনও নিরীহ শিশু। এমন এক নির্দোষ আক্রান্ত, যে ক্ষতবিক্ষত ও ভীত!” ছবিতে দেখানো হয়েছিল, মার্কিনদের হাইড্রোজেন বোমা নিয়ে পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণই গডজিলাকে আহত ও ক্রুদ্ধ করে তুলেছিল। তেজস্ক্রিয় হয়ে পড়া সেই অতিকায় পশুর অসহায়তার সঙ্গে, ক্ষোভের সঙ্গে সাধারণ জাপানিরা নিজেদের মিল খুঁজে পেয়েছিলেন। অর্থাৎ পারমাণবিক বিস্ফোরণের অবিশ্বাস্য অতিকায় বীভৎসতার মূর্ত রূপ কল্পনা করতে গিয়েই গডজিলাকে আঁকা হয়েছিল। যে মানুষের অকারণ হিংসা আর খামখেয়ালিপনার ফসল।
মনে রাখতে হবে ১৯৫৪ সালের অক্টোবরে মুক্তি পেয়েছিল ‘গজিরা’। এর ঠিক আগে মার্চে দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের বিকিনি দ্বীপপুঞ্জে আমেরিকা হাইড্রোজেন বোমা নিয়ে পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ ঘটায়। তার আগে সমস্ত জাহাজ-নৌকা সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। কিন্তু ‘লাকি ড্রাগন ৫’ নামের মাছধরা বোটটির সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তারা বিস্ফোরণের কেন্দ্রের সত্তর মাইল দূরে থাকলেও বোটে থাকা সকলেই হয়ে তেজস্ক্রিয়। এদিকে আতঙ্ক ছড়াতে থাকে যদি তেজস্ক্রিয় মাছ বাজারে চলে আসে? অজান্তেই তা খাবার হিসেবে শরীরের ভিতরে চারিয়ে যাবে গোপন বিষের মতো। ‘গজিরা’-তেও একই দৃশ্য দেখানো হয়েছিল। একেবারে শুরুতেই মাছধরা এক বোট গিয়ে পড়ে ব্যাখ্যাতীত এক উজ্জ্বল আলোর কবলে! তারা হয়ে ওঠে ‘হিবাকুশা’ অর্থাৎ বোমা আক্রান্ত ব্যক্তি। গডজিলাকে নির্মাণ করা হয়েছিল এক অতি-হিবাকুশা হিসেবে।
গোটা পৃথিবী সেই সময় আতঙ্কের চোরা ঢেউয়ে ভেসে যাচ্ছে। হিরোশিমা-নাগাসাকির পর বিশ্বের কোন শহরে আছড়ে পড়বে শত্রু দেশের মারণাস্ত্র, এমন আশঙ্কায় কাঁটা হয়ে রয়েছেন সবাই। কেননা আমেরিকা হাইড্রোজেন বোমা পর্যন্ত বানিয়ে ফেলেছে। কেবল জাপান নয়, গোটা পৃথিবীর মননশীল মানুষ সেই ছবি দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। ছবির শেষে প্রোটাগনিস্ট জীববিদ্যার অধ্যাপক ডক্টর ইয়েমেনের মুখ দিয়ে বলিয়ে নেওয়া হয়েছিল, একটা গডজিলার কবল থেকে বহু কষ্টে নিস্তার মিলেছে। কিন্তু সচেতন না হলে আবার একটা গডজিলা জন্ম নিতে পারে যখন তখন। সুতরাং গডজিলাকে মেটাফর হিসেবে ব্যবহার করে একটা রাজনৈতিক-সামাজিক বার্তা দেওয়াই যে ইশিরো হন্ডার আস উদ্দেশ্য ছিল সেটা স্পষ্ট।
কিন্তু আমেরিকার তা হজম হয়নি। হওয়ার কথাও নয়। জাপানের নিরীহ মানুষদের উপরে পরমাণু বোমা ফেলার অপরাধ তো ভিতরে ভিতরে তাদের অপরাধী করে তুলছিল ঠিকই। ঔদ্ধত্যের আড়ালে একটা অস্বস্তিও ছিল। তাই ১৯৫৬ সালে ছবিটি যখন আমেরিকায় মুক্তি পেল দেখা গেল তাতে বিস্তর এডিট করা হয়েছে। ছবির যে অংশে রাজনৈতিক বক্তব্য ছিল, তা ছেঁটে দেওয়া হয়। পারমাণবিক অস্ত্রের বিরুদ্ধে ‘বাড়াবাড়ি-সূচক’ (অবশ্যই তাদের মতে) অংশগুলি বাদ দিয়ে দেন মার্কিন টেকনিশিয়ানরা। সব মিলিয়ে প্রায় মিনিট বিশেক বাদ চলে যায়। ছবির শেষে কেবল বলা হয়, পৃথিবী আবার নিরাপদ হয়ে গিয়েছে। সব কিছু আবার স্বাভাবিক। বেমালুম অদৃশ্য ডক্টর ইয়েমেনের সতর্কবার্তা। ফলে মার্কিনদের কাছে ‘গডজিলা’ স্রেফ আমোদগেঁড়ে একটা ছবি। এক দানবের আবির্ভাব ও প্রস্থানের ছেলেমানুষি আখ্যান মাত্র! দর্শক সেই ছবি দেখে হাসলেন, কান্নার খোঁজ পেলেন না। যে অপরাধবোধ থেকে মার্কিন টেকনিশিয়ানরা এমনটা করেছিলেন, সেটা কিন্তু বহু পরেও অব্যাহত ছিল।
১৯৯৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘গডজিলা’ ছবিতে দেখানো হয় দানবটির সৃষ্টিই হচ্ছে ফরাসিদের পরীক্ষামূলক হাইড্রোজেন বোমা ফাটানোর ফলে! অর্থাৎ নিজেদের ‘পাপ’ ফরাসিদের কাঁধে তুলে নিষ্কৃতি পেতে চাওয়ার আকুতি। তাছাড়া এখানে বলা হল গডজিলাকে বধ করার উপায়ই পারমাণবিক অস্ত্র প্রয়োগ করা। উলটপুরাণ আর কাকে বলে! তবে যতই চেষ্টা করুক আমেরিকা, ইশিরো হন্ডার অমর সৃষ্টির আড়ালে রয়েই গিয়েছে হিরোশিমা-নাগাসাকির সেই জীবন্ত দুঃস্বপ্ন। যার ছোঁয়ায় কেঁপে কেঁপে ওঠে সভ্যতা। যে অপরাধ আজও আমেরিকাকে কাঠগড়ায় তোলে। তুলে চলবে আগামিদিনেও।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.