বিশ্বদীপ দে: ‘খাঁচায় দানা নাই, পানি নাই; কেবল রাশি রাশি পুঁথি হইতে রাশি রাশি পাতা ছিঁড়িয়া কলমের ডগা দিয়া পাখির মুখের মধ্যে ঠাসা হইতেছে। গান তো বন্ধই, চীৎকার করিবার ফাঁকটুকু পর্যন্ত বোজা।’ এক পাখি। আর তাকে শিক্ষিত করে তোলার চেষ্টায় শ্বাসরোধ করে দেওয়া পুঁথির ভারে। ‘তোতা-কাহিনী’ যিনি লিখেছেন, সেই মানুষটির চোখে শিক্ষা ব্যবস্থার ত্রুটি, তার দমচাপা অংশটা চোখ এড়ায়নি বলেই নিজে একসময় স্কুল যাওয়া ছেড়েছিলেন। ১৯১৩ সালের নোবেল প্রাপক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই অতীত অভিজ্ঞতা তাঁকে নতুন করে সব কিছু ভাবতে শিখিয়েছিল। ‘পেটের মধ্যে পুঁথির শুকনো পাতা খস্খস্ গজ্গজ্’ করাটাই যে একমাত্র শর্ত হতে পারে না তিনি বুঝেছিলেন অনেক অল্প বয়সে। কিন্তু তিনি একা নন। নোবেলজয়ীদের তালিকায় এমন নাম অনেক। খোদ অ্যালবার্ট আইনস্টাইন ক্লাস ফাঁকি দিতেন। উলটো ছবিটাও দিব্যি মিলবে। কোনও কোনও নোবেলজয়ী গোড়া থেকেই প্রথম সারির পড়ুয়া। আবার প্রথাগত পড়াশোনার ধাঁচাকে অস্বীকার করেও বিশ্বমঞ্চে নিজেদের আলোকবর্তিকা করে তোলার এই সব অনন্য নজিরকেও ভুললে চলবে না। যা বুঝিয়ে দেয় ‘পড়াশোনা করে যে গাড়িঘোড়া চড়ে সে’, এই সমীকরণে জগৎকে বাঁধতে চাওয়াটা কত বড় ভুল!
ক্লাস ফাঁকি দেওয়া, পরীক্ষায় ডাহা ফেল করা এই সব পড়ুয়াদের উপরে খানিক আলো ফেলা যাক। তালিকা দীর্ঘই। এই পরিসরে তাই ‘বিন্ধু মধ্যে সিন্ধু’ দেখার চেষ্টা করা যাতে পারে। আইনস্টাইনের কাছেই আসা যাক। বাঁধা লেকচার তিনি সইতে পারতেন না। শিক্ষকদের প্রিয়ও হতে পারেননি হয়তো সেই কারণেই। জুরিখ পলিটেকনিক স্কুলে পড়ার সময় আইনস্টাইন ছিলেন বেশ চঞ্চল এক তরুণ। প্রায়ই ক্লাস বাঙ্ক করতেন। পরীক্ষার খাতাতেও বিরাট কোনও সম্ভাবনা দেখতে পাননি পরীক্ষকরা। ১৯০০ সালে স্নাতক পরীক্ষায় দ্বিতীয় সর্বনিম্ন নম্বর পেয়ে পাশ করেন। আবার ক্লাসের বাকি বন্ধুদের মতো স্নাতক হওয়ার পরে রিসার্ট অ্যাসিস্ট্যান্ট হওয়ার সুযোগ পাননি। তবে এই ‘সাধারণ’ তরুণের একটা বিষয়ে ‘অসাধারণ’ ভালোবাসা বলা যায়, প্যাশন ছিল। সেই প্যাশনের নাম পদার্থবিদ্যা। ১৯২১ সালে নোবেল যে বিষয়েই তিনি নোবেল পাবেন। পড়াশোনায় অমনোযোগী হওয়ার তকমা যার ভাগ্যে জুটেছিল, সেই তিনিই একদিন ব্রহ্মাণ্ডকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করেন। তিনি এমন অনেক কিছুই প্রমাণ করে দিয়েছিলেন সমীকরণের মাধ্যমে যা সত্যি প্রমাণিত হতে লেগেছে কয়েক দশক!
আইনস্টাইনের অনুমান ছিল, ব্ল্যাক হোলের মহাকর্ষীয় টান এত বেশি যে তা সরলরৈখিক গতিতে চলতে থাকা আলোর গতিপথকেও বেঁকিয়ে দিতে পারে! ব্ল্যাক হোল আলোকে শুষে নেয় না। বলা যায় তাকে ফাঁদে ফেলে। ২০২১ সালে ‘নেচার’ পত্রিকায় প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে জানা যাচ্ছে বিজ্ঞানীদের সাম্প্রতিক এক পর্যবেক্ষণের কথা। প্রায় ৮০ কোটি আলোকবর্ষ দূরে অন্য এক ছায়াপথের কেন্দ্রে অবস্থিত এক অতিকায় ব্ল্যাক হোল থেকে উজ্জ্বল এক্স রে নির্গত হতে দেখেন বিজ্ঞানীরা। যা আইনস্টাইনের থিয়োরিকে নির্ভুল প্রমাণ করে। গবেষকরা বলেন, কৃষ্ণগহ্বরের ভিতরে প্রবেশ করলে আলো ফিরে আসে না তার কারণ, আমরা যে আলোকে আর দেখতে পাই না তার কারণ ব্ল্যাক হোল স্থানকে মুচড়ে দিয়ে আলোকে বেঁকিয়ে দেয়। সেই সঙ্গে নিজের চারপাশে চৌম্বক ক্ষেত্রও মুচড়ে দেয়। কত বছর আগেই যা অনুমান করতে পেরেছিলেন বিজ্ঞানীপ্রবর। যিনি নিজের সম্পর্কে বরাবর বলে এসেছেন, ”আমার মোটেই কোনও বিশেষ প্রতিভা নেই। আমি কেবলই একজন প্রবল কৌতূহলী।”
আরেকজন টমাস লিন্ডাল। ছোটবেলা থেকেই একটা বিষয় কিছুতেই তাঁর মাথায় ঢুকত না। বিষয়টার নাম রসায়ন। হাই স্কুলের রেজাল্ট বেরলে দেখা গেল, তিনি একেবারে ফেলই করে গিয়েছেন! তখন যদি কেউ বলত এই তরুণই একদিন নোবেল পাবে রসায়নে কেউ বিশ্বাস করত? তিনি নিজেও কি করতেন! অথচ ২০১৫ সালের রসায়নে নোবেল তাঁরই নামে। ডিএনএ-এর ক্ষতি এবং মেরামত নিয়ে গবেষণা করে গোটা বিশ্বকে চমকে দিয়েছেন টমাস। আধুনিক পৃথিবীর এক আশ্চর্য সাবজেক্ট মলিকিউলার বায়োলজির গবেষণায় যা এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। পরীক্ষায় ফেল থেকে সেই বিষয়ে গবেষণা করেই নোবেল- মাঝের পথ ছিল দীর্ঘ অথচ বিপুল প্রাণশক্তি ও প্যাশনের সম্মিলনে ঢাকা। যা লিন্ডালকে নোবেল এনে দিয়েছিল। লিন্ডাল বলেছেন, ”স্কুলে আমার একজন শিক্ষক ছিলেন, যিনি আমাকে মোটেই পছন্দ করতেন না। আমিও ওঁকে পছন্দ করতাম না। বছরের শেষে দেখা গেল, তিনি আমাকে ফেল করিয়ে দিয়েছেন। অবাক করার বিষয় হল, রসায়নেই আমি পাশ করতে পারিনি। আমিই একমাত্র রসায়নে নোবেল বিজয়ী যে হাই স্কুলে সেই বিষয়েই ফেল করেছিলাম!”
২০২১ সালে অর্থনীতিতে নোবেল পান ডেভিড কার্ড। তিনি পড়তেন কানাডার যে গ্রামীণ স্কুলে, সেখানে একটা শ্রেণিকক্ষে একজন শিক্ষক ৩০ জন বিভিন্ন ক্লাসের ছেলেমেয়ের পড়াতেন! আপাত ভাবে মনে হতেই পারে, এতে কি কারওই পড়াশোনা হবে! কিন্তু ডেভিড জানিয়েছিলেন, এতে তাঁর সুবিধাই হয়েছিল। ”আমি বয়সে বড় পড়ুয়াদের বিষয়গুলোও মন দিয়ে শুনতাম।” আর এতে যে শিক্ষার প্রেরণা হু হু করে মনের ভিতরে উদ্দীপনা ছড়িয়ে দিতে শুরু করে তাও জানিয়েছেন ডেভিড। ২০১৮ সালে রসায়নে নোবেল পাওয়া মার্কিন বিজ্ঞানী ফ্রান্সেস আর্নল্ড ছেলেবেলায় ছিলেন অস্বাভাবিক রকমের দুষ্টু। ক্লাসের পড়ায় মন-টন বসত না। একসময় স্কুল ব্যাপারটাই তাঁর যেন পছন্দ হচ্ছিল না। ক্লাসে ঢুকতেন না অনেক সময়। বহিষ্কৃতও হন। অথচ পরীক্ষায় ঠিকই পাশ করে যেতেন।
উদাহরণ বাড়িয়ে লাভ নেই সম্ভবত। সাফল্যের পথে সব সময় ফুল ছড়ানো থাকবে তার কী মানে! কাঁটা-পাথরের প্রতিকূলতাকে পেরিয়ে নিজের নিজের মতো করে সাফল্য সরণি নির্মাণের সমীকরণ নিজেরাই তৈরি করে নেন বিশ্বজয়ীরা। রবীন্দ্রনাথ-আইনস্টাইনদের চেতনায় ভেসে থাকা এই বিজয়মন্ত্র প্রথাগত শিক্ষার বেড়াজালকে টপকে উন্মুক্ত এক আকাশকে খুলে দিতে থাকে। যে আকাশে তোতাপাখির শ্বাসরোধ হয় না। পুঁথির সর্বস্বতার সঙ্গে জ্ঞানের আকুল তৃষ্ণাই তৈরি করে জ্ঞানের নানা অপরাজেয় শিখর।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.